বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
হোসেন মাহমুদ : আমাদের ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবনসহ চারপাশে প্রতিদিন কত ঘটনাই না ঘটে চলেছে। সব ঘটনার কথাই কিন্তু জানা যায় না। বহু ঘটনাই আমাদের অনেকের অজানা থেকে যায়। বস্তুত যা ঘটে তার কিছু বা বেশিরভাগ হয়তো আমরা জানতে পারি, সব কখনোই নয়। এখন সর্বত্রই সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের প্রবেশাধিকার বেড়েছে। ফলে একেবারেই সাদামাটা, একান্তই ঘরোয়া ও অনুল্লেখ্য বিষয় ছাড়া বাকি সব খবরই আগ্রহী মানুষের কাছে পেঁৗঁছানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আর সে সুবাদেই আমরা জানতে পেরেছি সম্ভাবনাময়ী ছাত্রী কাজী তানজিলা নেহলিন ও ভাগ্যাহত শান্তা ইসলামের অকালে প্রাণ হারানোর খবর, শিশুর মা হওয়া এক হতভাগিনী শিশু এবং উপোষে দিন কাটানো তাহমিনার পরীক্ষায় ভালো ফল করার কথা। সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদপত্রে খবর হয়েছেন তারা।
নেহলিন কে? তিনি আমাদের কারো মেয়ে, কারো বোন। এরকম কত নেহলিনই তো বাংলাদেশে রয়েছে, তাহলে তার কথা কেন? তার কথা এজন্য যে, তিনি সংবাদপত্রের খবর হয়েছেন। এক বাস দুর্ঘটনায় চট্টগ্রামের এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নেহলিনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। ২২ বছর বয়স্কা কাজী তানজিলা নেহলিন ছিলেন চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের ঈশ্বরখাইন গ্রামের ডা. কাজী আলী আকবরের মেয়ে। তার পরিবার চট্টগ্রাম নগরীর মাস্টারপোল এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। নেহলিন চট্টগ্রামের কুমিরাস্থ আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ৭ম সেমিস্টারের ছাত্রী ছিলেন। সরকারের সাম্প্রতিক ব্যবস্থায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটার ক্যাম্পাস বন্ধ করার নির্দেশে তাদের চট্টগ্রামের আউটার ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যায়। এর পেরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ তাদের চট্টগ্রাম থেকে কুমিরায় ভাড়া বাসে আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা করে। এসব বাসের বেপরোয়া গতিতে চলাচল নিয়ে শংকায় ছিলেন শিক্ষার্থীরা। ১১ আগস্ট বৃহস্পতিবার দুপুরে সেই ভাড়া করা বাসে করেই অন্য ছাত্রীদের সাথে কুমিরা ক্যাম্পাস থেকে চট্টগ্রামে ফিরছিলেন নেহলিন। এসময় তিনি মাকে ফোন করেন। বলেন, ‘মা, আমি এখন গাড়িতে। গাড়িটা খুব জোরে চলছে। ড্রাইভার যেভাবে গাড়ি চালাচ্ছে তাতে আমার ভয় করছে। তুমি চিন্তা করো না। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসছি। এসেই ভাত খাব। তুমি ভাত রেডি কর।’ হায়, কে জানত যে, তার শংকা অচিরেই ভয়ঙ্কর বাস্তবতায় রূপ নেবে! বাড়িতে মেয়ের জন্য ঠিকই ভাত নিয়ে বসেছিলেন ¯েœহময়ী মা, সে ভাত আর তার খাওয়া হলো না। নেহলিনদের বহনকারী বাসটি অত্যন্ত দ্রæত গতিতে চলছিল। তিনি তার মাকে ফোন করার অল্পক্ষণ পরেই সলিমপুর কালুশাহনগর ফকিরহাট এলাকা অতিক্রমের সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের সাথে বাসটির মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। বাসের সামনের অংশ দুমড়ে মুচড়ে যায়। ১৫ জন ছাত্রী আহত হন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক নেহলিনকে মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে ভাত নিয়ে মেয়ের অপেক্ষায় বসে থাকা মায়ের কাছে মোবাইল ফোনে মেয়ের দুর্ঘটনার খবর আসে। হাসপাতালে পৌঁছে তিনি মেয়েকে মৃত দেখতে পান। বুক চাপড়াতে চাপড়াতে তিনি বলতে থাকেন, ‘মেয়ে আমার ভাত খেতে চেয়েছিল। তোমরা আমার মেয়েকে ভাত খাওয়াতে দাও।’ এ দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে ছাত্রীদের একজন জানান, কর্তৃপক্ষ নিয়োজিত ভাড়া বাসগুলো যত দ্রæত সম্ভব ছাত্রছাত্রীদের আনা-নেওয়ার কাজ সেরে অন্যত্র ভাড়ায় চলে যায়। এজন্য চালকরা অতিদ্রæত বাস চালায়। আমরা বহুবার প্রতিবাদ করেছি, কোনো লাভ হয়নি। সে জন্যই নেহলিনকে জীবন দিতে হলো।
দরিদ্র পরিবারের জন্য একটু সচ্ছলতা আনতে গিয়ে শান্তা ইসলাম (২৫) এখন লাশ হয়ে পড়ে আছেন বৈরুতের এক হাসপাতালের হিমঘরে। আমরা জানি, দারিদ্র্যের কবলে নিষ্পিষ্ট হওয়া এদেশের নারীদের কেউ কেউ বিভিন্ন দালালচক্রের মাধ্যমে চাকরি নিয়ে বিদেশে যাচ্ছেন। তাদের অনেককেই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে লেবাননে পাঠানো হয়। এরকমই একজন ছিলেন নরসিংদির শিবপুর উপজেলার গির্জাপাড়া গ্রামের শান্তা। তার মা হামিদা বেগম জানান, স্বামী মারা যাওয়ায় দু’ছেলেমেয়েকে নিয়ে ভীষণ কষ্টে ছিলেন তিনি। অষ্টম শ্রেণীর পর পড়াতে পারেননি মেয়েকে। অভাবের তাড়নায় মেয়ে কাজ খুঁজতে থাকেন। শেষপর্যন্ত ২০১৩ সালে শান্তা গৃহপরিচারিকার কাজ নিয়ে লেবাননে যান। কিন্তু কাজের পরিবেশ ভালো না হওয়ায় সমস্যা হয়। এদিকে দু’বছর পর তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তিনি পালিয়ে বেড়াতে থাকেন ও অন্যত্র কাজের চেষ্টা করেন। এর মধ্যে কিডনি ও লিভারের সমস্যায় অসুস্থ হয়ে পড়েন শান্তা। কিন্তু কাগজপত্র না থাকায় চিকিৎসা নিতে পারেননি। গত ৬ আগস্ট তিনি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে বৈরুতের একটি বাংলাদেশি সংগঠনের প্রধানের সহযোগিতায় বৈরুত জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। অন্যদিকে অবস্থা গুরুতর হয়ে পড়ায় দেশে ফেরার জন্য কাগজপত্র তৈরি করতে তিন সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করলে কর্মকর্তারা তার কাছে টাকা চান। তিনি নিজের জমানো সব অর্থ তাদের দেন বলে খবরে বলা হয়েছে। এদিকে ৯ আগস্ট শান্তা মারা যান। এর পর তার লাশ রাখা হয় বৈরুতের হাসপাতালের হিমঘরে। শান্তার মা হতভাগিনী মেয়ের মৃত্যুর খবর পেয়েছেন। তার আহাজারিতে গ্রামের বাতাস ভারি। হামিদা বেগম মেয়ের লাশটি পেতে চান।
‘ধর্ষণের শিকার শিশুই এখন শিশুর মা’ শিরোনামে ১৩ আগস্ট সংবাদপত্রে একটি খবর প্রকাশিত হয়। জানা যায়, বরগুনার বামনা উপজেলার জাফ্রাখালী গ্রামে শিশুটির বাড়ি। পিতৃহারা দরিদ্র ঘরের এ শিশুটি মা ও ভাইয়ের সাথে থাকত। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় একই গ্রামের প্রভাবশালী আবদুল মান্নান তাকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করে। শিশুটির ভাই জানান, এব্যাপারে স্থানীয়দের জানানো হলেও কোনো ফল হয়নি। মেয়েটি গত বছর ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠে। কিন্তু মান্নান তার পিছু ছাড়েনি। এ অবস্থায় তাকে রাজধানীর বাড্ডায় তাদের ফুফুর বাসায় রেখে যান তিনি। ফুফু গার্মেন্টসে কাজ করেন। মেয়েটি বাসায় একাই থাকত। ভাইয়ের অভিযোগ যে, গত বছর ৬ জুন মান্নান দুপুরে ঐ বাসায় গিয়ে তার বোনকে ধর্ষণ করে এবং হত্যার ভয় দেখিয়ে এ ঘটনা প্রকাশ করতে তাকে নিষেধ করে। শিশুটি অন্তঃসত্ত¡া হয়ে পড়ে। পাঁচ মাস পর ফুফু তার শারীরিক পরিবর্তন দেখে জিজ্ঞাসাবাদে সব জানতে পারেন। বিষয়টি আবদুল মান্নানকে জানানো হলে সে গ্রামে মেয়েটির মাকে ঘটনা চেপে যেতে বলে। কোনো উপায় না পেয়ে এবছর ২৩ মার্চ ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪-এ আবদুল মান্নানকে আসামি করে মেয়েটি মামলা করে। ৩০ এপ্রিল সে এক ছেলের জন্ম দিয়েছে। এদিকে এখনো গ্রেফতার হয়নি মান্নান। ফলে মামলার বিচারও শুরু হয়নি। জাফ্রাখালী গ্রামের শফিকুল ইসলাম নামের এক অধিবাসী বলেন, এঘটনা জানাজানি হওয়ার পর মান্নান পলাতক রয়েছে। সে এলাকায় প্রভাবশালী। এর আগেও সে গ্রামের আরো দু’তিনটি মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। তারপর টাকা-পয়সা দিয়ে মিটমাট করে ফেলেছে। তিনি বলেন, এবয়সে মেয়েটি মা হয়েছে। সে নিজেই এক শিশু। এখন সে আবার শিশুর মা। আমরা এর বিচার চাই।
এবার এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে কুড়িগ্রামের রৌমারীর জাদুরচর ডিগ্রি কলেজের ছাত্রী তাহমিনা আক্তার। হালে পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া প্রায় সাধারণ ঘটনা। তবে তাহমিনা আক্তারের জন্য তা ব্যতিক্রমী ব্যাপারই বলতে হয়। অভাবের সঙ্গে নিত্য লড়াই করে, উপোষ থেকে পড়াশোনা করে সে ভালো ফল করেছে। জানা যায়, তার পিতা তারা মিয়া পেশায় একজন শ্যালো মিস্ত্রি। কোনোদিন কাজ পেলে কিছু টাকা পান, না পেলে শূন্য হাত। নিজের কোনো জমি নেই। তাহমিনার মামার জায়গায় ঘর তুলে আছেন। মেয়ে এসএসসিতেও জিপিএ-৫ পেয়েছিল। তাহমিনার মা নারগিস বেগম বলেন, ‘খুব কষ্ট কইরা মেয়ে লেখাপড়া করাইতেছি। প্রায় সময়ই ঘরে খাবার থাকেনি। মেয়ে না খেয়েই কলেজে গেছে। ভালো একটা পড়ার টেবিল নাই। ভাঙা টেবিলে বইসা পড়ে, কিন্তু লেখার সময় সমস্যা হয়। ওর বাপের এখন কামাই-রোজগার নাই বললেই চলে। কিন্তুক মেয়ে কয় আমি আরো লেখাপড়া করব।’ বাবা তারা মিয়া বলেন, ‘মেলা বিয়ার সমন্ধ আইছে। মেয়ে তো বিয়েতে রাজি হয় না। আমি তো খরচ দিবারই পারি না। মেয়েক নিয়া এখন বিপদে পড়েছি। এখন শহরের ভালো কলেজে ভর্তি হতে অনেক টাকার প্রয়োজন। অত টাকা দিবার সামর্থ নেই আমার। মেয়ের চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না।’ তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘আমার বাবা-মা খুবই গরিব। আমি অনেক কষ্ট করে রাত জেগে লেখাপড়া করেছি। কলেজে যাওয়ার সময় খাবার না থাকায় উপোষ থাকতে হয়েছে। রাতে কেরোসিন তেল না থাকায় যখন লেখাপড়া করতে পারিনি তখন শুধু কাঁদছি। ... বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার খুব ইচ্ছা আমার। কিন্তুক ভর্তি হওয়ার খরচই তো নাই। সমস্যা হলো আমার বাবা-মা কখন যে আমার বিয়া ঠিক করে ফেলেন।’
এ চারটি ঘটনা থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠে আসে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা বা প্রশাসনিক গাফিলতির কারণে ভাড়া করা বাসের চালকরা এভাবে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে ছাত্রছাত্রীদের আনা-নেওয়া করে। তারা ছাত্রীদের কোনো প্রতিবাদ শোনে না। কর্তৃপক্ষ এদিকটি উপেক্ষা করেছে। ছাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তার প্রতি যথাযথ দৃষ্টি না দেওয়ার জন্য তারা অবশ্যই দায়ী। আর এজন্যই কাজী নেহলিনের মতো মেধাবী ও সম্ভাবনাময়ী একজন ছাত্রীকে অকালে প্রাণ হারাতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাস চালকের বেপরোয়া বাসচালনা ও কাজী নেহলিনের মৃত্যুর জন্য বাস মালিককে দায়ী বা তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাগ্রহণ নিয়েছেন কিনা সে বিষয়ে কোনো খবর চোখে পড়েনি। হয়তো এরকম আরো অনেক ঘটনার মতোই এঘটনায়ও দায়সারা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। জানি না, সন্তান হারানো মা-বাবাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সান্ত¡না জানিয়েছেন কি না। এ মৃত্যুর দায় কি তাদের উপরও বর্তায় না! এ তো পরিষ্কার যে, বাসচালক যদি দ্রæত গতিতে বাস না চালাতেন, ছাত্রীদের আপত্তি-প্রতিবাদে গুরুত্ব দিতেন, তাহলে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটত না।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের অনেক নারীই অনেক বেশি বেতনে চাকরির প্রলোভনে বিদেশে যাচ্ছেন। তাদের একটি বড় অংশ যাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। তাদের বেশিরভাগকেই বিদেশে পাঠাচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। সংবাদপত্রগুলোতে প্রায়ই তাদের দুর্ভোগ-দুর্দশার কথা প্রকাশিত হয়। দরিদ্র পরিবারের এসব নারী কিছু টাকা রোজগারের আশায়, সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আনার স্বপ্নে, বাবা-মা, স্বামী-সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে জমি-জমা শেষ সম্বল বিক্রি করে দালালের মারফত অজানা-অচেনা দেশে পাড়ি জমান। সেখানে গিয়ে তারা প্রায় সবাই শিকার হন অবর্ণনীয় পরিস্থিতির। বেশিরভাগকেই আসলে বিক্রি করে দেওয়া হয়, কার্যত তারা পরিণত হন যৌনদাসীতে। কষ্ট-দুঃখের গভীর সাগরে নিপতিত হন তারা। তাদের দেখার কেউ থাকে না, কেউ সাহায্য করে না। তাই অনেকেই ফেরেন লাশ হয়ে বা নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে। লেবানন, জর্দানে, এমনকি যুদ্ধকবলিত সিরিয়াতেও বাংলাদেশের নারীদের পাঠাচ্ছে বিবেকহীন, ন্যায়-নীতিবোধহীন একশ্রেণির আদম ব্যবসায়ী। এনিয়ে বহু খবর প্রকাশিত হলেও অবস্থার কোনো উন্নতি হওয়ার কথা জানা যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি বাংলাদেশের দূতাবাস কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা, নিষ্ক্রিয়তা, উদাসীনতা, দুর্ব্যবহার এমনকি তাদের কাছ থেকে অবৈধ অর্থ আদায়ের অভিযোগ শোনা যায়। এরই সর্বশেষ বলি নরসিংদির শান্তা ইসলাম। এই শান্তার মতো বাংলাদেশের আর কত দরিদ্র, অসহায় নারী বিদেশের মাটিতে লাশ হবে?
তৃতীয়ত, বাংলাদেশের স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা বিগত ক’টি দশকে এক মারাত্মক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। শুধু পুলিশের অবহেলা বা উপেক্ষায় ইভটিজিং ভয়াবহ রূপ গ্রহণ করে। এর যন্ত্রণার শিকার হয়ে বহু বালিকা-কিশোরী-তরুণী আত্মহত্যা করেছে, করছে। সাম্প্রতিককালে অ্যাসিড নিক্ষেপের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু উত্ত্যক্ত করার ঘটনা খুব একটা কমেছে তা বলা যায় না। এর সাথে একশ্রেণির তরুণ বা যুবকের সীমাহীন যৌন লালসা অনেক মেয়ের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এ রকমই এক লালসার শিকার হয়েছে বরগুনার এক ষষ্ঠশ্রেণির শিশু। প্রভাবশালী মান্নানের লালসা থেকে বাঁচতে ঢাকায় এসেও রক্ষা পায়নি সে। মান্নান তাকে ঠিকই ধর্ষণ করেছে। তার পরিণতিতে এক সন্তানের মা এখন এই শিশু ছাত্রী। এঘটনায় শেষপর্যন্ত মামলা দায়ের করেছে সে, তাতে লাভ হয়নি। আইনের আওতার বাইরেই রয়ে গেছে মান্নান। তাকে বিচারাধীন করার ব্যবস্থা করবে কে? তার ভাই, মায়ের প্রশ্ন, শিশুর মা এই শিশুর এখন কী হবে?
চতুর্থত, বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে তাহমিনার মতো অনেক মেধাবী মেয়ে ছড়িয়ে আছেন। দারিদ্রের কারণে তাদের লেখাপড়ার ইচ্ছাকে মাটিচাপা দিতে হয়। চিরাচরিত সমাধান লেখাপড়া বন্ধ ও বিয়ে। সেক্ষেত্রে তাহমিনা অদম্য ইচ্ছা বলে এ পর্যন্ত এসেছেন। তারপর কি, তা তিনি নিজেও ঠিক জানেন না। শুধু ইচ্ছা থাকলেই তো লেখাপড়া হয় না। তাহলে তাহমিনার কী হবে? চিন্তায় বিমর্ষ তিনি। কে সহায়তার হাত বাড়িয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াবে? সরকার, ব্যক্তি, সংগঠন? এর উত্তর জানা নেই।
বিগত দিনগুলোতে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে। দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে, মানুষ সুখে-শান্তিতে আছে, বিশ্বে বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশের মর্যাদা লাভ করেছে ইত্যাদি সবাই শুনছে, জানছে। কিন্তু এ ধরনের মন খারাপ করা খবর প্রায়ই যখন পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়, সচেতন-বিবেকবান মানুষ সেসব পড়েন, তারা নিজেকেই প্রশ্ন করেনÑ আসলে আমরা কতদূর এগোলাম। এগোনোর চিত্র যে রকম হওয়ার কথা তার সাথে কি এ চিত্র মেলে?
লেখক : সাংবাদিক
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।