Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সমস্যার প্রতিকার ও শান্তি স্থাপনে প্রয়োজন সদিচ্ছার

প্রকাশের সময় : ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কালাম ফয়েজী
এক সম্ভ্রান্ত লোকের দুই ছেলে। শৈশব থেকে তারা একত্রে বেড়ে উঠেছে। পিতার মৃত্যুর পরও দুই ছেলে আলাদা হয়নি। দু ভাইয়ের অন্তমিল এত ভালো ছিল যে, সমাজের লোক তাদেরকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করতো। পরিবারে যেমন ছিল শান্তি তেমন উন্নতি। দু ভাই পরামর্শ করে কাজ করতো বলে তাদের ভুলভ্রান্তিও হতো কম। ফলে তাদের এগিয়ে যাওয়াটা সকলের চোখে ছিল সম্মানের। দু ভাইয়ের মিলের মতো দুই বউয়ের মধ্যেও মিল। একজন এটা করে তো আরেকজন আরেকটা করে এগিয়ে রাখে। কখনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হলেও কেউ কারো উপর দোষ চাপানোর চেষ্টাও করতো না।
পরিবারের এত শান্তি পার্শ্ববর্তী দুষ্ট লোকের সইবে কেন? শেষ পর্যন্ত গ্রামের মোড়ল এমন একটা চাল চালল যে, এক ভাই আরেক ভাইয়ের মুখ দেখতে পারে না। একভাই একদিকে যায় তো আরেক ভাই আরেক দিকে। আগে দুই ভাই পরামর্শ করে কাজ করতো। এখন একভাই আরেক ভাইয়ের ছায়া পর্যন্ত দেখতে পারে না। একদিন দুষ্ট মোড়লের পরামর্শে বড় ভাই সকলের সামনে ছোট ভাইকে কতগুলো অপবাদ দিল। বলল, সংসারের সকল অনিষ্টের কারণ এখন সে। সে যদি না থামে তবে ভালো হবে না। প্রয়োজনে মোড়লের লোক দিয়ে তার ঠ্যাং ভেঙে দেয়ার ব্যবস্থা করবে।
ছোট ভাই বড় ভাইয়ের অপবাদ শুনে তাৎক্ষণিক রাগলো না। সে বুঝতে পারলো তার ভাই পাশের বাড়ির বদমাইশ দানু মিয়ার পাল্লায় পড়েছে। মোড়ল দানু মিয়া তার ভাইকে উসকে দিচ্ছে। ছোট ভাই বড় ভাইকে ডেকে বলল, তোমার সব কথা আমি মানলাম। কিন্তু তার আগে চলো দু ভাই একত্রে বসি। তোমার অপবাদ সত্য কিনা যাচাই করি। সত্য প্রমাণিত হলে তোমার সব অপবাদ মেনে নিব। কিন্তু যদি সত্য না হয়? তাছাড়া তুমি পরিবারের অন্য সদন্যদের মতামত নাও, তাদের বিচারে অপরাধী সাব্যস্ত হলে আমি নিশ্চয়ই অপরাধী। অপরাধ প্রমাণের যেহেতু সুযোগ আছে আগে চলো আলোচনায় বসি।
বড় ভাই ছোট ভাইয়ের কথায় সায় দিল না। বরং দ্বিগুণ ক্ষেপে গিয়ে নানা রকম গালমন্দ করল। তাতে সমস্যা কমল না, বেড়ে গেল।তার সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললÑ তোর সঙ্গে বসার প্রশ্নই ওঠে না।
বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমনি এক আবহ ও অচলাবস্থা বিরাজ করছে। এখানে সরকার বলছে, সাম্প্রতিক যত জঙ্গি হামলা হচ্ছে সকলের পেছনে বিএনপির হাত আছে। এ কথার পক্ষে যুক্তি দেখানোর জন্য আওয়ামীমনা যত সংগঠন-সংস্থা, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আছে সকলে উঠে পড়ে লেগেছে। এবং এ বক্তব্যের পক্ষে প্রচারটাও মাশায়াল্লাহ ভালোই পাচ্ছে। কিন্তু অপর পক্ষে বিএনপি বলছে, যেহেতু তোমরা বড় ভাইয়ের মতো অতিভাকের আসনে আছো। আসো আমরা সকলে মিলে আলোচনায় বসি। সন্ত্রাস তৈরির পেছনে কার মদদ সেটা আগে প্রমাণ করি। এমন কি, কে বা কারা আইএস-এর নামে এত লোক হত্যা করছে তার শিকড় খুড়ে বের করি এবং ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিহত করি।
কথা শুনে আওয়ামী লীগ হাসছে, বলছে ‘বোকা কোথাকার! তোমাদের মতো ছোটদের সাথে বসবো কেন? বসলেই তো তোমরা আমাদের সমকক্ষ হয়ে যাও। তোমাদের সমকক্ষ হতে দেব কেন? তাছাড়া মুখ ফসকে যদি সত্য কথা বেরিয়ে যায় তাহলে তো মহামুশকিল।’
শৈশব থেকে দেখে আসছি, যাদের চুরি-ছিনতাইসহ নানা রকম অভ্যাস থাকে তারা সচরাচর জনসমক্ষে যেতে চায় না। আর যারা দুষ্ট লোক তাদের দেখেছি পরিশ্রম এড়িয়ে সুবিধা নিতে। কখনো অন্যের বাড়া ভাতে হাত দিয়ে যতটা তুলে নেয়া যায় সেই ফিকির নিয়েই তাদের ব্যস্ততা। চান্স পেলে গলাবাজি করতেও দ্বিধা করে না।
একটি দেশে বারবার জঙ্গি হামলা হচ্ছেÑ ব্যাপারটা সহজ না। সহজভাবে একে মেনে নেয়াও ঠিক না। হামলার কারণে জানমালের যে ক্ষতি হচ্ছে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি বয়ে আনছে ব্যবসানির্ভর গরিব দেশের অর্থনীতির ওপর আঘাত আসার ফলে।
সম্পদশালী দেশ সম্পদে ভরপুর থাকে। সেখানে কোন সমস্যা সৃষ্টি হলেও সেটা কর্তৃপক্ষ নিজ ক্যাপাসিটি দিয়ে পার হয়ে যেতে পারে। কিন্তু একটি সংকটাপন্ন পরিবারের মতো একটি হতদরিদ্র দেশে যদি একের পর এক জঙ্গি হামলার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে থাকে, আর গার্মেন্টস নির্ভর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়, আমাদের এত জনবহুল দেশের অবস্থা কী হবে, ভাবা যায়?
এবার সম্প্রতি (১৫ জুলাই ’১৬) তুরস্কে ঘটে যাওয়া ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে দুটো কথা বলি। ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশ তুরস্কে রয়েছে শক্তিধর সেনাবাহিনী। এক সময়কার প্রতাপশালী শাসক কামাল আতাতুর্কের পর থেকে প্রায় একশ’ বছর ধরে সামরিক বাহিনীর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব চলে আসছে বিশাল সে দেশটিতে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগানের আগেও ঐ দেশে যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন, সামরিক বাহিনীকে সমীহ করেই তাদের ক্ষমতায় থাকতে হয়েছে। প্রায় একশ’ বছর পর এই প্রথম সামরিক বাহিনী প্রচন্ড ধাক্কা খেলো। সামরিক বাহিনীর একটা শক্তিশালী অংশ অভ্যুত্থান করতে গিয়ে নিজেরাই জনরোষের মুখোমুখি হলো। এবং ব্যর্থতার দায়ভার কাঁধে নিয়ে তাদের পিছু হটতে হলো। জনতার স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণের ফলে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা যেমন ব্যর্থ হলো, তেমনি শক্তিধর সেনাবাহিনী অদূরদর্শিতার জন্য নিজ মাটিতে নিন্দার পাত্র হলো।
পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলোর রয়েছে শক্তিশালী সেনাবাহিনী। তাদের হাতে রয়েছে অতি আধুনিক সমরাস্ত্র। সে সমর সরঞ্জাম দিয়ে তারা শুধু অভ্যুত্থান নয়, সারা পৃথিবীকেই ধ্বংস করে দিতে পারে। কিন্তু তারা সেটা কখনো করতে যায় না। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইসরায়েল ও ভারতÑ প্রতিটি দেশের সামরিক বাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালী এবং তারা ইচ্ছে করলে মুহূর্তে কী না করতে পারে? কিন্তু তারা সেটা কখনো করতে যায় না।
প্রতিটি দেশে রয়েছে নিজ নিজ প্যাটার্নের গণতন্ত্র। নিজ নিজ প্যাটার্ন বললাম এজন্য, ব্রিটেন যে স্টাইলের গণতন্ত্র, চীনের গণতন্ত্রের ধরন ঠিক সেরকম না। আমেরিকায় যে ধরনের গণতন্ত্র শত শত বছর ধরে চলে আসছে রাশিয়ার গণতান্ত্রিক ধারা ঠিক সেরকম না। তবে প্যাটার্ন যা-ই হোক প্রতিটি দেশের রয়েছে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সেসব দেশগুলোতে শুধু সামরিক বাহিনী কেন, কেউই তাদের নিয়মের বাইরে যেতে চায় না। সেসব প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশের সামরিক বাহিনী যত শক্তিধরই হোক না কেন কখনো ক্ষমতারোহণের কথা ভাবে না। কেউ যদি রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ফলাতে চায়, সে যে কোনো মুহূর্তে সামরিক পোশাক বদল করে গণতান্ত্রিক ধারায় নিজের অবস্থা ও অবস্থানের কথা জানান দিতে পারে। আর সেসব দেশে জনগণের দীর্ঘদিনের চর্চার ফলে এমনভাবে মাইন্ড সেট হয়ে গেছে যে, স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ধারার বাইরে আর কিছুকে তারা কোনভাবেই মানতে রাজি নয়।
কয়েক বছর আগে মিশরেও একই ঘটনা ঘটেছিল। সেখানে গণতান্ত্রিক ধারার বাইরে সামরিক বাহিনী রাতের অন্ধকারে ক্ষমতা দখল করে নিল। আর সেই অবৈধ পাস্থায় ক্ষমতা দখলকে পুরো পশ্চিমাবিশ্ব সমর্থন দিল। সেই দেশে সামরিক অভ্যুত্থান টিকে গেলেও কোন শান্তিপ্রিয় গণতান্ত্রিক দেশ সামরিক শাসক আল সিসিকে সমর্থন দেয়নি। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব যারপরনাই হতাশ হলো এ কারণে যে, আরব বসন্তের ফলে নানান দেশে পরিবর্তন এসেছে ঠিক কিন্তু মিশরের সে পরিবর্তনকে ধরে রাখা গেল না। বরং প্রাক্তন সামরিক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের প্রেতাত্মাই কার্যত ক্ষমতায় বহাল রইল। তাহলে আরব বসন্তের নামে এত নাটক মঞ্চস্ত করার কী প্রয়োজন ছিল! সেই আল সিসির সামরিক অভ্যুত্থানের দিনেও লাখ লাখ লোক রাস্তায় এসে প্রতিবাদ জানিয়েছিল, কিন্তু সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তারা পেরে ওঠেনি, যেমনটা পেরেছে তুরস্কে।
মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে এক সময় দাসপ্রথা বলবৎ ছিল। এবং হাজার হাজার বছর ধরে পশুর মতো হাটবাজারে মানুষ বিকিকিনি হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষ সভ্য হয়ে ওঠে এবং মানবতার স্বার্থে তারা আইন করে এ প্রথা চিরকালের জন্য নিঃশেষ করে দেয়। তেমনি একসময় দেশে দেশে রাজতন্ত্র ছিল এবং গত শতকের মাঝামাঝি অন্তত শতেক দেশে সামরিক শাসন বলবৎ ছিল। সমাজতন্ত্র বহাল ছিল রাশিয়া, চীন, কিউবাসহ পূর্ব ইউরোপ ও লেটিন আমেরিকার দেশগুলিতে। খোদ বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও অনেক দিন এখানে সামরিক ব্যক্তিরা ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তারও পরিবর্তন হয়েছে। দেশের মানুষ এখন আর কোনভাবে সামরিক শাসন-রাজতান্ত্রিক বা সমাজ-তান্ত্রিক শাসন চায় না বললেই চলে। ব্রিটেন, মালেশিয়া, স্পেন, জাপানসহ পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে সীমিত রাজতন্ত্র বহাল থাকলেও সেটাকে সেসব দেশের মানুষ সম্মানের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে। নির্বাহী কর্তৃত্বে ও দেশ পরিচালনায় তাদের ভূমিকা নেই বললেই চলে। কেন এমন হলো? হয়েছে মানুষের সচেতনতার ফলে এবং যার যার নিজস্ব অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ হওয়ার কারণে। নিঃসন্দেহে এসব এটি দেশের নাগরিকদের এগিয়ে যাবার ফল। কিন্তু যেসব দেশের মানুষ এ পর্যন্ত এগুতে পারেনি, সেসব দেশে এখনো দুঃশাসন বহাল আছে বৈকি! কিন্তু সচেতন তুরস্কের মানুষ তাদের দেশে নাটকের মহড়া থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।
মনে রাখতে হবে, জনতা সব সময়ই মজলুমের পক্ষে। কখনো কখনো তারা জালিমের কর্তৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয় ঠিক কিন্তু মন থেকে তারা সবসময় এর পরিবর্তন আশা করে। এর কারণ তারা স্বাভাবিক জ্ঞানে কখনো মানুষের পশুত্বকে মেনে নিতে চায় না। বরং কেউ পশুত্ব দেখালে তারা মনে মনে সেটাকে যারপরনাই ঘৃণা করে। বর্তমানে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়ায় ও ইয়ামেনে পশ্চিমা স্টাইলের গণতন্ত্র কায়েমের নামে পশুত্ব চলছে সেটাকে কি পৃথিবীর মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছে? নিচ্ছে না। আমাদের দেশেও যে কেউ কেউ গণতন্ত্রের মানস কন্যার রূপ ধরে এসে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেছেন, সেটাকে কি কেউ ভালোভাবে নিচ্ছে? মোটেই না। তারপরও দেশের মানুষ নিজেদের সীমাবদ্ধতার জন্য বেশুমার জুলুম-অত্যাচার, অন্যায়-অবৈধ আচরণকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। লোকে বলে যার লজ্জা নেই, তার কাপড় পরার দরকার কি! যে আওয়ামী লীগের হাতে নির্বাচন প্রক্রিয়াটি মাটিচাপা পড়েছে, তাদের মুখে কি গণতন্ত্রের কথা মানায়? মানায় না। তবু তারা ক্ষমতায় আছে। ক্ষমতায় থেকেই শান্ত হচ্ছে না, অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে ইচ্ছে করে দেশে অশান্তি সৃষ্টি করছে। অবস্থাটি একই সংসারের দু’ভাইয়ের গল্পের মতো। যে ভাইয়ের হাতে সংসারের কর্তৃত্ব সে সংসারের কোন সমস্যা সমাধান করার জন্য আগ্রহ দেখায় না। বরং সব দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজের কর্তৃত্ব বহাল রাখতে চায়। বুঝতে কষ্ট হয় না যে, যত দূরভিসন্ধি দুষ্ট বড় ভাইয়ের মধ্যে। সে যতক্ষণ ক্ষমতায় আছে তার থেকে দু-একজন অনুগত তল্পিবাহক ছাড়া সংসারের কারো বিশেষ কল্যাণ হবার সম্ভাবনা নেই।
রাষ্ট্রের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য সরকারের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। কিন্তু সেটা থাকলে তো সব ঝামেলই চুকে যেতো। কিন্তু সব ঝামেলা চুকে যাক এটা তারা চাইবে কেন। বরং মোড়লের পরামর্শে উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে কীভাবে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা যায় সেটা নিয়েই তাদের যত ব্যস্ততা, যত অস্থিরতা।
এর সাথে যুক্ত হয়েছে ভারতের কিছু অশ্রু, কিছু মায়াকান্না, কিছু আশ্বাস-প্রশ্বাস। তারা বলছে, বাংলাদেশের সকল সমস্যার সমাধানে তারা পাশে থাকবে। মাস দুয়েক আগে প্রণবপুত্র অভিজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার সময় এ আশ্বাস দিলেন জোরালোভাবে। তার কথা শুনে কেউ বলল, আমাদের সমস্যা নিয়ে তাদের এত মাথাব্যথা কেন? কেউ বলল, এ আশ্বাস মূলত সামনে কোন অঘটনের ইংগিত। কেউ বলল, ভারত যে বাংলাদেশের বন্ধু প্রণবপুত্রের বক্তব্যে তারই প্রমাণ বহন করে।
কার্যত আমরা কী দেখলাম! আমরা দেখেছি গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে এক ভয়াবহ হামলা হলো এবং তাতে জাপান ও ইতালির বিশজন নিরীহ নাগরিক মারা গেলেন। পর্যালোচনা করে দেখা গেল, যারা মারা গেছে তারা মূলত আমাদের দেশের উন্নয়ন কাজের সাথে সম্পৃক্ত। কেউ গার্মেন্টস শিল্পের ক্রেতা, কেউ মেট্রোরেল নির্মাণের সাথে সম্পৃক্ত। আর এ হামলার পর ভয়াবহ আঘাত এসেছে আমাদের উন্নয়ন কাজে। কেউ কেউ মনে করলেন, এ হামলার পেছনে দাদাদের কোনো অভিসন্ধি থাকতে পারে। কারণ, গার্মেন্টস বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটা বড় উৎস। একে যদি বেহাত করা যায়, আমরা প্রতিবেশীর ওপর নির্ভর করে চলতে বাধ্য। আর তারাও সব সময় চায় পার্শ¦বর্তী সকল দেশের ওপর দাদাগিরি ফলিয়ে চলতে, সকল কাজে হস্তক্ষেপ করতে। এজন্য কারো সাথেই তাদের সম্পর্ক ভালো না।
বাংলাদেশের মানুষ তো জানে, ভারতের সাথে বাংলাদেশের অনেক সমস্যা। সমস্যাগুলো দেশের অস্তিত্বের সাথে যুক্ত। তার একটি পানির ন্যায্য প্রাপ্তি। সীমান্তে পাখির মতো মানুষ মারা, বাণিজ্যে আকাশ-পাতাল বৈষম্য, সাম্প্রতিক রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনসহ কত সমস্যা। এসব সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ভারতের কোনো সহযোগিতাই পাচ্ছে না। ভারত সরকার আর বর্তমান বাংলদেশ সরকারের চরিত্র একই বলা চলে। ভারত যেমন সমস্যার সমাধান না করেও সর্বক্ষেত্রে দাদাগিরি অব্যাহত রাখতে চায়, তেমনি বর্তমান সরকারও সমস্যার সমাধানের দিকে নজর না দিয়ে নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে রাখতে চায়। উদ্দেশ্য হলোÑ দৃষ্টিকে অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখা এবং ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করা। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাস দমনের নামে মেসবাড়ি উচ্ছেদ এবং ব্লকরেইড দিয়ে ছাত্রদের ধরে নিয়ে যাওয়া। কারো ধারণা, রাজনীতি-অর্থনীতির পর এবার আঘাত শিক্ষাব্যবস্থার উপর। এরপর আঘাত আসবে চিকিৎসাসহ অন্যান্য ব্যবস্থার ওপর।
সকলে জানেন, আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থা গ্রামভিত্তিক। আজ যারা দেশের উচ্চস্তরে এসে ছড়ি  ঘোরাচ্ছেন তাদের প্রায় সকলে গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন। রাজনীতিক, সরকারি-বেসরকারি আমলা, বড় বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, উকিল, অধ্যাপক, বিচারপতি, আর্মি, পুলিশ-র‌্যাব কর্মকর্তা। তাদের প্রায় সকলে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন হলে-হোস্টেলে ও মেসাবাড়িতে থেকে।
খোদ বঙ্গবন্ধুর কথাই বলি। তিনি ১৯৪৭-এর পর কোলকাতা থেকে ঢাকা আসেন। উঠেন পুরাতন ঢাকার ৮/৩ রজনী দাস লেনে, ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর কিছুদিন এসএম হলে থাকার সুযোগ হয়েছিল বটে কিন্তু ছাত্রত্ব চলে যাবার পর পুনরায় তাকে ওই মেসবাড়িতে এসে উঠতে হলো। ঢাকার উচ্চ বিদ্যাপীঠে ভর্তির সুযোগ পাওয়া শতকরা ৮০ ভাগের বেশি ছাত্রছাত্রী আসে মফস্বল কিংবা গ্রাম থেকে। ঢাবি, বুয়েট, মেডিকেল, এমন কি প্রাইভেট সকল বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন ঢাকায়। তাই বাধ্য হয়ে উচ্চ শিক্ষার স্বার্থে ছাত্রদের মেসে থাকতে হয়। কর্মজীবীদের একটা বৃহৎ অংশও মেসে থাকেন।
হালে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে, বাড়িওয়ালাদের অনেকেই নোটিশ দিয়ে মেস তুলে দিয়েছেন এবং নতুন করে কাউকে মেস ভাড়া দিচ্ছেন না। এতে পরোক্ষভাবে আমাদের উচ্চ শিক্ষার উপর আঘাত এসেছে। কারণ উচ্চ শিক্ষার জন্য যে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা ঢাকায় আছে, অথচ তাদের অনেকের আত্মীয়-স্বজন ঢাকায় নেই, তাদের পড়ালেখার ইচ্ছাটাই তো মরে যেতে পারে।
আমাদের দেশের মানুষ এমনিতেই শান্তিপ্রিয়। তারা ইচ্ছে করে ঝামেলা পাকাতে চায় না। কিন্তু যখন বাইরে থেকে অশান্তি-অরাজকতার দুর্নাম চাপিয়ে দেয়া হয়, তখন আর কী করার থাকে? যাইহোক, দেশে শান্তি স্থাপন এখন সরকারের সদিচ্ছার ব্যাপার মাত্র। আর আমাদের সব সমস্যার সমাধানে ভারত পাশে থাকবেÑএটা কার্যকর করাটাও ভারতের সদিচ্ছার ব্যাপার। তাহলেই দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলো সহজে মিটমাট হয়ে যেতে পারে অল্প সময়ের মধ্যে। কিন্তু সে সদিচ্ছা আমরা দুর্ভাগারা এই জীবনে একবারও দেখে যেতে পারব কি?
লেখক : প্রাবন্ধিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সমস্যার প্রতিকার ও শান্তি স্থাপনে প্রয়োজন সদিচ্ছার
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ