দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (স.) এই পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে মহান, সুন্দর ও মার্জিত স্বভাবের প্রতিচ্ছবি। বর্তমান অশান্ত বিশ্বকে শান্তকরতে হযরত মোহাম্মদ (স.) এর আদর্শ ও নির্দেশাবলী অনুসরণ ও পালন একান্ত আবশ্যক। বিখ্যাত ইংরেজ লেখক বার্নাড শ বলেছিলেন, ‘বর্তমান অশান্ত বিশ্বে হযরত মোহাম্মদ (দঃ) জীবিত থাকলে এক কাপ কফি পান করতে যে সময় ব্যয় হয়, এই সময়টুকুর মধ্যে বিশ্বের তাবৎ সমস্যাবলীর সমাধান দিতে সক্ষম হতেন।’ আসুন আমরা বিশ্ব নবী (স.) ও তাঁর চরিত্রশোভার উপর সামান্য আলোকপাত করি। পবিত্র ক্বোরআনে আল্লাহতা’লা বর্ণনা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি তো মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ হাদিসে বর্ণিত হযরত মোহাম্মদ (স.) স্বয়ং বলেছেন, ‘শিষ্টাচার, মার্জিত আচরণ ও উত্তম চরিত্রসমূহের সমাপন ও পরিপূরণের উদ্দেশ্যে আমি প্রেরিত হয়েছি।’’ বিশ্বনবীর চরিত্র ছিল কোমল ও উদার। পরনিন্দা, অশ্লীল ও অশিষ্ট বাক্য তাঁর পবিত্র মুখ থেকে কখনো নিঃসৃত হয়নি। তিনি কারো মনে কষ্ট দিতেন না, কারো সাথে অভদ্র আচরণ করতেন না। এমনকি উচ্চস্বরে বা শোরগোল করে কথা বলতেন না। হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত আছে, হযরত মোহাম্মদ (স.) সাহাবীদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে কথা বলতেন। এমনকি তাদের মনোরঞ্জনের জন্য মাঝে মধ্যে হাসি-উপহাস করতেন (কৌতুক)। তিনি বলতেন, ‘বাস্তব কৌতুকে কোন দোষ নেই। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, হযরত মোহাম্মদ (স.) প্রফুল্লচিত্ত, উদার ও হাস্যরসপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। হযরতের ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিল অসাধারণ গাম্ভীর্য। তাঁর হাস্য-কৌতুক ছিল অর্থপূর্ণ। একদা তিনি তাঁর ফুফু হযরত সুফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বুড়ো মহিলারা জান্নাতে যেতে পারবে না। একথা শুনে সুফিয়া কাদতে লাগলেন, পরে নবী করীম (স.) এর ব্যাখ্যা দিলে তিনি শান্ত হলেন। হযরতের এ কৌতুকও অর্থপূর্ণ ছিল। কারণ আল্লাহতা’লা বলেছেন, যারা জান্নাতবাসী হবে, তারা সবাই যুবক-যুবতী হবে। এভাবে হযরত বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে অর্থপূর্ণ মন্তব্য করে থাকতেন যার বর্ণনা এ স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব হবে না। হযরত (স.) তিনটি কাজ থেকে নিজেকে সব সময় বিরত রাখতেন- ১) লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কোন কাজ করা, ২) অহংকার করা, ৩) অনর্থক কিছু করা বা বলা। এগুলো হযরতের স্বভাব বিরুদ্ধে ছিল। কারো মনে অহেতুক আঘাত দেয়া, কারো প্রতি জোর-জুলুম করাকে হযরত (স.) পাপ ও অপরাধ বলে গণ্য করতেন। হযরত (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আপনার সহিত সম্বন্ধ ছিন্ন করবে, আপনি তার সাথে সম্বন্ধ জুড়বেন, আর যে আপনাকে বঞ্চিত করবে আপনি তাকে দান করবেন, অনুগ্রহ করবেন। যে ব্যক্তি আপনার সহিত দুর্ব্যবহার করবে আপনি তাকে ক্ষমা করবেন ও সৎ ব্যবহার করবেন। এ গুণাবলী না থাকলে একজন প্রকৃত মুমিন হতে পারবেন না। মহানবী (স.) দয়া, ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার উদাহরণস্বরূপ আমাদের সম্মুখে এসেছিলেন। যে সব কথাবার্তায় সওয়াব আশা করা যায় না, এমন কথা তিনি কখনো বলতেন না। কোনো ব্যক্তি কর্কশ প্রশ্ন ও অসঙ্গত আচরণ করলে মহানবী (স.) ধৈর্যের সঙ্গে তা সহ্য করতেন। তিনি ছিলেন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার প্রতীক। হযরত মোহাম্মদ (স.) নিজের জন্য কখনো রাগ করতেন না এবং প্রতিশোধও গ্রহণ করতেন না। তবে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য রাগান্বিত হতেন, এমনকি শাস্তিও প্রদান করতেন। হযরত মোহাম্মদ (স.) মানুষের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখতেন, ছিদ্রান্বেষণ তিনি পছন্দ করতেন না। কেউ মানুষের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ালে তিনি বাধা দিতেন। যে মানুষের দোষ ত্রুটি গোপন রাখে আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন।
হযরত মোহাম্মদ (স.) এর স্বভাব ছিল কোমল। চিত্ত ছিল প্রশস্ত ব্যবহার ছিল উদার। যে কেউ তাঁকে (স.) সাহায্যের জন্য আহবান জানালে তিনি সে আহবানে সাড়া দিতেন। তাদের সাহায্যে এগিয়ে যেতেন। তিনি সবার সাথে খোলাখুলিভাবে মিশতেন। বিশেষ করে শিশুদের সাথে তার ব্যবহার ছিল উদার। হাস্য-পরিহাস করতেন ও মনের মতো ভালোবাসতেন শিশুদের। তাঁর কোনো অহংকার ছিল না। যে কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনি আগন্তুককে সালাম প্রদান করতেন এবং সাক্ষাৎকারী হাত মিলালে স্বেচ্ছায় হাত সরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত তিনি হাত সরাতেন না। রাসুল (স.) সাহাবাদের সম্মুখেও কোন দিন পা লম্বা করে বসেননি। যে ব্যক্তি যতটুকু সম্মানের অধিকারী তাঁকে ততটুকু সম্মান প্রদান করতেন। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে নিজ ঘরের বিভিন্ন কাজ পর্যন্ত নিজের হাতে করতেন। এমনকি কোনো কোনো সময় নিজের জুতো ছিঁড়ে গেলে নিজেই সেলাই করে ব্যবহার করতেন।
হযরত মোহাম্মদ (স.) বাজার থেকে নিজ প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করে তা বহন করে আনতেন। তিনি সুগন্ধ দ্রব্য ভালবাসতেন এবং এর ব্যবহারে অন্যদেরও উৎসাহিত করতেন। পার্থিব সম্পদের প্রতি হযরতের (স.) কোনো ধরণের মোহ বা আকর্ষণ ছিল না। নিজে স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে অতি সাধারণ থেকে সাধারণভাবে জীবন-যাপন করতেন। অনেকদিন তাঁকে উপবাসে থাকতে হয়েছে। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (স.) দয়া, করুণা ও ক্ষমার প্রতিচ্ছবি। তাঁর ওপর শারীরিক ও মানসিকভাবে সারা জীবন আঘাত ও অপমান করা হলেও তিনি কাউকে ভৎসর্না করেননি এবং বদদোয়া (অভিশাপ) দেননি। সবাইকে তিনি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন। আর এ জন্যই তাঁকে (স.) রহমতুল্লিল আলমিন বলে অভিহিত করা হয়। বিশ্বনবী (স.) কোনো কাল বা সময়ের নবী নন। তিনি বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহানবী এবং তিনিই শেষ নবী। বিশ্বনবীর মহান চরিত্রের আকর্ষণেই সারা বিশ্ববাসী মুগ্ধ। সারা বিশ্বের জন্য তিনি উত্তম আদর্শ।
হযরত মোহাম্মদ (স.) আমাদের মতো সাধারণ মানুষ নন। স্বয়ং আল্লাহতা’লা হাদিসে কুদসিতে বলেছেন- ‘হে বন্ধু, আপনাকে সৃষ্টি না করলে আমি এই পৃথিবী সৃষ্টি করতাম না।’ হযরত মোহাম্মদ (স.) দুনিয়ায় উম্মতের জন্য কেঁদেছেন, কবরে কাঁদছেন এবং হাসরেও কাঁদবেন। উম্মতের স্নেহে মাকামে মাহমুদে না গিয়ে মাটির কবরে আরাম করেছেন সেই প্রিয় নবীকে কি ভুলতে পারা যায়? আসুন আজকের এ মুহূর্তে আমরা শপথ নিই হযরত মোহাম্মদ (স.) আদর্শকে পাথেয় করে জীবনকে অতিবাহিত করব। তার জীবনাদর্শ হোক আমাদের ব্যক্তি, পরিবার ,সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় মূল আদর্শ। আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের এ প্রার্থনা কবুল করেন। আমিন।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।