দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
আরবী হিজরী সালের সাতাশে রজবের রাত। বরকতময় এ রাতে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) উর্ধ্বাকাশ ভ্রমনে গিয়েছিলেন। এ রাতে এরকম বিশেষ মেরাজ যে হয়েছিল, এটা কুরআনেও আছে, সহীহ হাদীসেও আছে, এটা বিশ্বাস করতে হবে। মিরাজের রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বোরাকে করে মক্কা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস নিয়ে যান। সেখান থেকে সপ্তম আসমানের উপরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবার পর্যন্ত নিয়ে যান। আবার ঐ রাতের ভিতরে তিনি ফিরে আসেন। ফিরে এসে তিনি ফজরের নামায আদায় করেন। এই ঘটনা কুরআনেও আছে, সহীহ হাদীসে আছে। কেউ যদি অস্বীকার করে, তাহলে তার ঈমান থাকবে না। কোন যুক্তিতে ধরুক বা না ধরুক, বিজ্ঞান এটাকে স্বীকার করুক আর না করুক, তবুও আমাকে বিশ্বাস করতেই হবে।
যেহেতু কুরআন হাদীসে আছে। পরদিনরাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের নামাযের পর সাহাবায়ে কেরামকে এই মেরাজরে বর্ণনা শোনালেন যে, দু’জন ফেরেশতা আমার কাছে এসেছিলেন। তারা আমাকে বাইতুল মুকাদ্দাস নিয়ে যান। সেখান থেকে সপ্তম আসমানের উপর পর্যন্ত আমি পৌঁছি। আল্লাহর দরবার পর্যন্ত পৌঁছি। আল্লাহর সাথে কথা হয়েছে। আল্লাহপাক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করে দিয়েছেন। এভাবে তিনি বিস্তারিত ঘটনা বয়ান করে শোনান। এই ঘটনা যখন বয়ান করেন তখন মক্কার কাফের নেতৃবৃন্দ এটা শুনে উপহাস শুরু করল যে, কাল্পনিক ঘটনা। এক রাতের ভিতর সাত আসমানের উপরে যাওয়া আবার ফিরে আসা, এটাতো পাগলের প্রলাপ! কাফেররা ছুটে গেল হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এর কাছে। তারা ভাবল, মুহাম্মাদের বড় শিষ্যের কাছে গিয়ে দেখি সে কি বলে? হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) ঐ দিন ফজরের জামাতে ছিলেন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখ থেকে তখনও ঘটনা তিনি শোনেননি। কাফেররা তাঁর কাছে গেল। গিয়ে বলল, যদি কোন লোক বলে যে, সে রাতের অল্প সময়ের ভিতরে সাত আসমানের উপর পর্যন্ত গিয়েছে, আবার ফজরের আগে দুনিয়ায় ফিরে এসেছে? তুমি কি তা বিশ্বাস করবে? হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. জিজ্ঞাস করলেন, কে বলেছেন? তারা বলল, তোমাদের নবী! হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. সাথে সাথে বলে উঠলেন, তাহলে আমি বিশ্বাস করি। তিনি সত্যই বলেছেন। এখান থেকেই আবু বকর রা. কে সিদ্দীক বলা হয়। সিদ্দীক অর্থ চরম ও পরম বিশ্বাসী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শোনামাত্রই তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, কোন যুক্তি তালাশ করেননি, কোন বিজ্ঞানের পিছে ছোটেন নি। এটা সম্ভব কি অসম্ভব সেটা তার চিন্তায় আসে নি। যেহেতু আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তাই বিনা দ্বিধায়, বিনা বাক্যে বিশ্বাস করেছেন।
কাফেররা দেখল যে এখানে তো কাজ হল না, তাহলে আবার মুহাম্মাদের কাছে যাই। এবার যেয়ে জিজ্ঞাসা শুরু করল, মুহাম্মাদ! তুমি যদি বাইতুল মুকাদ্দাস গিয়ে থাকবে, তাহলে বলো বাইতুল মুকাদ্দাসের কয়টা সিড়ি আছে? কয়টা জানালা আছে? কয়টা দরজা আছে ইত্যাদি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি সিড়ি গণনা করতে গিয়েছিলেন? কয়টা দরজা জানালা আছে তা জরিপ করতে গিয়েছিলেন? কিন্তু তারা জিজ্ঞাসা করে বসেছে, এখন যদি জওয়াব না দেয়া যায়, তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিথ্যুক প্রমাণিত হবেন। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব পেরেশান হন যে, আজ যদি এই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারি, তাহলে ওরা আমাকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করবে। হাদীসে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তখন আমার এত পেরেশানী হল যে ওরকম পেরেশানী আমার আর কখনও হয়নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন ঃঅতঃপর আল্লাহপাক বাইতুল মুকাদ্দাসকে আমার চোখের সামনে তুলে ধরলেন, আর তারা যা জিজ্ঞাসা করছিল আমি দেখে দেখে গণনা করে করে তার উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম। এ রকম জাজ্জল্যমান প্রমাণ আসার পরও ঈমান আনা তাদের ভাগ্যে জুটল না, তারা মানল না।
ঈমান আনা, আল্লাহর খাস তাওফীকের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। আল্লাহর তাওফীক না হলে ঈমান নসীব হয় না। আল্লাহ পাক আমাদেরকে ঈমান নসীব করেছেন তার জন্য শোকর আদায় করতে হবে। আমাদের মধ্যে কত বড় বড় বুদ্ধিমান, কত বড় বড় জ্ঞানী-বিজ্ঞানী রয়েছে, কিন্তু আল্লাহকে বিশ্বাস করার ঈমান আনার নসীব তাদের হচ্ছে না। ঈমান আনার জন্য আল্লাহ পাকের খাস তাওফীকের প্রয়োজন, অতঃপর ঈমানের উপর টিকে থাকার জন্যেও তাওফীকের প্রয়োজন। তাই ঈমানের উপর টিকে থাকার জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করতে হবে।
যা হোক মক্কার মুশরেকরা বিশ্বাস করল না। তারা বলল এটা যাদু। তাদের একটা মুখস্থ ডায়ালগ ছিল যখন তাদের জওয়াব দেয়ার আর কিছুই থাকতো না, তখন বলতো এটা যাদু। এই বলে সরে পড়ত। মেরাজের ঘটনা বয়ান করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার কাছে দুইজন ফেরেশতা আসলেন, আমি উম্মেহানির ঘরে ঘুমন্ত ছিলাম। তারা আমাকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে বাইতুল্লাহর কাছে হাতীমের ভিতরে নিয়ে গেলেন। সেখান থেকে যমযম কুয়ার কাছে আমাকে নেয়া হল। সেখানে আমার সীনা চাক বা বক্ষ বিদারণ করা হল। আমার সীনা ফেড়ে তার মধ্য থেকে কলব বা হার্টটাকে বের করা হল। কলব ফেড়ে তার থেকে কি একটা বস্তু বের করা হল। তারপর যমযমের পানি দিয়ে কলবটাকে ধুয়ে আবার যথাস্থানে কলবটাকে স্থাপন করে দেয়া হল। এটাকে ফার্সীতে বলা হয় সীনা চাক অর্থাৎ বক্ষ বিদারণ।
এক যুগে মানুষ যুক্তির দোহাই দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সব- শরিরে মেরাজে যাওয়াকে অস্বীকার করত। তারা বলত ঊর্ধ্ব আকাশে রয়েছে কঠিন শীতল স্তর, রয়েছে কঠিন গরমের স্তর, রয়েছে অক্সিজেন ছাড়া স্তর, যেসব স্তরে মানুষের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এতসব প্রতিকুল পরিবেশে অতিক্রম করে স্বশরীরে মেরাজে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এখন যখন আধুনিক বিজ্ঞান বলছে এটাও সম্ভব, তখন তারা চুপসে যাচ্ছে। এখন নাকে খত দিয়ে স্বীকার করতে হচ্ছে যে, না স্ব-শরীরে মেরাজ সম্ভব। বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে কুরআন হাদীসের কোন কিছুকে অস্বীকার করলে এভাবেই নাকে খত দিতে হবে। বিজ্ঞান স্বীকার করুক বা না করুক তা আমরা বুঝি না, যুক্তিতে ধরুক না ধরুক তা আমরা বুঝি না, কুরআন-হাদীসে কিছু বলা হলে তাতেই আমরা বিশ্বাস করি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বশরীরে আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সপ্তম আসমানের উপরে জান্নাত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তারও উপরে আল্লাহর দরবার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা এতে বিশ্বাস করি। কারণ কুরআন হাদীসে তা বলা হয়েছে। আল্লাহ পাক বলেছেন ঃ মহান ঐ সত্ত্বা, যিনি তার বান্দাকে রাতের কিছু অংশে ভ্রমণে নিয়ে যান মসজিদে হারাম থেকে থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত অর্থাৎ কাবা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত। তাকে আমার কুদরতের নিদর্শন দেখানোর জন্য।
আল্লাহর রাজত্ব কত বিশাল, আল্লাহর শক্তির পরিধি কত বিস্তৃত, আল্লাহর সৃষ্টি কত বিশাল ও অদ্ভুত এসব দেখানোর জন্য তাঁকে মেরাজে নেয়া হয়েছিল। জান্নাত জাহান্নামসহ অনেক তাঁকে দেখানো হয়েছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বচক্ষে এগুলো দেখে এসেছেন, যাতে কেউ বলতে না পারে এবং সন্দেহ করতে না পারে যে, ঈমানের কথা যা কিছু আমরা শুনি যেমন আল্লাহ আছে, জান্নাত আছে, জাহান্নাম আছে এসব কিছু আসলে আছে কি না? কেউ তো কোন দিন দেখেনি। এখন আর এরকম সন্দেহ করার অবকাশ নেই। কারণ এগুলো আছে তা এমন একজন দেখে এসে বলেছেন, যাকে দুনিয়ার কেউ মিথ্যাবাদী বলতে পারেনি। ঘোর শত্রু পর্যন্ত যাকে মিথ্যুক বলতে পারেনি। আমার আপনার মত লক্ষ্য মানুষকে যদি দেখানো হত, আর আমরা দেখে এসে বলতাম, তবুও মানুষ অস্বীকার করতে পারত যে, হয়তো পরিকল্পিতভাবে এরা মিথ্যা বলছে, কিন্তু এমন একজনকে দেখানো হয়েছে, যাকে কেউ মিথ্যুক বলতে পারবে না। আমার আপনার লক্ষ-কোটি মানুষের দেখার চেয়ে তাঁর একার দেখার বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বেশি। এই সবকিছু তাঁকে দেখানো হয়েছে রাতের অল্প সময়ের মধ্যে। মাঝ রাত থেকে ফজরের আগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সব দেখে তিনি ফিরে এসেছেন।
তাঁকে যে বাহনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার নাম হলো বোরাক। হাদীসে এসেছে- “এটা একটা সাদা রংয়ের জানোয়ার, যা গাঁধার চেয়ে একটু বড়, খচ্চরের চেয়ে একটু ছোট। তার গতি হল দৃষ্টির শেষ সীমা যতদূরে যায় তত দুরে এক এক এক কদম রাখে। মানুষের দৃষ্টির শেষ সীমা কত দূর যায় তা কেউ বলতে পারেন ? কোটি কোটি মাইল দূরের গ্রহ-নক্ষত্র আমরা এখান থেকে দেখতে পাই। কোটি কোটি নয় হাজার কোটি মাইল দূরেরটাও আমরা দেখি। এরকম দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত দূরে এক এক কদম রাখত বোরাক। তাহলে তার গতি কত ছিল তা কল্পনাও করা যায় না। কেউ কেউ ব্যাখ্যা করেছেন যে, বোরাক শব্দটি আরবী যার অর্থ হলো বিদ্যুৎ। তার গতি ছিল বিদ্যূতের মত। এই ব্যাখ্যা ঠিক নয়। বিদ্যুতের এত গতি নেই যা বোরাকের ছিল। বিদ্যুৎ সেকেন্ডে এক লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল বা তিন লক্ষ কিলোমিটার যেতে পারে। কিন্তু বোরাকের যে গতির কথা বলা হয়েছে দৃষ্টির শেষ সীমায় এক এক কদম রাখত, এ গতি তো বিদ্যুতের গতির চেয়ে অনেক বেশি। এই বোরাকে করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে যাওয়া হয়। বাইতুল মোকাদ্দাস থেকে আসমানের দিকে আরোহণের সময় একটা চলন্ত সিঁড়ি আসে। তিনি বোরাক সহ সেই চলন্ত সিঁড়িতে করে ঊর্ধ্ব জগতে আরোহণ করেন। এজন্যই মেরাজকে মেরাজ বলা হয়। মেরাজ শব্দের অর্থ হল সিঁড়ি। (চলবে)
লেখক ঃ শিক্ষাবিদ, গবেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।