Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় স্বার্থের পক্ষে কথা বলাই কি ভারতবিরোধী রাজনীতি?

প্রকাশের সময় : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মহিউদ্দিন খান মোহন
১৯৭৮ সালের কথা। বিএনপির জন্মের মাত্র দশ দিনের মাথায় আমাদের এলাকায় (মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর) সফরে গিয়েছিলেন তৎকালীন সিনিয়রমন্ত্রী ও নবগঠিত দলের অন্যতম শীর্ষনেতা মশিয়ূর রহমান (যাদু মিয়া)। বিকালে তাঁর শ্রীনগরে পৌঁছার কথা থাকলেও পথিমধ্যে নির্ধারিত ও অনির্ধারিত জনসভায় যোগ দিতে গিয়ে বিলম্ব হয়। তিনি পৌঁছলেন রাত ৮টার দিকে। শ্রীনগর পাইলট হাই স্কুল মাঠে সে রাতেও প্রায় হাজার পাঁচেক মানুষ ধৈর্য ধরে বসেছিল যাদু মিয়ার কথা শোনার জন্য। বলে নেয়া ভালো, ভাসানী ন্যাপের ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রদলের শ্রীনগর থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং আমার বড় ভাই তৎকালীন ঢাকা জেলা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন খান বাদলের ছোটভাই হিসেবে যাদু ভাইর খুব স্নেহভাজন ছিলাম আমি। জনসভা শেষে শ্রীনগর ডাকবাংলোয় যাদু ভাইর বিশ্রাম ও খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল। খাওয়া শেষে যাদু ভাই সিগারেট হাতে ডাকবাংলো থেকে একাই বেরিয়ে এলেন। আমি তাঁর পিছু নিলাম। হাঁটতে হাঁটতে তাকে প্রশ্ন করলাম, ভাই, ন্যাপ বিলুপ্ত করে বিএনপিতে আমাদের যোগদান কতটুকু সঠিক হলো? তিনি তার বাম হাত আমার কাঁধে রেখে বললেন, ‘শোন, তোদের যাদু ভাই কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি। বাংলাদেশের বর্তমানে যে অবস্থা, তাতে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী (তখনও আধিপত্যবাদী শব্দটির প্রচলন হয়নি) থাবা থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখ-ত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন একজন দৃঢ়চেতা নেতা এবং একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম। আমার দৃষ্টিতে জিয়া সেই নেতা এবং বিএনপি সে রাজনৈতিক দল। আজ হয়তো তোদের মনে আমার এ সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু আজ থেকে দশ বছর পর, হয়তো আমি তখন থাকব না, তখন তোরা উপলব্ধি করতে পারবি তোদের যাদু ভাই ভুল করেনি।’
বিএনপির রাজনীতি নিয়ে যখনই আমি চিন্তা করি, তখনই যাদু ভাইর সেদিনের কথাগুলো মনে পড়ে। সত্যি কত দূরদর্শী নেতা ছিলেন তিনি! প্রেসিডেন্ট জিয়ার গড়া বিএনপিতে তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা। যদিও দল প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। মশিয়ূর রহমান যাদু মিয়ার সেদিন আমাকে বলা কথাগুলোকে ভিন্নতর ব্যাখ্যা করে যদি কেউ বলেন, ভারতবিরোধী রাজনীতি করার জন্যই বিএনপির জন্ম, তাহলে ভুল হবে। বিএনপি প্রতিষ্ঠার পেছনে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম গঠন করা, যেটি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা এবং উন্নয়ন-উৎপাদনের প্রশ্নে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবে। হয়েও ছিল তাই। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশে এক অভূতপূর্ব গণঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল।
‘পররাষ্ট্রনীতিতে কাউকে খুশি করার প্রয়োজন নেই’- প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের এ উক্তির মধ্যেই নিহিত আছে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী রকম হওয়া দরকার তার দিকনির্দেশনা। কাউকে খুশি করে নয়, কাউকে বিদ্বেষী বানিয়ে নয়, সমমর্যাদা ও সমঅধিকারের ভিত্তিতে বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হবে এবং অব্যাহত থাকবেÑ এটাই ছিল তাঁর সে উক্তির সারমর্ম। আর দলের প্রতিষ্ঠাতার সে নীতিকে বিএনপি মোটামুটি ভালোভাবেই অনুসরণ করে আসছিল।
বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী দু’টি দেশ। এরমধ্যে ভারত সবচেয়ে বড়ো, যা স্থল সীমান্তের বেশিরভাগ সীমানাজুড়ে বিস্তৃত। আর একটি ছোট অংশ রয়েছে মিয়ানমারের সঙ্গে। ভারত বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়ায় সে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা বিষয়ক সমস্যাও বেশি। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অর্থাৎ বহির্বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা বিষয়ে বিএনপি জাতীয় স্বার্থকে সবার ঊর্ধ্বে স্থান দেয় বিধায় ভারতের সঙ্গে এ দলটির সম্পর্ক খুব একটা মধুর কখনোই ছিল না।
তবে গত দু’তিন বছর ধরে ভারতের অনুকম্পা পাবার জন্য বিএনপির একটি অংশের দৌড়ঝাঁপ, কলা-কৌশল এবং কসরৎ কারো দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। বিশেষত ভারতের গত নির্বাচনে কংগ্রেসকে পরাজিত করে বিজেপির সরকার গঠনের পর দলটির এক শ্রেণির নেতাকর্মী দৃষ্টিকটুভাবে উল্লসিত হয়ে উঠেছিল। বিএনপির ওইসব নেতাকর্মী বাংলাদেশ-ভারতের রাজনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে কতটা অভিজ্ঞ আমার জানা নেই। তবে তাদের কথা বার্তায় মনে হতো, বিজেপি সরকার বোধ হয় তাদের দেশের সব কাজকর্ম বাদ দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বিএনপিকে কীভাবে অধিষ্ঠিত করা যায় তা নিয়েই মেতে থাকবে। তারা বোধকরি এ সত্যটি বিস্মৃত হয়েছিল যে, ভারতে রাজনৈতিক পালাবদলে যে দলই ক্ষমতায় আসুক পররাষ্ট্রনীতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না। বিশেষত বাংলাদেশ প্রশ্নে। আরো একটি বিষয় বিএনপির ওইসব ‘আমোদিত’ নেতাকর্মীরা ভুলেই গিয়েছিলেন যে, নরেন্দ্র মোদি একজন কট্টর হিন্দু মৌলবাদী নেতা এবং বিজেপিও একটি হিন্দু মৌলবাদী রাজনৈতিক দল। ফলে বিএনপির মতো একটি জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের মিল মহব্বত কতোটা হবে সেটা ভেবে দেখা উচিত ছিল। তা না করে নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতায় আরোহণে বিএনপি নেতাকর্মীরা অতিমাত্রায় আমোদিত হয়ে দলটির একটি মৌল নীতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেÑএটা বলা নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না।
এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ অবশ্য বলে থাকেন যে, ভারত প্রশ্নে বিএনপি আওয়ামী লীগকে এক কাতারে শামিল করার জন্য দলটির অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা একটি চক্র সুকৌশলে এ কাজটি করেছে। যাতে ‘ক্ষমতায় যাবার জন্য বিএনপিও ভারতের কাছে ধর্ণা দেয়’ সহজেই এ কথাটি জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া যায়। যাতে ভারতের পায়রবীর ক্ষেত্রে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো ব্যবধান না থাকে। বলাই বাহুল্য, ওই মহলটির চক্রান্ত অনেকাংশেই সফল হয়েছে। মোদি সরকারের ‘দয়াদৃষ্টি’ বর্ষিত হবেÑএ আশায় আওয়ামী লীগ সরকার দেশের স্বার্থ উপেক্ষা করে ভারতের স্বার্থ রক্ষার বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিলেও বিএনপি সেসব বিষয়ে জোরালো কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি। একটি ব্যাপার তখন অনেকেই লক্ষ করেছিলেন। ভারত প্রশ্নে বিএনপির মনোভাব পরিবর্তনকে এক শ্রেণির সংবাদপত্র এবং কতিপয় বুদ্ধিজীবী ‘শুভ লক্ষণ’ ‘শুভ বুদ্ধির উদয়, ‘সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত’ ‘কূপম-ূকতা পরিহার’ ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করে বাহবা দিচ্ছিল। বিএনপি নেতৃত্ব বোধকরি সে সময় এ সত্যটি উপলব্ধি করতে পারেননি যে, এর দ্বারা তারা বাংলাদেশের জনগণের বৃহৎ অংশের মধ্যে বিরাট একটি প্রশ্নবোধক চিহ্নের জন্ম দিয়েছেন।
কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন তাহলে কি বিএনপি ভারতবিরোধী রাজনীতি করবে? মোটেই নয়। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিশেষ কোনো দেশের তল্পিবাহক হওয়া কিংবা বিরোধিতা করা কোনো রাজনৈতিক দলের নীতি হতে পারে না। নীতি হবে জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রাখা। সে ক্ষেত্রে গভীর বন্ধুত্ব রয়েছে এমন দেশের সাথেও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে অনড় অবস্থান নিতে হবে। যে রাজনৈতিক দল সেটা করে না, বা করতে পারে না সে রাজনৈতিক দল তার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলবে।
হঠাৎ করে গত ২৪ আগস্ট কয়েকটি দৈনিক এ মর্মে সংবাদ পরিবেশন করেছে যে, বিএনপি আবার ভারতবিরোধিতার রাজনীতিতে ফিরে যাচ্ছে। পত্রিকাগুলো এ সংবাদটি পরিবেশন করেছে ওইদিন ‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র’ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনকে উপলক্ষ করে। পত্রিকাগুলো আগেভাগেই লিখে দিয়েছিল যে, সংবাদ সম্মেলনে বেগম জিয়া সুন্দরবনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখবেন।
সংবাদ সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়া রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্তকে দেশের স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সোচ্চার হওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন। বেগম জিয়া তার বক্তব্যে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কীভাবে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণœ করবে, সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন করবে, পরিবেশ ও পানি দূষিত করবে ইত্যাদি সবিস্তারে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে তিনি এটাও বলেছেন যে, আর্থিক দিক থেকে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে বাংলাদেশের জন্য লোকসানী একটি প্রকল্প। কারণ প্রকল্পে মাত্র ১৫ শতাংশ ভারতীয় অর্থায়ন থাকলেও তারা ৫০ শতাংশ লভ্যাংশ নিয়ে যাবে। অথচ প্রকল্প বন্ধ হলে কিংবা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের দায়ভার চাপবে বাংলাদেশের ওপর। এমন একটি দেশবিরোধী প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার কেন এতটা অনমনীয় হয়ে উঠল বিএনপি চেয়ারপার্সন সে প্রশ্নও তুলেছেন।
মূলত রামপাল কয়লাভিত্তিক ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের বিরোধিতা করায় একটি মহল এটাকে বিএনপির ভারতবিরোধী রাজনীতিতে ফিরে যাওয়া বলে প্রচার শুরু করেছে। কিন্তু আসলেও কি তাই? প্রকৃতই কি বিএনপি ‘ভারতবিরোধী’ রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করছে? এ প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে ভেবে দেখতে হবে বিএনপি কখনো ‘ভারতবিরোধী’ রাজনীতি করেছে কিনা। যে কারণে বিএনপিকে ‘ভারতবিরোধী’ রাজনৈতিক দল বলে মহল বিশেষ প্রচার করে থাকে, তাহলো বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বিষয়সমূহে বাংলাদেশের স্বার্থের প্রশ্নে দলটির অনড় অবস্থান। দলটির এ অবস্থান প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই স্পষ্ট। এমন কি যখন এ দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়নি, কিন্তু প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন, তখনও ভারত প্রশ্নে একই অবস্থান ছিল বাংলাদেশের। আর তা ছিল বলেই ১৯৭৭ সালে ফারাক্কা ইস্যু জাতিসংঘে উত্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দ্বিপক্ষীয় বিষয় যেসব সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে বিএনপি বাংলাদেশের স্বার্থের প্রশ্নে কোনো ছাড় দেয়নি ভারতকে। ফলে সঙ্গত কারণেই ভারতের সরকার, বিশেষত কংগ্রেস সরকার বিএনপির প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন হয়ে পড়ে।
ভারত আমাদের বৃহৎ নিকট প্রতিবেশী দেশ এবং বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রও বটে। বিশেষ করে ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দেশটির সহযোগিতার কথা বাংলাদেশের মানুষ এখনো কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই স্মরণ করে। তারপরও কঠিন সত্য হলো, এদেশের জনগণের একটি বিরাট অংশ ভারতবিরোধী মনোভাবাপন্ন। এর কারণ হলো স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ওপর ভারত সরকারের অতিমাত্রায় গার্জেনগিরি ফলানো। অভ্যন্তরীণ নানা বিষয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত সরকারের নাক গলানো ছিল দৃশ্যমান এবং অনভিপ্রেত। আর বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের ‘বিগ ব্রাদার’ সুলভ আচরণের কথা গোপন ছিল না। ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ভারতের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি হয় যে, ভারত বাংলাদেশকে কবজা করে রাখতে চায়। বাংলাদেশের জনগণের ভারত বিরোধী মনোভাব সৃষ্টির আরও একটি কারণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দেশটির আচরণ। ওই সময় কাদের সিদ্দিকী ভারতে অবস্থান নিয়ে ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর সীমান্তে সশস্ত্র তৎপরতা চালাতে থাকেন। কাদের সিদ্দিকীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং এ রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপে সমর্থন সহযোগিতা দেয় ভারত সরকার। ফলে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এমন ধারণা সৃষ্টি হয় যে, ভারত বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার মদতদাতা এবং আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষক।
বিপরীতে জিয়াউর রহমান সরকার দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে যে কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করে তা জনসাধারণের কাছে সমাদৃত হয়। তারা দেখে যে, ভারতের বাংলাদেশনীতি এদেশের স্বার্থের পরিপন্থী এবং এ বিষয়ে বিএনপির অবস্থান দেশের স্বার্থের পক্ষে। ফলে বিপুল জনগোষ্ঠী বিএনপিকেই ভারতের আগ্রাসন মোকাবিলায় সক্ষম রাজনৈতিক দল বলে বিশ্বাস করে। বিএনপিও জনগণের সে বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছে প্রতিটি ঘটনায়।
কিন্তু গত ৩ বা ৪ বছর ধরে বিএনপির অবস্থানে একটি পরিবর্তন আসে, যা কারো দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। বিএনপির কতিপয় শীর্ষ নেতার কথাবার্তা ও আচরণে এটা মনে হতে থাকে যে, ভারত সরকারের অনুকম্পা ছাড়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া অসম্ভব। তাই তারা ভারত সরকারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের নামে দীর্ঘদিনের অনুসৃত জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে অবিচল থাকার নীতি থেকে সরে আসে। ভারতের অনুগ্রহ লাভের জন্য বিএনপির এ নীতি বিসর্জনের বিষয়টি কারো অজানা থাকেনি। কেননা এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ জলাঞ্জলী দেওয়া হলেও বিএনপি তেমন কোনো কঠোর প্রতিবাদ করেনি। বরং ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় পালাবদলের পর বিএনপি এতটাই উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ে যে, অনেকে বিএনপিকে ‘নব্য ভারতপন্থী’ দল বলে কটাক্ষ করতেও দ্বিধা করেননি। কৌশলগত ভুলের কারণেই বিএনপিকে এ ধরনের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। নেতাকর্মী-জনগণকে সংগঠিত করার পরিবর্তে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে ভারতের অনুগ্রহ প্রার্থী হয়ে দলটি তার ভাবমর্যাদার ক্ষতি করেছে বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকগণ মনে করে।
এখন যে কারণে মহল বিশেষ প্রচার করছে বিএনপি আবার ভারতবিরোধী নীতিতে ফিরে যাচ্ছে তাহলো সুন্দরবনের সন্নিকটে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা করা। প্রশ্ন হলো, ওই প্রকল্পের বিরোধিতা কী শুধু বিএনপিই করছে? বরং বলা যায়, বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী ওই প্রকল্পের বিষয়ে মুখ খুলতে বিএনপি অনেক দেরি করে ফেলেছে। কারণ এর অনেক আগেই তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটিসহ বেশ কিছু সংগঠন ওই প্রকল্পের বিরুদ্ধে কর্মসূচী পালন শুরু করে দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, ভারতের স্বার্থ রক্ষা এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী একটি প্রকল্পের বিরোধিতা করাই কি ভারত বিরোধী রাজনীতি? এ প্রসঙ্গে গত ২৫ আগস্ট দৈনিক ইনকিলাব-এর এক বিশেষ প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে ‘প্রশ্ন হলো জাতীয় ইস্যু নিয়ে কথা বলা এবং দেশের স্বার্থের পক্ষে অবস্থান নেয়া কি ভারত বিরোধিতা? তাহলে তো অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের মত লোকজন ভারতবিরোধী। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, পঙ্কজ ভট্টাচার্যরা ভারতবিরোধী রাজনীতিক।’ ওই প্রতিবেদনটিতে আরো মন্তব্য করা হয়েছে- ‘দেশের জনগণের ওপর আস্থা না থাকায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার প্রয়োজনে আমাদের দেশের রাজনীতি হয়ে পড়েছে কার্যত ভারত নির্ভর। দেশপ্রেমের ছদ্মবেশে নেতানেত্রীদের দিল্লী তোষণের প্রতিযোগিতা চলছে উলঙ্গভাবে। দিল্লীর সাউথ ব্লককে খুশি করতে হেন কাজ নেই যে, আমাদের বড় দলগুলো করছে না। দেশ ও জনগণের স্বার্থ শিঁকেয় তুলে বড় দলগুলো নতজানু মানসিকতায় ভারতের তাঁবেদারি করছে।’
‘ভারতের তাঁবেদারি’, ‘নতজানু মানসিকতা’ বা ভারতের ‘তল্পি বহনের’ বদনামটি ছিল এককভাবে আওয়ামী লীগের। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সে বদনামের অংশীদার এখন বিএনপিও। যার ফলে দেশের স্বার্থবিরোধী একটি প্রকল্পের বিরোধিতা করায় চিহ্নিত মহল বলছে বিএনপি ভারতবিরোধী রাজনীতিতে ফিরছে। অথচ কে না জানে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বিষয়ে বিএনপি যে অবস্থান নিয়েছে, সেটিই সঠিক এবং দেশবাসীর প্রত্যাশাও সেটাই। তবে, ‘ভারতবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাবার ভয়ে বিএনপি আবার তার সুর নরম করে ফেলে কীনা সেটাই শংকার বিষয়। কারণ, ছদ্মবেশী ভারতপ্রেমীরাও যে বিএনপির অভ্যন্তরে নেই তা কে বলবে!
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সড়যড়হ৯১@ুধযড়ড়.পড়স

 

 

 

 



 

Show all comments
  • Mahbub Alam ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ৯:৪৩ এএম says : 0
    দেশের স্বার্থ রক্ষা করেই বিএনপি রাজনীতি করবে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় স্বার্থের পক্ষে কথা বলাই কি ভারতবিরোধী রাজনীতি?
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ