দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
পূর্ব প্রকাশিতের পর
এমনি ভাবে রুকু, সেজদা, কিয়াম, কেরাত, তাশাহহুদ ইত্যাদি আদায় করে নিলে-একজনের নামাজ হয়েছে বলে ধরা হবে। তবে এই শেষ কথা নয়, বরং সালাতের পরম লক্ষ্য হলো এমন এক স্তরে গিয়ে পৌছানো যেন প্রতিটি মুহুর্তে তার এই উপলব্ধি হয় যে, আমি আল্লাহকে প্রত্যক্ষ করছি বা আল্লাহর প্রত্যক্ষ দৃষ্টি সতত আমার উপর বিদ্যমান।
তেমনি ভাবে দিবা ভাগে পানাহার ও স্ত্রী চর্চা থেকে যদি কেহ বিরত থাকে তবে তাকে রোযাদার বলা হবে বটে, তবে এতটুকুতেই কেবল সিয়ামের উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। বরং জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর মর্জিঅনুসারে রিপু প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণের নাম হচ্ছে সিয়াম। এই ক্ষেত্রে মানুষ আল্লাহর মহান গুণাবলীর সাদৃশ্য অর্জন করবে। তাই, আল্লাহ বলেছেন ”আল্লাহর রঙ্গে রঞ্জিত হও।” রাসূল (সাঃ) বলেছেন ”আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও”। এটাই এ সবের পরম লক্ষ্য। মোট কথাঃ সওম, সালাত, হজ্ব ইত্যাদি প্রতিটি বিধানেই উক্ত দুটি দিক বিদ্যমান। আরবী পরিভাষায় প্রথম টিকে বলা হয় হুদুদে শরীয়ত ও রুখছুত, আর দ্বিতীয় দিক টিকে বলা হয় মিযাজে শরীয়ত বা আযীমত।
ইসলামী অর্থনীতির বিধি-বিধান সমূহে ও উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। রুখছত ও আযীমের এই শরয়ী কানুনের উপরই ইসলামের অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত। অর্থ ও অর্থব্যবস্থা ইসলামের এই গন্ডির বাইরে নয়। যাকাত, উশর, নাফাকাত, উজূবী, সাদাকত ইত্যাদি হল ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার প্রান্তিক ও প্রাথমিক স্তর, হুদুদে শরীয়ত। এই গুলি যদি কেউ অস্বীকার করে তবে সেই ইসলামের অন্তর্ভুক্ত বলেই গণ্য হয় না। এই গুলি স্বীকার করা হল মুসলিম বলে গণ্য হওয়ার ন্যূনতম শর্ত, প্রান্ত সীমা।
সালাত ও সালাতের রুকু, সেজদা যদি কেউ অস্বীকার করে তার বিরুদ্ধে যেমন জেহাদ করা ফরজ, ঠিক তেমনি ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার এই নূন্যতম দিকগুলি কেউ অস্বীকার করে তবে তাদের বিরুদ্ধেও জেহাদ করা ফরজ। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার এই সীমাকে রক্ষার জন্য হযরত আবুবকর জেহাদ করেছিলেন। কিন্তু এই কেবল ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার শেষ লক্ষ্য নয়। এই বিষয়ে মিযাজে শরীয়ত ও ইসলামের পরম লক্ষ্য হল সকলেই প্রয়োজন দেখা দিলে তার প্রয়োজনাতিরিক্ত সবকিছু অপরের কল্যাণখাতে আল্লাহর মর্জিঅনুসারে বিলিয়ে দেবে। ইসলামী অর্থনীতির পরিভাষায় একেই নেজামে আফও বলা হয়। পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে ঃ
হে নবী আপনার নিকট এরা জিজ্ঞেস করে যে; এরা কি ব্যয় করবে? আপনি বলে দিন প্রয়োজনাতিরিক্ত সব কিছু।” এই হল ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার মধ্যে আযীমত বা পরম লক্ষ্য স্থল।
ইসলাম মূলতঃ এই চেতনাটিকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। নেজামে আফও এর এই বিধান কেবল অর্থ সম্পর্কিত বিষয়েই সীমাবদ্ধ নয় বরং সকল গুণই এই আওতাভুক্ত। জ্ঞান, মেধা, শক্তি ক্ষমতা সকল কিছুতেই এই কথা প্রয়োজ্য। রাসূল (সাঃ) তাঁর জীবনের সকল ক্ষেত্রে সাধারণভাবে এই আযমীতেরই অনুসরণ করে গেছেন। এই ছিল তাঁর সর্বোত্তম আদর্শ। তবে কোন কোন সময়ে এমনিভাবে শরিয়তের প্রান্তসীমা প্রদর্শনের জন্য উম্মতের সুবিধার জন্য রুখছতের উপরও তিনি আমল করতেন। কিন্তু তার সর্বক্ষণের আমল ছিল ঐ “আযীমতের।”
একবার একটি দীনার বা দেরহাম তার নিকট ছিল বলে শুতে গিয়েও শয্যা ত্যাগ করে চলে এসেছিলেন এবং তা সঠিক খাতে ব্যয় করে পরে গিয়ে শুয়েছেন। এ প্রসংগে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, “আমি এমন রাত কাটাতে চাই না, যে রাতে আমার নিকট কোন দীনার দিরহাম পড়ে থাকছে।” নিজামে আফত এর উপর রাসূল (সাঃ) এর এতদুর আমল ছিল যে; দুনিয়া হতে বিদায়ের সময় একটা আধলাও ছিল না তার। দরিদ্রের বন্ধু মহানবী (সাঃ) নিজেই কেবল এই আযীমতের উপর আমল করেন নি, সাহাবাদেরকেও তিনি ঐ স্তরে পৌঁছানোর প্রয়াস পেয়েছেন। হযরত আবু বকর ও ওমর (রাঃ) এর আমলে মুসলিম সমাজে সামগ্রিকভাবে ঐ আযীমতের রূপ বিদ্যমান ছিল। তাই আবূ’যর ঐ সময় নিরব ছিলেন।
বায়হাকির বরাতে ‘শারহে সফরুস্ সাআদাত’ গ্রন্থে আছেঃ হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন; আনসার গোত্রের এক মহিলা আমার নিকট আসে এবং সে দেখতে পায় হুজুর (সাঃ) এর বিছানা এক পুরানো ‘কাতিফা’ অর্থাৎ মোটা চাদর আবৃত। সে তার গৃহে গিয়ে একটি উৎকৃষ্ট বিছানা প্রেরণ করে। রাসূল (সাঃ) এসে দেখে জিজ্ঞাসা করেন, এটি কি? হযরত আয়েশা (রাঃ) বিষয়টা বলেন। রাসূল (সাঃ) বলেন, “হে আয়েশা! এটি ফেরত দাও। আল্লাহর কস্ম! আমি যদি চাই তাহলে আল্লাহপাক সোনার পাহাড় আমাকে দান করবেন।”
রাসূল (সাঃ) সর্বদা গরীব মিসকিনদের সাথে এমন উত্তম ব্যবহার করতেন যে, তারা নিজেদের অভাব ও নিঃস্ব অবস্থাকে রহমত ও সৌভাগ্য মনে করত এবং আমির-ধনী লোকেরা অনুতাপ করত যে তারা কেন গরীব হলো না। রাসূল (সাঃ) ‘আল্ ফাক্র ফাখ্রী’ (দরিদ্র আমার গর্ব) বলে এ শ্রেণীর লোকদেরকে গৌরবান্বিত করেছেন। হযরত সাদ্ ইব্নে আবি ওক্কাস (রাঃ) কে উদ্দেশ্য করে রাসূল (সাঃ) বলেন, “তোমাদের শুধু গরীবদের কারণে জীবিকা দান করা হয় এবং সাহায্য করা হয়।”
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল বলেছেন ঃ ‘বিধবানারী ও মিসকিনদের সাথে উত্তম আচরণকারীর দৃষ্টান্ত এমন; আল্লাহর রাস্তায় জেহাদকারী যেমন অথবা সারারাত নফল এবাদতকারী এবং দিনে রোজা পালনকারী।’ হযরত আব্দুল্লাহ ইব্নে উমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) গরীব মোহাজেরদের সাথে একত্রে বসে বলেন ঃ ফকির (দরিদ্র) মোহাজেরদের জন্য সুসংবাদ, তারা আমীরদের (ধনী) চেয়ে চল্লিশ বছর পূর্বে জান্নাত লাভ করবে।” এ কথা শুনে আমার (বর্ণনাকারীর) অনুতাপ হয় যে, আমি গরীবদের দল ভক্ত কেন হলাম না।
গরীবদের সাহায্যের ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) উদ্বিগ্ন থাকতেন। হযরত জাবির (রাঃ) এর বর্ণনানুযায়ী, আমরা একবার রাসূল (সাঃ) এর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। এ সময় এক গোত্র উপস্থিত হয় এবং সবাই এতই গরীব ছিল, তাদের কারো দেহে একখানা বস্ত্রও ছিল না, উলঙ্গ দেহ; উলঙ্গ মাথা, উলঙ্গ পা। তাদের এ অবস্থা দেখে দয়াল নবী দারুণ ভাবে বিচলিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পাড়েন। এ অবস্থায় তিনি কখনো ঘরের ভিতরও বাহির যেতেন। এ সময় তিনি বেলাল কে আজান দিতে বলেন্ নামাজের পর তিনি উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন এবং তাতে ওইসব লোকের প্রতি সাহায্যের জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং তিনি শান্ত হন।
তাই, হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন ঃ “আল্লাহতায়ালা ধনীদের উপর গরীবদের জীবিকা পরিপূর্ণভাবে সরবরাহ করা ফরয করেছেন। যদি তারা (গরীবরা) ক্ষুধিত ও নগ্ন থাকে অথবা জীবিকার জন্য বিপদগ্রস্থ হয় তাহলে ধনীরা দায়িত্বশীল নয় বলেই গণ্য করতে হবে। এ জন্য আল্লাহর কাছে কিয়ামতের দিনে তাদের জবাব দিহি হতে হবে এবং সংকীর্ণতার জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে।”
“দুইটা রুটি খেয়ে-
যদি পেট ভরে তোমার
তবে তিনটা রুটি খেয় না;
বিলায়ে দাও তা সেজনে
যার একটা রুটিও জোটে না।”
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত হিসাব কর্মকর্তা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।