Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

বাড়ির পথে ছুটছে সবাই

স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত : বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ : দুই পরিবহনকে জরিমানা

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৫ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০০ এএম

করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আজ সোমবার থেকে সারা দেশে ৭ দিনের লকডাউন শুরু হয়ে গেছে। এ ঘোষণার পর পর থেকেই রাজধানী ছাড়ার হিড়িক পড়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। বাস টার্মিনালগুলোতে ঘরে ফেরা মানুষের উপচে পড়া ভিড়। সড়ক, ফুটপাতে মানুষের চলাচল বেড়েছে অনেক গুণ। বাস টার্মিনালে দেখা যায় টিকিটের জন্য যাত্রীদের দীর্ঘ সারি। স্বাস্থ্যবিধি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সবাই ছুটছে নিজ বাড়ির পথে। রাজধানীর বাহির হওয়ার প্রতিটি পথে একই দৃশ্য দেখা গেছে। এ সুযোগে অনেক পরিবহন বাড়তি ভাড়া আদায় করছে বলে অভিযোগ যাত্রীদের। অনেক ক্ষেত্রে বেশি ভাড়া দিয়েও টিকিট মিলছে না। তবে পরিবহন কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করে জানান, সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। তবে বাসের সিট অর্ধেকে নেমে আসায় টিকিট ক্রাইসিস দেখা দিয়েছে। এছাড়া গত কয়েকদিন একটু বাড়তি চাপও রয়েছে। এদিকে, ‘অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের জন্য দুটি পরিবহনকে জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
একই চিত্র দেখা গেছে নৌপথ ও রেলস্টেশনেও। রাজধানী ছেড়ে যাওয়া মানুষের ঢল নামে লঞ্চ টার্মিনালে। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে লোকজন ছুটছে দক্ষিণবঙ্গের উদ্দেশে। সড়কে যানবাহনের সঙ্কট থাকায় ভেঙে ভেঙে বিভিন্ন ছোট যানবাহন ও মোটরসাইকেলে তারা যাচ্ছে শিমুলিয়া ঘাটের উদ্দেশে। নৌপথেও নৌযান সঙ্কট দেখা গেছে। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার, লৌহজং ও শ্রীনগরের কয়েকটি স্পট থেকে যাত্রীদের মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে ট্রলারে পদ্মা নদী পার হতে দেখা গেছে।
গতকাল রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখলাী বাস বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি কাউন্টারের সামনে যাত্রীদের ব্যাপক উপস্থিতি। বিশ্রামাগারসহ সব জায়গায় অপেক্ষা করছেন যাত্রীরা। কেউ যাচ্ছেন একা, কেউ পরিবারসহ। সবাই ছুটছেন আপন গন্তব্যে। কিছুক্ষণ পরপর বাস স্ট্যান্ড থেকে যাত্রীবোঝাই বাস বেরিয়ে যাচ্ছে দূরপাল্লার গন্তব্যে। যদিও সরকারি নির্দেশ মেনে অনেক পরিবহনে ৫০ শতাংশ যাত্রী নিচ্ছে। এতে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ চাপ সামলাতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। আর যাত্রীরা বলছেন, দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও বাস পাওয়া যাচ্ছে না।
এসময় অপেক্ষমাণ অনেক যাত্রীদের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা দেখা গেছে। তাদের সঙ্গে মাস্ক থাকলেও সেটি যথাযথভাবে পরে থাকতে দেখা যায়নি। কারো মাস্ক ঝুলছে থুতনিতে, আবার কারোবা হাতে। করোনাভাইরাসের প্রভাব মুক্ত থাকতে বিশেষজ্ঞরা অন্তত তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে চলাচলের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডে একজন আরেকজনের সঙ্গেই লেপ্টে বসে থাকতে দেখা গেছে।
লকডাউনের খবরেই বাড়ি যাচ্ছেন কি না জানতে চাইলে দিনাজপুরগামী যাত্রী বলেন, ঢাকাতে ভাইয়া-ভাবির সঙ্গে থাকতাম। যেহেতু এখানে আপাতত কোনো কাজ নেই, তাই শুধু শুধু খরচ বাড়িয়ে লাভ নেই। আর লকডাউন কতদিন চলবে তারও কোনো ঠিক নেই।’ বাসের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করছিলেন শারমিন ইসলাম। পরিবারসহ তিনিও বাড়ির পথ ধরেছেন। এসময় তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। কাউন্টার থেকে বারবার বলছে অল্প সময়ের মধ্যে বাস আসবে। কিন্তু এখনও বাসের দেখা পাচ্ছি না। কখন যে বাস আসবে আর নড়াইলের পথ ধরব, সেটাই বুঝতে পারছি না।’ এছাড়া সায়দাবাদ টার্মিনালে লক্ষীপুরগামী সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘ঢাকা থেকে লক্ষীপুরের ভাড়া ৪০০ টাকা। সিটের ভাড়া ৬০ শতাংশ বেড়েছে। তারমানে ৬৪০ টাকা হওয়ার কথা। কাউন্টার বলছে টিকেট নাই। আর বø্যাকে বলছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় টিকিট আছে।’ তবে পরিবহন কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সরকারি নির্দেশনায় যাত্রী পরিবহন করতে হচ্ছে অর্ধেক আসনে, এ কারণেও যাত্রীর চাপ বেশি দেখা যাচ্ছে। যদি প্রতিটি বাসে ৪০ জন যাত্রী নিতে পারতাম তাহলে এখন যে যাত্রীর চাপ দেখছেন, সেটি দেখতেন না। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে যানজটের কারণে সঠিক সময়ে বাস দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
বাস কোম্পানির মালিক সমিতির সভাপতি খন্দকার রফিকুল হোসেন কাজল জানিয়েছেন, যারা লকডাউনকে সামনে রেখে শহর ছাড়ছেন তাদের বড় অংশটি দৈনিক ভিত্তিতে রোজগার করেন। ছোট ছোট ব্যবসা করেন এমন মানুষজন এবং দিন হিসেবে যাদের মজুরি হয়, তারাই বেশি যাচ্ছেন ঢাকা ছেড়ে।
এ বিষয়ে বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (আদালত ১০) মোহাম্মদ জোবায়ের আলম বলেন, ‘অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের জন্য দুটি পরিবহনকে জরিমানা করা হয়েছে। একটি হচ্ছে শুকতারা পরিবহন, অন্যটি এস বি লাইন। আমাদের টিম এখানে আছে। অভিযোগ পাওয়া মাত্রই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এখন পর্যন্ত আটটি মামলায় মোট ৬ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি বার বার বোঝানোর চেষ্টা করছি। আমরা যখন এখানে টহল দেই তখন সবকিছু ঠিকঠাকই থাকে। কিন্তু সরে যাওয়া মাত্রই তারা আবার এলোমেলো হয়ে যায়। এখন তাদের সচেতন হওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।’
গাবতলী বাস টার্মিনালে বিআরটিএ চেয়ারম্যান : ভাড়া বৃদ্ধি, যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধিসহ পরিস্থিতি দেখতে গতকাল দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার গাবতলী বাস টার্মিনালে আসেন। এ সময় তিনি বাস টার্মিনালে বিভিন্ন কাউন্টার ঘুরে ঘুরে দেখেন। রাস্তার চলমান বাস থামিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চলছে কি না তা পরিদর্শন করেন। যাত্রীদের পরামর্শ দেন কোনো অসুবিধা হলে এখানে থাকা ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
পরিদর্শন শেষে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘সরকারের ১৮ দফা নির্দেশনার একটি হচ্ছে- ৫০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে পরিবহন চলাচল করবে। সেই লক্ষ্যে ঢাকা সিটিতে আমাদের ৮ জন ম্যাজিস্ট্রেট বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করছে। এরমধ্যে তিন-চারটি টার্মিনালও কাভার করছে। বর্তমানে আমাদের শুক্রবার ও শনিবারেও মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে। শনিবার শুধু ঢাকা সিটিতেই ২৫টি মামলা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে গাবতলী বাস টার্মিনাল পরিদর্শন করে বিভিন্ন বাস কাউন্টার এবং যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেছি। সেখানে ভাড়া বৃদ্ধির তেমন কোনো অভিযোগ হয়নি। তিন-চারটা বাসে উঠে পরিদর্শন করেছি। সেখানে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখেছি কারো কোনো অভিযোগ নেই। সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে।
সদরঘাট : গতকাল সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঘুরে দেখা গেছে দক্ষিণ অঞ্চলের বিভিন্ন রুটের লঞ্চে ছিল ব্যাপক ভিড়। রোববার বিআইডব্লিউটিএ’র একজন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেছেন, ডেকে ও সিটে ৫০ শতাংশ যাত্রী ফাঁকা রাখার কথা থাকলেও ভিড়ের চাপ সামলাতে গিয়ে অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে পারেননি। ওই কর্মকর্তা বলেছেন, রোববারও সকাল থেকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ভিড় করতে শুরু করেছেন অনেকে। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের রুটগুলোর বেশিরভাগ লঞ্চ ছাড়ে সন্ধ্যার পর, যে কারণে তিনি বলছেন, এই ভিড় দুপুরের পর আরো বাড়বে। যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা করোনা লকডাউনে গ্রামে গেলে অন্তত খাওয়া থাকার সমস্যায় পড়বেন না। সে জন্যই গ্রামে ছুটছেন। বিআইডবিøউটিএ জানিয়েছে, সোমবার সকাল ৬টা থেকে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে।
বিমানবন্দর : ঢাকার অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ভিড় ছিল। লকডাউনের ফলে দীর্ঘ দিনের জন্য ছুটির প্রস্তুতি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন অনেকে। বিমান যাত্রার জন্য চেক-ইন লাইনে যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেখা যায়নি। মুখে মাস্ক থাকলেও, সামাজিক দূরত্ব রেখে লাইনে দাঁড়াতে দেখা যায়নি অনেককেই।
আমাদের গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, ঢাকা থেকে ফিরতে শুরু করেছে মানুষ করেছে মানুষ। কিন্তু পাটুরিয়া থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চগুলোতে দেখা যায় সাধারণ মানুষের উপচে পড়া ভিড়। তাদের সবার কাছ থেকেই নেয়া হয়েছে সরকার ঘোষিত ৬০ শতাংশ অতিরিক্ত ভাড়া। কিন্তু যাত্রী অভিযোগ স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করেই ঘাট কতৃপক্ষ সরকারী নির্দেশনা অমান্য করে লঞ্চে তুলছে অতিরিক্ত যাত্রী।
এ ব্যাপারে লঞ্চ মালিক সমিতির দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ম্যানেজার নুরুল আনোয়ার মিলন বলেন, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ১৮ টি লঞ্চ চলাচল করছে। আমরা সরকার ঘোষিত নিয়ম মেনেই ভাড়া আদায় করছি। কিন্তু সাধারণ মানুষ কোন স্বাস্থ্যবিধি মানতে চাচ্ছেন না। আমরা বললেও তারা শুনছে না।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আমিনুল ইসলাম জানান, সামাজিক দূরত্ব মেনে মাস্ক পরিহিত অবস্থায় যাতায়াতের নির্দেশনা রয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখে এর সত্যতা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আমাদের শিবচর (মাদারীপুর) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, সকাল থেকেই শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটে যাত্রী ও যানবাহনের চাপ বাড়তে থাকে। শিমুলিয়া থেকে এ চাপ আরো বেশি ছিল। দুপুরের পর ভীড় উপচেপড়ায় রুপ নেয়। বাড়তি ভাড়া গুণতে হচ্ছে প্রতিটি যানবাহন ও নৌযানেই। বাড়তি ভাড়া নির্ধারণের ফলে লঞ্চে যাত্রী প্রতি ভাড়া নেয়া হয় ৫৫ টাকা ও স্পীডবোটে ভাড়া নেয়া হয় ২শ’ টাকা করে। তারপরও আগের চেয়ে বেশি যাত্রী যানবাহন ও নৌযানগুলোতে।
এদিকে উভয় ঘাটেই যানবাহনের দীর্ঘ লাইন দেখা দিয়েছে। প্রতিটি যানবাহনকে দীর্ঘসময় ঘাটে আটকে থেকে পদ্মা নদী পাড়ি দিতে হচ্ছে। ফেরির জন্য অপেক্ষায় থাকা শাহিন মিয়া বলেন, ৩ ঘণ্টা ধরে বসে আছি। কখন পার হবো জানি না। ঘাটে অনেক ভিড়। ঢাকা থেকে বরিশালগামী যাত্রী খাদিজা বেগম বলেন, লকডাউনের কারণে ক্যান্সারের রোগী ঢাকার হাসপাতাল থেকে ফেরত দিল। তাই বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।
লঞ্চ যাত্রী আ. মালেক বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানতে ভাড়া বাড়ানো হলো। কিন্তু যাত্রীতো কম নেয়া হলো না। বাংলাবাজার ঘাটের বিআইডবিøউটিএর টার্মিনাল ইন্সপেক্টর মো. আক্তার হোসেন বলেন, আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু যাত্রীরা নিষেধ শুনছে না। আর বাড়তি ভাড়া নির্ধারণ করেছে সরকার আমার কি করার আছে?



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ