দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
আল্লাহ তায়ালা আমাদের মহান প্রভু। আমরা তার মুখাপেক্ষী বান্দা, আদিষ্ট গোলাম। সফল, উন্নত ও শান্তিময় জীবন উপভোগের জন্য তিনি আমাদেরকে ইসলাম ধর্ম দান করেছেন। ইসলাম একটি যুক্তিবান্ধব, বাস্তব ও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। মানবজীবনের প্রতিটি বিষয়ের বিধান ইসলামে অত্যন্ত চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে। মানবজাতির জন্য উক্ত বিধান মেনে চলা আবশ্যক। ধর্মীয় অনুশাসন উপেক্ষা করে জীবন অতিবাহিত করলে পদে পদে অশান্তি, অনাচার ও লাঞ্ছনার সম্মুখিন হতে হবে। পরকালে হতে হবে ভয়াবহ শাস্তির উপযুক্ত। মানব সভ্যতাকে অভিজাতরূপে টিকিয়ে রাখতে এবং মানবজাতির উৎকর্ষ সাধনে ইসলামি শরিয়তের বিধি-বিধান মেনে চলা ছাড়া গত্যন্তর নেই। বিধি-বিধান মেনে চলার জন্য সেগুলির জ্ঞানার্জন শর্ত। জ্ঞানার্জন ব্যতীত কোনো বিষয় সঠিকভাবে পালন সম্ভব নয়। এ কারণেই ইসলামের প্রথম বাণী হলো ‘পড়’। জ্ঞানের বিপরীত নাম ‘মূর্খতা’। পৃথিবীর কোনো মানুষই নিজেকে মূর্খ বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। ফলে সাধারণ দৃষ্টিকোণে জ্ঞানের যেমন প্রয়োজনীয়তা ফুটে উঠেছে, তেমনি ইসলামি দৃষ্টিকোণে ইলম বা জ্ঞানার্জন ফরজ ও অত্যাবশ্যকীয় বিষয়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর সমস্ত মুমিনের অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়। তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা বাঁচতে পারে?’ (সুরা তওবা: ১২২)
আনাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘ইলম (ধর্মীয় জ্ঞান) অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ।’ (ইবনে মাজাহ: ২২৪)
পবিত্র কুরআন ও হাদিসের ‘ইলম’ (জ্ঞান) শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ধর্মীয় জ্ঞান। উল্লিখিত হাদিসে প্রত্যেক মুসলমানের উপর যে জ্ঞানার্জন ফরজ করা হয়েছে, তার অর্থ হলো, সমস্ত মুসলমানের জন্য ধর্মীয় জ্ঞানের সে অংশটি আয়ত্ত করা ফরজ, যা ইমান ও ইসলামের জন্য জরুরি এবং যার অবর্তমানে মানুষ না পারে ফরজসমূহ আদায় করতে, আর না পারে হারাম থেকে বেঁচে থাকতে। যে সমস্ত বিষয়ের জ্ঞানার্জন প্রত্যেকের জন্য ফরজ। তার কয়েকটি হলো, ইসলামের বিশুদ্ধ আকিদা, পাক-নাপাকের হুকুম, নামাজ-রোজা-হজ-জাকাতসহ অন্যান্য ইবাদত, যেগুলিকে শরিয়ত ফরজ বা ওয়াজিব করে দিয়েছে। অনুরূপভাবে ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসা, হালাল-হারাম, বিবাহ-তালাক ইত্যাদি। এক কথায় শরিয়ত মানুষের উপর যেসব কাজ ফরজ বা ওয়াজিব করে দিয়েছে, সেগুলোর হুকুম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা সবার জন্য ফরজ। এছাড়া অন্যান্য বিষয়, যেমন: ইসলামের যাবতীয় মাসয়ালা, কুরআন-হাদিস থেকে আহরিত শরিয়তের হুকুম আহকাম ও তার অসংখ্য শাখা প্রশাখা আয়ত্তে আনা সকল মুসলমানের পক্ষে সম্ভবও নয় এবং ফরজে আইনও নয়। তবে গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্য তা ফরজে কেফায়া।
তাই প্রত্যেকটি শহরেই যদি শরিয়তের উপরোক্ত ইলম ও আইন-কানুনের একজন সুদক্ষ আলেম থাকেন, তাহলে অন্যান্য মুসলমান এ ফরজের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করবে। কিন্তু যদি কোনো শহর বা পল্লীতে একজনও অভিজ্ঞ আলেম না থাকেন, তাহলে উক্ত শহরেরই কাউকে আলেম বানানো বা অন্য স্থান থেকে কোনো আলেমকে এনে সে শহরে রাখার ব্যবস্থা করা স্থানীয় লোকের পক্ষে ফরজ ও আবশ্যক, নতুবা উক্ত এলাকার সকলেই গোনাহগার হবেন। যাতে করে যেকোনো প্রয়োজনীয় মাসয়ালা তার কাছ থেকে জেনে সে মতে আমল করতে পারে। (মাআরিফুল কুরআন: ৫৬৯)
অপর আয়াতে বলেছেন, ‘(আপনি বলুন), হে আমার প্রতিপালক, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।’ (সুরা তহা: ১১৪)
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মুমিনগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্তর, যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়, কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ। তারা আল্লাহ যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তাই করে।’ (সুরা তাহরিম: ৬)
আলী (রা.) বলেন, আয়াতে বর্ণিত ‘তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা কর’, এর ব্যাখ্যা হলো, ধর্মীয় জ্ঞানের মাধ্যমে পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর। কারণ, হারাম কাজ করলে জাহান্নামে যেতে হবে। সুতরাং কোনটি হারাম, কোনটি নিষিদ্ধ সে বিষয়ে জ্ঞান থাকলে হারামে লিপ্ত হয়ে পড়ার আশংকা নেই। জ্ঞানী ব্যক্তি সহজেই আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে পারেন।
ধর্মীয় শিক্ষার ফজিলত: আবু দারদা (রা.) বলেন, আমি নবি করিম (সা.)কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের কোনো পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাতের দিকে একটি পথ সুগম করে দেন। ফেরেশতাগণ জ্ঞান অন্বেষীর সন্তুষ্টির জন্য তাঁদের পাখাসমূহ অবনমিত করেন। জ্ঞান অন্বেষীর জন্য আসমান ও জমিনবাসী আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থণা করে, এমনকি পানির মাছও। নিশ্চয় ইবাদতকারীর উপর আলিমের মর্যাদা তারকারাজির উপর চাঁদের মর্যাদার সমতুল্য।’ (ইবনে মাজাহ: ২২১)
মুয়াবিয়া (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে ধর্মীয় জ্ঞান দান করেন। আমি তো বিতরণকারী মাত্র, আল্লাহই দাতা। সর্বদাই এ উম্মত কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর হুকুমের উপর অটল থাকবে, বিরোধিতাকারীরা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (বুখারি: ৭১)
আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইমানদার ব্যক্তির মৃত্যুর পর সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি আমল এমন, মৃত্যুর পরও যার সওয়াব মৃত ব্যক্তি লাভ করেন। একটি হলো, যে জ্ঞান সে অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে এবং তার প্রচার করেছে।’ (ইবনে মাজাহ: ২৪০)
আবু দারদা (রা.) বলেন, আমি নবি করিম (সা.)কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘আলেমগণ হলো নবিগণ (আ.) এর উত্তরাধিকারী। আর নবিগণ (আ.) দিরহাম-দিনারের উত্তরাধিকার রেখে যান না, তারা ইলমের উত্তরাধিকার রেখে যান।’ (তিরমিজি: ২৬৮২)
যেকোনো ব্যক্তির জন্য জান্নাতের রাস্তা সুগম হওয়া, অন্যান্য প্রাণীকুল নাজাতের দোয়া করা, মৃত্যুর পরও সওয়াবের ধারাবাহিকতা চালু থাকা অত্যন্ত গৌরব ও কল্যাণের কথা। নবিগণ (আ.) এর উত্তরাধিকার হওয়ার ঘোষণা তো মহাগৌরব ও সৌভাগ্যের ওয়াদা। এমন কপাল কতজনের জোটে! ফলে দুনিয়া ও আখেরাতে সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হতে হলে আমাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি যত্মবান হতে হবে। নিদেনপক্ষে ফরজ পরিমাণ ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা কবুল করুন।
লেখক: খতিব, আল মক্কা জামে মসজিদ হরপাড়া, শ্রীনগর, মুন্সিগঞ্জ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।