দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
সমাজে মানুষ কখনোই ‘সমান’ অধিকারে বা ‘সমান’ মর্যাদায় থাকে কিনা, জানি না। তবে মানুষ এই ‘সমান’ বিষয়ে সভ্যতার শুরু থেকেই লড়াই এবং সংগ্রামের মধ্যেই আছে। সমতা বা সমান, এরকম একটা ব্যবস্থাপনা আমাদের কাম্য কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে কিনা। গুণীজনেরাই ভালো বলতে পারবেন।অতি সাধারণ কিংবা অর্ডিনারি ব্যক্তি হিসেবে মনে হয় কোনো সমাজেই মানুষ অন্য মানুষের প্রতি সাধারণত আমরা সমান আচরণ করি না বা করি কম।এর একটি কারণ হতে পারে, একজন মানুষ আরেকজন মানুষের প্রতি সমান আচরণ করতে গেলে তার নিজের ব্যাপারে যতটুকু ‘নিজ-কে’ জানার এবং বোঝার বিষয় থাকে, সেখানে এক ধরনের রাগ অনুরাগ, আবেগ এই বিষয়গুলো আমাদের মনে বেশি প্রভাব সৃষ্টি করে। যে কারণে, আমরা নিজেকে যতটা ভালোবাসি বা যেভাবে দেখি অথবা নিজের শ্রেণী বা গোষ্ঠীকে যেভাবে দেখি। এই একই দৃষ্টিভঙ্গি অন্য মানুষের বা শ্রেণীর প্রতি এবং যারা আমার এবং এই ‘আমাদের’ সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন তাদেরকে নিজেকে যেভাবে দেখি, সেভাবে দেখি কি?। এই বিষয়টাও মাঝে, মাঝে ভাবায়।একজন মানুষ অপর একজন মানুষের প্রতি আমরা কতটা ‘ন্যায়বিচার’ করতে পারি। এই ব্যাপারেও সন্দেহের অবকাশ আছে। মানুষ মাত্রই আমরা স্বার্থপর ব্যক্তি এবং শ্রেণীতে বিভক্ত। নিজের প্রয়োজনে যেটাকে ন্যায় বলে মনে করি, অথবা ‘অধিকার’ ভাবি বা মনে করি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় একই ন্যায়বোধ বা অধিকারবোধ অন্য একজন মানুষের প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিকোণে দেখি। সম-অধিকার অথবা ইকুয়াল রাইটস। আমাদের প্রত্যাশায় থাকে, চিন্তাতে থাকে। কিন্তু বাস্তবে থাকে না। বাস্তবতার চিত্র নানারকম বৈষম্য এবং অসমতায় ভরা।
বিষয়টাকে যদি রাজনৈতিকভাবে দেখি। অনেক সময় দেখতে পারি, গণতান্ত্রিক একটি আদর্শের ভেতর ‘মেজরিটির’ গুরুত্ব থাকে, প্রভাব থাকে, শক্তি থাকে, যেটা কোনো সমাজের ‘মাইনরিটি’ অংশের চাইতে একটু বেশি হয়। গণতন্ত্রে মাইনরিটির অধিকার এবং তাদের যে কোনো চিন্তা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস। এসবের প্রতি গণতন্ত্রের যারা মেজরিটি তাদের অবশ্যই অগ্রাধিকার চিন্তা থাকা দরকার। কিন্তু এই চিন্তাটাও স্লোগানে যত আছে বাস্তবে সেটাও নেই। ভারতের মাইনোরিটি শ্রেণী বা গোষ্ঠী ইতিহাসের পর্যালোচনাতে কতটা কী কী অধিকার পেত বা এখনো পাচ্ছে। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বাস্তবতা কী বলে। ভাববার বিষয় আছে। ব্রিটিশ রাজতন্ত্র, সৌদি রাজতন্ত্র। রাশিয়ায় একনায়কতন্ত্র। চীনে ব্যক্তিতন্ত্র- এর কোনো সমাজ এবং রাষ্ট্রের ‘ইকুয়ালিটি’ প্রশ্নে কতটা সচেতন।গণতন্ত্র কেবল সংখ্যাগত মেজরিটির সব অগ্রাধিকার বা অধিকার বোঝায় না। এখানে যারা মাইনরিটি থাকেন সবার আগে তাদের সুরক্ষার ব্যাপারটাও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। বিষয়টাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখছি না।এই দেখবার পরিপ্রেক্ষিতে এটাও লক্ষ্য করেছি অতীতে এবং যা এখনও করি। কোন কোন সমাজব্যবস্থাতে কোন কোন রাজনৈতিক শ্রেণী বা গোষ্ঠী সমাজ ও রাষ্ট্রের মাইনরিটি সুরক্ষার প্রশ্নে যতটা সজাগ এবং অনুভূতিশীল হওয়া উচিত সে পরিমাণ সচেতনতা অনেক ক্ষেত্রে সমাজের ‘মেজরিটির’র ব্যাপারেও কোনো না কোনো কারণে হই না অথবা হতে পারি না। বা হতে চাই না। আমরা গণতন্ত্র বলতে অগ্রাধিকার দিতে চেষ্টা করি মাইনরিটির সুরক্ষাকে। এই ব্যাপারটা বাংলাদেশের রাজনীতিতেও অতি সাম্প্রতিক অনেক কিছুতে দৃষ্টান্তমূলক আছে।এতে সুবিধা হলো, এতে প্রচ্ছন্নভাবে সমাজে আমরা এক ধরনের ‘অসমতা’ এবং অনেক কিছুকে রাজনৈতিক স্বার্থেও ব্যবহারের একটা পরিবেশ সৃষ্টি করি।ধরা যাক, বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা। এখানে খুব গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখলে দেখা যাবে, সংখ্যাগত দিক থেকেও যদি বিবেচনা করি, সেখানে বঞ্চনার দিকে বলি, অধিকারের কথা বলি। জীবনের নিরাপত্তার কথা বলি। যেহেতু এখানের মেজরিটি সংখ্যায় একটি ধর্ম বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী আছে। তাদের ব্যক্তি এবং শ্রেণীস্বার্থ কিন্তু প্রতিদিনই বিঘ্নিত হচ্ছে। তারাও শোষিত হচ্ছেন, অবিচারের সম্মুখীন হচ্ছেন। ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই সংখ্যাটা কোনো মাইনরিটির সংখ্যার চাইতে কম না। বরং বেশি বলা যায়।
আমাদের অনেকেরই চিন্তা কিংবা আলোচনাতে ‘ওই তাদের’ কথা, যতটা গুরুত্ব পায় তার চেয়ে অধিক বেশি গুরুত্ব পায় যেকোনো মাইনরিটির সুরক্ষার বিষয় নিয়ে।এক্ষেত্রে ইকুয়াল রাইটস কীভাবে কার্যকর, বোঝা কঠিন। কোনো সমান অধিকার কেবল একটি শ্রেণীর জন্য যদি বেশি অগ্রাধিকার পায় সে ক্ষেত্রে বড় একটি অংশের প্রতি আমাদের ইকুয়াল দৃষ্টি কতটা প্রসারিত? মাঝে মধ্যে নিজেকে ভাবায়। এর অর্থ এটা নয় যে, বিশেষ কোনো সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সমাজ বা রাষ্ট্রের অপেক্ষাকৃত ছোট অংশের প্রতি অবিচার অবহেলা অথবা তাদের ব্যক্তি ও সামাজিক অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করে যাবে। এই অনুশীলনটা রাজনীতিবিদদের মধ্যে যতটা প্রকট কিংবা ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ থাকে, সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সেটা থাকে না। একজন সাধারণ মানুষ কিংবা নাগরিকের মধ্যে ‘ইকুয়াল’ প্রত্যয় কিংবা বিবেচনাটি যতটা গুরুত্ব পায়, সেরকম সমান গুরুত্ব পায় না বিষয়টা অনেক রাজনীতিবিদদের কাছে, তেমনি কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যক্তিত্বদের কাছেও। এটা বা¯তবতা।আবেগের কথা না। ইকুয়াাল বিষয়টা তখন রাজনৈতিক স্বার্থে কিংবা গোষ্ঠীর স্বার্থে অথবা ব্যক্তি স্বার্থে বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। রিএ্যাকটিভ বা অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়াশীল হয়। ইতিহাসে এসবের দৃষ্টান্ত আছে।
মানুষ মানুষকে সমান অধিকার দেয় কতটা, বা সেটা দিতে পারে কিনা। এটা নিয়েও প্রশ্নের অনেক সুযোগ আছে। আমরা মানব সমাজে জন্মগতভাবেই সমান না। কারো জন্ম প্রাচুর্যের মধ্যে, কারো দরিদ্রতার মধ্যে। কারণ অধিকাংশ মানুষের প্রতিদিনই কাটে সমাজে বিভিন্ন অগ্রাধিকারভুক্ত শ্রেণির মানুষের থেকে পাওয়া অবহেলার মধ্যে। এই পরিবেশে একটা শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে জন্মমাত্র সে একটা অ-সমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনাতেই কিন্তু বড় হচ্ছে এবং হয়।এরকম ঘরে জন্ম নেয়া কোনো মানবসন্তান সমাজে ধনী শ্রেণীর ঘরে জন্ম নেয়া সন্তানের তুলনায় সবক্ষেত্রেই শুরুথেকেই একটা ‘আন-ইকুয়্াল’ সমাজ ব্যবস্থায় বড় হয়ে ওঠে। এই ব্যবস্থাপনাকে বর্তমান রেখে আমরা কোনো ধরনের ‘ইকুয়ালিটি’ বা সমান অধিকারকে সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করতে পারি বা পারব কিনা জানি না।তাই বলে কি ইকোয়াল রাইটসের কথা বলা হবে না? না, তা তো বলিনি। তবে কোনো একটা কিছুকে ইকুয়াল রাইটস বলে রায় বা দাবি করলে, আমরা যেন মনে রাখি যে সমাজে ইকুয়াল রাইটস, এই যুদ্ধটা কিন্তু প্রতিদিনের।এর চূড়ান্ত সুফল এখনো সমাজে আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। কবে বা পারব, তাও সুনিশ্চিতভাবে বলা কঠিন, তবে এই সংগ্রামের যুদ্ধ প্রতিমুহূর্তের। এর সঙ্গে দ্বিমত করার অবকাশ নেই।সমাজে এই সমান সমান বিষয়টাকে, গুরুত্ব দিতে গিয়ে অনেক দার্শনিক এবং সমাজ ও রাষ্ট্র চিন্তাাবিদরা এক সময় সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।