Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মওলানা ভাসানীর ভূমিকায় বেগম জিয়া অবতীর্ণ হতে পারবেন কি?

প্রকাশের সময় : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন
ভারত বিভক্তির আগে লাইন প্রথার মাধ্যমে আসাম থেকে মুসলিম খেদাও অভিযান শুরু হয়। রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে নেতারা অনীহা দেখায়। কিন্তু মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী গর্জে ওঠেন। গ্রেফতার হয়ে জেল খাটেন। তারপরও মুসলিম খেদাও আইন পরিবর্তন করতে বাধ্য করেন। তারপর আইয়ুবের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। আইয়ুববিরোধী মিছিলে যোগ দেয় জামায়াত। রুশ-হিন্দুস্থানের পদলেহনকারীদের নেতা গিয়ে মজলুম জনতার নেতাকে বলেন, জামায়াত মিছিলে অংশগ্রহণ করেছে। মওলানা তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের পক্ষে আসবে যারা তারাই জনতার পক্ষে! সেদিন রুশ-হিন্দুস্থানের তল্পিবাহকরা হুজুরের ওপর নাখোশ হয়েছে এমন ভাব দেখিয়ে আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকে পিছু হটে।
গণতন্ত্র, ইনসাফ বা ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৫০ সালেই পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য স্বাধীনতার ডাক দেন মওলানা ভাসানী। ১৯৭০ সালে দক্ষিণ বাংলায় ঘূর্ণিঝড়ে ল-ভ- করে দেওয়া অসহায় জনতাকে দেখে ঢাকায় ফিরে তিনি ঘোষণা দেন, ভোটের বাক্সে লাথি মারো, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন কর। ১৯৭১-এর মার্চে আবারো কোনো রাখঢাক না করে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরার আহ্বান জানান। হঠাৎ করে যখন পাকিস্তানি সেনারা রাতের অন্ধকারে নিরীহ জনতার হত্যার লীলা খেলা শুরু করে তখন চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কর্তব্য পালনকারী মেজর জিয়া তার পরিবারের কথা চিন্তা না করেই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে গিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, ‘আমরা বিদ্রোহ করেছি’। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অগণিত জাতির লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ অবস্থান করে নেয়।
মজলুম জনতার নেতা তখন হিন্দুস্থান সরকারের কাছে কার্যত গৃহবন্দি। ২২ জানুয়ারি ১৯৭২ মজলুম জননেতা গৃহবন্দি থেকে মুক্ত হয়ে তার স্বপ্নের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে বিনা পাসপোর্টে প্রবেশ করেন। এবার তিনি বললেন, পিন্ডির দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে দিল্লির পদলেহন করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি জনগণকে হিন্দুস্থানের শাসকদের থেকে সাবধান থাকার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু দিল্লি এ দেশের শান্তিপ্রিয় জনতার ঘুম হারাম করে দিতে ব্যাংক লুট, হত্যা, খুন, গুম, অপহরণসহ নানা অপকর্মে মদদ দিতে শুরু করে। মজলুম জননেতা স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিবাদ করতে শুরু করলে অবশেষে তাকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে নিয়ে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ইতোমধ্যে হিন্দুস্থান সরকার পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালুর অনুমতি নিয়ে নেয়।
৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ সিপাহি জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে মজলুম জনতার নেতা মওলানা ভাসানীসহ স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ মুক্ত নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পায়, দেশে ফিরে আসে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। এক আল্লাহতায়ালার ওপর আস্থা ও বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম সংবিধানে সংযোজন করায় শয়তানের অনুসারীরা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার পরিকল্পনা শুরু করে। ৩০ মে রাতে চট্টগ্রামে তাদের ষড়যন্ত্র সফল হলেও জনতা জিয়ার পক্ষে রাজপথে নেমে আসে। শয়তানের অনুসারীরা আবার ঘাপটি মারে। এবার তাদের প্রভুরা মাদক দিয়ে যুব সমাজকে ধ্বংস করতে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় ফেনসিডিল কারখানা, হিরোইন, ইয়াবাসহ ক্ষতিকর মাদকদ্রব্যের বাজার বসিয়ে তারা বাংলাদেশে বাজারজাত করতে শুরু করে। এ নেশার জগৎ তেমন কোনো মেধাবী তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন দেশপ্রেমিক ছাত্র যুবক, রাজনীতিবিদদের মাদকে আসক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে কৌশল পরিবর্তন করে।
ইতোমধ্যে ট্রানজিট, পায়রা বন্দর, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের নামে আল্লাহ প্রদত্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সুন্দরবন ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে মাতে। ইতোমধ্যে ট্রানজিট নিয়েছে আর হিন্দুস্থানের ওপর দিয়ে বয়ে আসা নদীর পানির প্রবাহ পরিবর্তন করেছে। টিপাইমুখে বাঁধ দেওয়ার কাজ প্রায় শেষ। জনগণের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছে বিচার বিভাগ ন্যায়বিচার করতে পারে না। যদি তাই না হবে, অপহরণ হচ্ছে, পরে লাশ পাওয়া যাচ্ছে! কিংবা বন্দুকযুদ্ধে হত্যা হচ্ছে। সর্বোচ্চ আদালত স্বপ্রণোদিতভাবে জনতার জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিতেও পারছে না কেন এ প্রশ্ন জনমনে দেখা দিয়েছে! সাদা পোশাকে পুলিশের পরিচয়ে সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মেধাবী ছাত্র, যুবক রাজনীতিক অপহরণের পর যত্রতত্র হত্যা করে ফেলে রাখা হচ্ছে। অথচ, পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা বন্ধে তৎপর এমন সংবাদ পাওয়া যায় না।
ভারতবর্ষ বিভক্তির আগে ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ যেভাবে মুসলিম নিধন করা হয়েছিল এখন নতুন কৌশলে একই কায়দায় হত্যা করতে শুরু করা হয়েছে। ২১ আগস্টের হত্যাকা-, পল্টনে লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যাকা- ও প্রধান বিচারপতির খাসকামড়ায় হামলার উদ্দেশ্যে অভিন্ন, শুধু কৌশল পরিবর্তন মাত্র। এসব বর্বোচিত ঘটনার বিচারের নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের শায়েস্তা করতে চাইলে সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে পারে। এখন বিচার বিভাগই পারে ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে হত্যা, খুন, গুম, অপহরণ, বন্দুকযুদ্ধ বন্ধ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে মিথ্যা মামলায় হয়রানি থেকে মুক্তি দিতে।
ভারতের ১৯৩৫ সালের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী ১৯৩৭ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৭ সালের পহেলা জুলাই থেকে ১৯৩৯ সালের নভেম্বর/২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত কংগ্রেস প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় ক্ষমতাসীন ছিল। কংগ্রেস শাসনামলে উপমহাদেশের মুসলমানরা যে তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল সেটাই পরবর্তীকালে স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। দুই বছরকাল স্থায়ী কংগ্রেসি মন্ত্রিসভার মেয়াদে বিশটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়। ফয়েজবাদের টান্ডা নামক ছোট শহরে ২০ জন মুসলমান পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। ২০০ জন মুসলমানকে শিকলে বেঁধে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরানো হয়। এমনকি মসজিদের মধ্যে প্রবেশ করে তাদের দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়। মধ্য প্রদেশের চাঁদপুরে চারশ মুসলমানকে দড়ি দিয়ে পা বেঁধে টেনেহেঁচড়ে আদালতে হাজির করানো হয়। সরকারি কর্তৃপক্ষ ১৫০ জন নরনারী ও শিশুর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। দুজন মুসলমানকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয় এবং ২৪ জনকে দেয়া হয় দীপান্তর। আজকে স্বাধীন বাংলাদেশের অবস্থার সাথে তুলনা করলে মুসলমানদের দুর্ভোগের কোনো পরিবর্তন হয়েছে এমন দাবি করা কি যাবে?
তাছাড়াও বর্তমানে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের মূল লক্ষ্য কি পরিবর্তন হয়েছে? বাংলাদেশ যে সাম্প্রদায়িক নয় রাজধানীর উত্তরায় যেখানে ঈদের নামাজ হয়, তার পাশেই মূর্তি পূজা হচ্ছেÑ এটা কি সেই সত্যের বহিঃপ্রকাশ নয়? জনতার দোরগোড়ায় চিকিৎসাসেবা পৌঁছিয়ে দিতে যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে এক টকশোতে হিন্দুস্থানের আচরণ সম্পর্কে বক্তব্যে সঞ্চালক বাধাদানে কী প্রমাণ করে তা কারো বুঝতে কষ্ট হয় না। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, স্বাধীনতা পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবকে হিন্দুস্থানের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেখানকার বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে গেলে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব বলেন, আমরা মুসলমান(!) আজকের ক্ষমতাসীনরা তা ভুলে যাওয়ায় দেশে হত্যা, খুন, গুম, সন্ত্রাস, অপহরণ, বন্দুকযুদ্ধে মানুষ হত্যা ও জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে শুধু ২০ দলের সভানেত্রী নয়, বরং সবার নেত্রী হতে হবে। তাছাড়াও নেত্রীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এককভাবে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর মতো জনতাই তার সুখ-দুঃখের সাথী আর জনতাই হবে আল্লাহপাকের পরে তার একমাত্র ভরসাস্থল। রুশ-হিন্দুস্থান-মার্কিন, ইইউ ও জাতিসংঘ এখন ফ্যাসিবাদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ মদদ দিচ্ছে, তাই তাদের দারস্থ হলে মুক্তি আসবে না। সারা দেশে হত্যা, খুন, গুম, অপহরণ, বন্দুকযুদ্ধে হত্যাÑ এ দেখে মনে হয় জঙ্গি নাটকের পরিকল্পনাকারীদের আরেকটি চক্রান্ত। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে যারা দেশের মেধাবীদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে ব্যর্থ হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা হারাবে। এদিকে শ্রমিক তার পারিশ্রমিকের দাবি করতে গেলে পুলিশের গুলি খায়। জঙ্গি আস্তানার নামে বিভিন্ন প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কাদের স্বার্থে ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে? ইসলামী বইপুস্তককে জঙ্গি বইপুস্তক হিসেবে চিহ্নিত করার পিছনেই বা কি রহস্য নিহিত? তাহলে কি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করাই মূল উদ্দেশ্য?
ষ লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক অ্যাসোসিয়েশন (বামসাএ)



 

Show all comments
  • Md iqbal ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ৯:০২ এএম says : 0
    তথ্যনির্ভর সুন্দর উপস্থাপনের জন্য লেখককে সাধুবাদ জানাই৷
    Total Reply(0) Reply
  • Niamot ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১০:৪৩ এএম says : 0
    ঘরে বসে রাজনীতি হয় না...
    Total Reply(0) Reply
  • Rahmat Ullah ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১০:৪৬ এএম says : 0
    কার সাথে কার তুলনা ?
    Total Reply(0) Reply
  • হুমায়ন কবির ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:৩৩ পিএম says : 0
    বিএনপি ও বেগম জিয়ার এই কথাটা বোঝা উচিত যে, রুশ-হিন্দুস্থান-মার্কিন, ইইউ ও জাতিসংঘ এখন ফ্যাসিবাদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ মদদ দিচ্ছে, তাই তাদের দারস্থ হলে মুক্তি আসবে না।
    Total Reply(0) Reply
  • মারুফ ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:৩৬ পিএম says : 1
    আজ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন। এটা রক্ষায় শুধু বেগম জিয়া নয়, সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • আশরাফুল ইসলাম ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:৩৭ পিএম says : 0
    আশা করি, খালেদা জিয়া ও বিএনপির নীতিনির্ধারনী মহল এই লেখাটি পড়বেন এবং বিষয়গুলো অনুধাবন করবেন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মওলানা ভাসানীর ভূমিকায় বেগম জিয়া অবতীর্ণ হতে পারবেন কি?
আরও পড়ুন