Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মালিকানায় কারা!

সদস্যদের চাঁদার টাকায় প্রতিষ্ঠিত বিজেএমইএ বিশ্ববিদ্যালয়

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০০ এএম

গত শতকের সত্তর দশকে এদেশের তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ। রফতানি প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা এই অর্জন দক্ষ জনশক্তির অভাবে অনেকটা সময় বিদেশীদের উপর নির্ভরশীল ছিল। যদিও বর্তমানে এই নির্ভরশীলতা কিছুটা কমেছে। তারপরও ২০ শতাংশ দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি নিয়েই চলছে দেশের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক খাত। এ সুযোগে পোশাক খাতে কয়েক হাজার বিদেশি শ্রমিক কাজ করছেন। প্রতিবছর প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা দেশে নিয়ে যাচ্ছেন এসব বিদেশি শ্রমিক।

এরই ধারাবাহিকতায় দেশের তৈরি পোশাক শিল্পখাতের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এ খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভ‚ত হয়। এ তাগিদ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে ১৯৯৯ সালে বিজিএমইএ’র তৎকালীন সভাপতি আনিসুর রহমান সিনহা এ খাতের জন্য একটি ইন্সটিটিউট গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা জানান। একই বছর উত্তরাতে বিজিএমইএ’র টাকায় একটি ভবনের ফ্লোর ভাড়া নিয়ে বিজিএইএ ইন্সটিটিউট অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি (বিআইএফটি) চালু করেন এবং পরিচালনার সকল খরচাদি বিজিএমইএ বহন করে। প্রথমদিকে বিভিন্ন কারখানার মালিক এ প্রতিষ্ঠানে কিছু মেশিন-পত্র সরবরাহ করেন। পোশাক খাতের বড় উদ্যোক্তা হারুন অর রশিদকে এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান করা হয় এবং স্কটল্যান্ডের একজন ফ্যাশন ডিজাইনার প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন। সারাদেশের গার্মেন্টস মালিকদের টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এই বিজিএইএ ইন্সটিটিউট অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি (বিআইএফটি), যেখানে ফ্যাশন ডিজাইন এর উপর স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করা হতো এবং এটা ছিল বিজিএমইএ’র একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। সিদ্ধান্ত ছিল এর সার্বিক পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানে বিজিএমই’র পরিচালনা পরিষদে যখন যারা থাকবেন তারাই দায়িত্ব পালন করবেন এবং বিজিএমইএ’র মত বিআইএফটিও গার্মেন্টস মালিকদের প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিবেচিত হবে।

যদিও ২০০৭ সাল থেকে সরকারের একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল ঢাকা শহরে আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হবে না। কিন্তু ২০১২ সালের মার্চ মাসে এটি অনুমোদনের ক্ষেত্রে ওই সময়ে শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন বিজেএমইএ’র প্রস্তাবনা আলাদা বিবেচনা পায়। অনুমোদনের বিষয়ে ওই সময়ে কারণ হিসেবে বলা হয়, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি যে ধরণের গ্রাজুয়েট তৈরি করবে, সে ধরণের জনশক্তি বিদেশ থেকে ‘ভাড়া’ করতে হয়। এতে বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশে চলে যায়। আর তাই ওই সময়ে সকল শর্ত পূরণ না হলেও বিশেষ কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়।

সূত্র মতে, এই প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করে এবং পর্যায়ক্রমে তুরাগের নিশাত নগরে বিআইএফটির নামে ৬ বিঘা জমি ক্রয় করা হয় এবং রাজউক থেকে প্ল্যান পাশ করে সু-উচ্চ ভবন তৈরি করা হয়। এই জমি কেনা ও বিল্ডিং তৈরি করতে বিআইএফটির নিজস্ব তহবিল হতে এবং বিজিএমইএ সমভাবে টাকার যোগান দেয়।

সূত্র জানায়, পরবর্তীতে এই বিআইএফটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার জন্য আবেদন করা হয় এবং সে অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ক্রমে বিজিএইএ ইনসটিটিউট অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি (বিআইএফটি) এর নতুন নামকরণ হয় বিজিএইএ ইউনিভারসিটি অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি (বিইউএফটি)।

বিজিএমইএ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এই ইউনিভারসিটিতে উন্নীত করণের সময় বিজিএমইএ তথা গার্মেন্টস মালিকদেরকে (বিজিএমই এর সদস্য) কোনরূপ অবহিত না করে অতি গোপনীয়ভাবে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী নিজেরা নয় জন নিজ নিজ নামে ও পরিচয়ে বিইউএফটির ট্রাস্ট্রি বোর্ডের সদস্য হয়ে যান এবং পুরো বিইউএফটির মালিক বনে যান। যদিও সিদ্ধান্ত ছিল যেহেতু বিজিএমইএ’র মত বিআইএফটি বা বিইউএফটিও সাধারন গার্মেন্টস মালিকদের টাকায় গড়া প্রতিষ্ঠান তাই বিজিএমইএ’র মতই যখন যারা নেতৃত্বে আসবেন তারাই এই বিইউএফটি’র ট্রাস্ট্রি বোর্ডের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন কিন্তু বাস্তবে মালিক বনে যান এই প্রভাবশালী স্বার্থান্বেষী গ্রæপ। এরা হলেন- মুজাফফর উদ্দিন সিদ্দিক (চেয়ারম্যান), আব্দুস সালাম মুর্শেদি, টিপু মুন্সি, নাসির উদ্দিন চৌধুরী, শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন), ফারুখ হাসান, সিদ্দিকুর রহমান, এস এম মান্নান (কচি), রিয়াজ-বিন-মাহমুদ। পরবর্তীতে ট্রাস্ট্র্রি বোর্ডে আরও ১২ জনকে যুক্ত করা হয়। এরা হলেন- সালাহউদ্দিন আহমেদ, মো. আতিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ নাসির, কুতুবুদ্দিন আহমেদ, আরশাদ জামাল (দিপু), খোন্দকার রফিকুল ইসলাম, মশিউল আলম (সজল), রফিকুল ইসলাম, মো. মহিদুল ইসলাম খান, মো. সাজ্জাদুর রহমান মৃধা, মো. জাকির হোসেন, আবদুল্লাহ হিল রাকিব। বিইউএফটি পরিচালনায় এদের সমন্বয়ে যে ট্রাস্ট্রি বোর্ড গঠন করা হয়েছে সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট-১৮৬০ অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন করা।

এই ২১ সদস্য বিশিষ্ট ট্রাস্ট্রি বোর্ড গঠনের পর থেকে বিইউএফটির কোন আয়-ব্যায়ের হিসাব বিজিএমইএ’র কোন সদস্য তথা গার্মেন্টস মালিকদের অবহিত করা হয় না। যদিও বিইউএফটি উন্নিত হয়েছে বিআইএফটি থেকে এবং বিইউএফটি ও বিআইএফটির নামে কেনা জমি ও বিল্ডিং ব্যবহার করছে কিন্তু এর জন্য বিজিএমইকে কোন ভাড়া বা কিছুই প্রদান করে না। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা বিজিএমইএ’র সদস্য গার্মেন্টস মালিকদের থাকার কথা থাকলেও এখন দখল নিয়েছে এই ২১ জন ট্রাস্ট্রি সদস্য। তারা সবাই তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র প্রভাবশালী নেতা অথচ সাধারণ সদস্যরা জানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা বিজিএমইএ। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদের পরিমান কয়েকশ’ কোটি টাকা।

সর্বশেষ ২০১৯ সালে বিজিএমইএ’র তৎকালীন সেক্রেটারি এ কে এম ফজলুর রহমান বিইউএফটির রেজিস্ট্রারের কাছে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দেন। এতে তিনি কয়েকটি তথ্য জানতে চান। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিইউএফটির মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেলস অব এসোসিয়েশন, ট্রাস্ট্র্রি বোর্ডের সদস্যদের সাথে বিইউএফটির চুক্তির কপি এবং বিইউএফটি ট্রাস্ট্র্রি সদস্যদের নামের তালিকা। জানা গেছে, এ চিঠি বিইউএফটিতে যাবার পর ট্রাস্ট্র্রি বোর্ডের একজন সদস্য বিজিএমইএ কর্মকর্তাদের হুমকি দেন এই বলে, ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রচেষ্টা করলে চরম মূল্য দিতে হবে। বিজিএমইএ’র একজন সাধারণ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইনকিলাবকে বলেন, সাধারণ সদস্যদের চাঁদার টাকা দিয়ে এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়। এতদিন আমরা নিজেদেরকে এ প্রতিষ্ঠানের মালিক দাবি করতাম। কিন্তু এখন দেখি বিষয়টি পুরোপুরি উল্টো। এর মালিক বিজেএমইএ নয়; একটি গ্রæপ। যারা আবার দীর্ঘদিন এই সেক্টরের অভিভাবক বনে গিয়ে নিজেদেরকে হৃষ্টপুষ্ট করেছেন। অনেকে আবার সুযোগ নিয়ে সংসদ সদস্যও হয়েছেন।

বিজেএমইএ’র অপর একজন সদস্য বলেন, ট্রাস্ট্র্রি বোর্ডের অনেক সদস্য এ ইউনিভার্সিটির মাধ্যমে তাদের নিজেদের অবস্থার উন্নতি করেছেন। কিন্তু সাধারণ সদস্যদের কথা একবারও ভাবেননি।
সূত্র মতে, বর্তমানে সারাদেশে বিজিএমইএ’র সদস্যসংখ্যা দুই হাজার তিনশ’ ১৪ জন। কারখানার মান অনুসারে প্রতি কারখানা বিজিএমইএকে বছরে ৫ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। মূলতঃ এ চাঁদার টাকা দিয়েই বিইউএফটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো।

তবে বিজিএমইএ’র সর্বশেষ দায়িত্ব পালনকরা কমিটির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিইউএফটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো সদস্যদের টাকায়। কিন্তু এখন এর ফল ভোগ করছে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল। এটির মালিকানা এখন বিজিএমইএ’র হাতে নেই। এমনকি এ প্রতিষ্ঠানের কোন কর্মকান্ড বিজিএমইএ এবং সাধারণ গার্মেন্টস মালিকদের সাথে শেয়ার করা হয় না।

উল্লেখ্য, শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিইউএফটির কার্যক্রম তুরাগের নিশাতনগরে বিআইএফটি’র ভবনে পরিচালিত হচ্ছে। যার জন্য বিজিএমইকে কোনরূপ ভাড়া প্রদান করা হয় না। এখানে ফ্যাশন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, বিবিএ, এনভায়রানমেন্টাল সায়েন্স এর ওপর উচ্চতর ডিগ্রি দেয়া হয়। এছাড়া ছয়মাস, চারমাস এবং তিনমাসের বিভিন্ন শর্ট কোর্সের ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিজেএমইএ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ