Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খতমে নবুওয়ত ইসলামের মৌলিক আকিদা

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২৫ মার্চ, ২০২১, ১২:০২ এএম

আল্লাহর একত্ববাদ ও পরকালে বিশ্বাসী হওয়ার পর ইসলামের মৌলিক আকিদা-বিশ্বাস যে সকল বিষয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তার গুরুত্বপূর্ণ একটি আকিদা হলো ‘আকিদায়ে খতমে নবুওয়ত বা খতমে নবুওয়ত সম্পর্কে আকিদা’। অর্থাৎ নবুওয়ত ও রেসালাতের পবিত্র ধারা সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের মাধ্যমে পূর্ণ হয়ে গেছে। তাঁর পরে আর কেউ নবী হবে না, আর কারোর ওপর অহিও অবতীর্ণ হবে না। এমনকি কারো ওপর এমন কোনো ইলহামও হবে না, যা দীনের ব্যাপারে প্রমাণ হতে পারে। ইসলামের এ আকিদাই ‘খতমে নবুওয়ত’ নামে প্রসিদ্ধ। তাওহিদ, রেসালাত, আখেরাত, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, কোরআন, কেবলা, ইত্যাদি বিষয় যে পর্যায়ের অকাট্য ও সন্দেহাতীত দলিল দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত, খতমে নবুওয়ত তথা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শেষ নবী হওয়ার আকিদাও অনুরূপ দলিল দ্বারা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত। এজন্যই তাওহিদ, রেসালাত, আখেরাত, নামাজ, হজ, জাকাত, কোরআন, ইত্যাদির অস্বীকারকারী যেমন স্পষ্ট কাফের, তেমনি খতমে নবুওয়ত অস্বীকারকারী এবং অবিশ্বাসীরাও কাফের। হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল- এ বিশ্বাস যেমন অকাট্য, তেমনি তিনি শেষ নবী, তাঁর পরে কেয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবী নেই- এ বিশ্বাসও অকাট্য। খতমে নবুওয়ত সরাসরি অস্বীকার করা হোক কিংবা অপব্যাখ্যার অন্তরালে করা হোক- সর্বাবস্থায় তা কুফর বলে গণ্য। এজন্য ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) নবুওয়তের দাবিদার মুসাইলামা ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। যদিও তারা মৌলিকভাবে তাওহিদ ও রেসালাতে বিশ্বাসী ছিলো। শুধু নবুওয়তের দাবি তোলার কারণেই সাহাবায়ে কেরাম (রা.) তাদের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং তাদের কঠোর হস্তে দমন করেছেন। রাসুল (সা.)-এর জমানা থেকে এ পর্যন্ত গোটা উম্মত কোনো ধরনের ন্যূনতম বিবাদ ও মতনৈক্য ছাড়াই এ আকিদাকে ইমানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে মেনে আসছে। কোরআনে কারিমের বহু আয়াত এবং রাসুল (সা.)-এর অসংখ্য হাদিস এ ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করে। পূর্বে এক নবীর পর আরেক নবী আগমনের প্রয়োজন এ কারণে দেখা দিয়েছে, পূর্বের নবী সাময়িক ছিলেন বা বিশেষ কোনো ভূখন্ডের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন বা নবী তার সাহায্যার্থে আল্লাহর কাছে কোনো নবী চেয়ে নিয়েছিলেন অথবা পূর্ববর্তী নবীর শিক্ষা বিকৃত বা পরিবর্তনের শিকার হয়েছিলো কিংবা পূর্ববর্তী নবীর শিক্ষা অপূর্ণ ছিলো। আমাদের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের পর এ ধরনের কোনো প্রয়োজন দেখা দেয়নি; দেবেও না।

যুগে যুগে নবুওয়তের দাবিদার ও তাদের ফলাফল
ইতিহাসের পাতায় তাকালে আমরা দেখতে পাই, যুগে যুগে যারাই নবুওয়তের দাবিদার হয়েছে, তারা নিজেকে মুসলমানরূপে প্রকাশ করে স্বীয় দাবি প্রচারের চেষ্টা করেছে। কিন্তু উম্মতে মুহাম্মদি এ ব্যাপারে কোরআন-হাদিসের দিক-নির্দেশনাপ্রাপ্ত হওয়ায় যখনই নবুওয়তের কোনো ভন্ড দাবিদার আত্মপ্রকাশ করেছে, তাকে কাফের সাব্যস্ত করেছে এবং ইসলামের গন্ডি থেকে বহিষ্কার করেছে। নববি যুগ থেকে যখনই কোনো ইসলামি রাষ্ট্রে বা ইসলামি আদালতে এ ধরনের মামলা উপস্থিত হয়েছে, তখনই বিচারকগণ তার দাবির স্বপক্ষে কোনো প্রকার দলিল-প্রমাণ তলব না করে তার ব্যাপারে কাফের হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। যেমন- আসওয়াদ আনাসি, তুলাইহা, সাজাহ, হারেস। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) তাদের কুফুরির ফয়সালা দেওয়ার পূর্বে কখনও নবুওয়তের দাবির ব্যাপারে তাদের থেকে কোনো প্রকার দলিলও তলব করেননি। যখনই কারো পক্ষ থেকে নবুওয়তের দাবির স্বপক্ষে প্রমাণ পাওয়া গেছে, তখনই সর্বসম্মতিক্রমে তাকে কাফের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর কারণ হলো, খতমে নবুওয়তের আকিদা এতোটাই স্পষ্ট ও সর্বজন স্বীকৃত, এর খেলাফ যুক্তি-তর্ক সব প্রতারণার শামিল। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) উম্মতকে পূর্বেই অবগত করে গেছেন। যদি এ ধরনের সামান্য অবকাশ দেওয়া হয়, তাহলে তাওহিদ-আখেরাতসহ ইসলামের কোনো আকিদাই আর নিরাপদ থাকবে না। তাই কেউ যদি খতমে নবুওয়তের এই অপব্যাখ্যা দেওয়া আরম্ভ করে, ‘তাশরিঈ’ তথা শরিয়তধারী নবুওয়ত আসবে না; তবে ‘গায়রে তাশরিঈ’ তথা শরিয়তহীন নবুওয়ত এখনও আসতে পারে, তাহলে তার এ কথা এমনই হবে, যেমন কেউ দাবি করলো, তাওহিদের আকিদানুযায়ী বড় খোদা শুধু এক সত্তাই, কিন্তু ছোট ছোট মাবুদ অনেক হতে পারে এবং তারা সকলেই উপাসনার উপযুক্ত। (নাউজুবিল্লাহ)। যদি এ ধরনের অপব্যাখ্যার বিন্দুমাত্র সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে এর অর্থ দাঁড়াবে, ইসলামে স্বতন্ত্র কোনো আকিদা-বিশ্বাস, কোনো চিন্তা-চেতনা, কোনো বিধান এবং কোনো চারিত্রিক মাপকাঠি নির্ধারিত নেই; বরং এটা এমন একটা পোশাক, যা দ্বারা পৃথিবীর নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতম বিশ্বাস পোষণকারী ব্যক্তিও নিজেকে আবৃত করতে পারে। (নাউজুবিল্লাহ)।
খতমে নবুওয়তের দলিল
আল্লাহতায়ালা মানবজাতির প্রয়োজনানুপাতে কালক্রমে তাদের বিভিন্ন শরিয়ত দিয়েছেন। আর এর পূর্ণতা ও শুভ পরিসমাপ্তি করেছেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে। দীনের পূর্ণাঙ্গতা লাভের পর যেহেতু এতে কোনোরূপ সংযোজন ও বিয়োজনের প্রয়োজন নেই; তাই মানবজাতির জন্য নতুন শরিয়তেরও প্রয়োজন নেই। তাই আল্লাহতায়ালা নবী-রাসুল প্রেরণের ধারা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছেন। এটা ইসলামের অন্যতম মৌলিক বিশ্বাস। এরশাদ হচ্ছে-‘আজ আমি তোমাদের দীনকে পূর্ণতা দান করেছি, আর আমি তোমাদের জন্য আমার নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি এবং দীন হিসেবে ইসলামকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছি।’ (সুরা মায়িদা : ৩)। পবিত্র কোরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে-‘মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যকার কোনো পুরুষের বাবা নন; তবে তিনি আল্লাহর রাসুল এবং সর্বশেষ নবী।’ (সুরা আহজাব : ৪০)। এ ছাড়াও খতমে নবুওয়তের ব্যাপারে রাসুল (সা.) থেকে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন-‘আমি এবং পূর্ববর্তী অন্য নবীদের উদাহরণ হলো, এক লোক একটি ঘর অত্যন্ত সুন্দর করে তৈরি করলো। কিন্তু ঘরের এক কোণে একটা ইট ফাঁকা রেখে দিলো। লোকজন চতুর্দিকে ঘুরে ঘরে তার সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হচ্ছে; কিন্তু বলছে, এ ফাঁকা স্থানে একটি ইট বসালে কতোই না সুন্দর হতো! আমি হলাম সেই ইট এবং আমি হলাম সর্বশেষ নবী।’ (বোখারি : ৩২৭১; মুসলিম : ৪২৩৯)। (চলবে)
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, আল জামিআতুল ইসলামিয়া ইসলামপুর (ভবানিপুর মাদরাসা), গোপালগঞ্জ



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: খতমে নবুওয়ত
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ