দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
এই পৃথিবী মহান আল্লাহর এক সাজানো বাগান। মানব সমাজের কেউ এখানে সুবাসিত ফুল হয়ে ফুটে। কেউ আগাছা হয়ে যায়। ফুল, গাছ না থাকলে বাগান যেমন থাকে না। বাগানের মালি তার পিছনে আর মেহনত করে না। তেমনি এই পৃথিবী নামক বাগানে আল্লাহ তায়ালার প্রিয় মানুষগুলো যদি পৃথিবী নামক বাগানকে সুশোভিত না করত, জনপদগুলোতে সুবাস না ছড়াত তাহলে এই পৃথিবী মূল্যহীন হয়ে যেত। পৃথিবীর কোন কদর, কোন মায়া তার স্রষ্টার কাছে নিরর্থক হয়ে যেত। এই পৃথিবী মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক্বেবারে ফুলহীন, কূলহীন কখনোই ছিলনা। হয়তো কখনো অল্প সুবাস ওয়ালা ফুল বাগানে ছিল, খুব কম সংখ্যক ফুল ছিল। তাদের প্রতি মহান রবের ভালবাসা আর মায়ায় অন্যরা বেঁচে যাচ্ছে। আমরা বেকুফের দলগুলো তা বুঝতেও পারছি না, বুঝতে চাচ্ছিও না। মনে করি আমার শক্তি আর বুদ্ধিতে আমি সব পেয়ে যাচ্ছি।
যে যমানা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের যত কাছে। আল্লাহ ওয়ালা লোকের সংখ্যা তত বেশি লক্ষ্য করা যায়। আজ থেকে শত বছর আগে বা তারও আগে আমাদের এই সবুজ বাংলায় যত নিবেদিত আল্লাহপ্রেমী, ইমানের তেজোদীপ্ত রাহবার চষে বেরিয়েছেন আমরা বর্তমানে অনেক বেশি পিছিয়ে। আজ অনেক বেশি দাওয়াত পৌছানোর সুযোগ আছে, অনেক বেশী জ্ঞান অর্জনের পথ খুলে গেছে। সাথে সাথে ইমান আমলের উপর আক্রমণ তত বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই দেখা যায় ইলমে একজন মানুষ অনেক যোগ্য হলেও আমলের অবস্থা খুব ভাল নেই। তাই ইলমধারী মানুষদের দেখেও চক্ষু শীতল হয় না, অন্তর বিগলিত হয় না, মনে আল্লাহর প্রেম, ভালবাসা, ভয় জাগরুক হয় না। যেন এক শূণ্যতা, এক অভাব, এক হতাশা দিন দিন বেড়েই চলছে।
আগেকার মানুষ ওয়াদায় পাকা, বিশ্বাসে দৃঢ়, প্রভুর পথে অবিচল, কষ্টে সহিষ্ণু, চিন্তায় সাবলিল, আশায় মানুষের হিতাকাংখী ছিলেন। অজপাড়া গাঁয়ে জন্ম গ্রহণ করলেও তাদের এতে কোন ঘাটতি ছিল না। তারা গুনাহ চিনতেন এবং গুনাহ থেকে বেঁচে চলতেন। গুনাহের কাজকে ভয় করতেন। এতে করে তাদের আমলের ভান্ড থেকে কোন ঘাটতি হয়নি। দিন দিন অল্প করে হলেও আমলের খাজানা পূর্ণ হয়েছে। এই অল্প অল্প আমলে তারা আল্লাহ ওয়ালা হয়ে গেছেন। অপরদিকে আমাদের আমল বেশী হলেও সাথে গুনাহের মিশ্রণে আমলগুলো খেয়ে শেষ করে ফেলছে। আমলের তথা সাওয়াবের ভান্ড খালি হয়ে যাচ্ছে। ভাল কাজের কোন তাছির আমাদের উপর আছর করতে পারছে না। আল্লাহর নাম শুনলে চোখ ছলছল করে উঠে না, হৃদয়ে নাড়া দেয় না, অন্তর কেঁপে উঠে না। কখনও উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ি, আবেগে উথলে উঠি। একটু পরেই নিস্তব্ধ হয়ে যাই। এই আবেগ আর আমলে কোন সংযোগ থাকে না। কখনও নেটওয়ার্ক স্থাপিত হলেও আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগ স্থাপনের চিন্তা মাথায় আসে না। হঠাৎ আসলেও হারিয়ে যায়।
আমাদের পূর্ব পুরুষগন মহান রবকে খুব ভালবাসতেন। মহান রবের ভালবাসায় তারা তাদের আগেকার ধর্ম ত্যাগ করে দ্বীন আল ইসলামে দাখিল হয়েছেন। এটা তাদের কত বড় আর কত দামী সিদ্ধান্ত আমরা তা বুঝতে পারব না। আমরা আমাদের উপরের দিকে খুঁজতে গেলে কোন কোন কালে আমাদের আল্লাহ ওয়ালাদের সন্ধান পাব। এটা পাওয়াই স্বাভাবিক। যারা দ্বীন আল ইসলাম গ্রহণ করেছেন, সে অনুযায়ী চলেছেন তারাই আল্লাহ ওয়ালা, আল্লাহর প্রিয়। আল্লাহ ওয়ালা হিসেবে কারো নাম জনতার সামনে বিভিন্ন মাধ্যমে মহান রব প্রকাশ করে দিয়েছেন, কারো নাম প্রকাশ করেন নি। এটা মহান রবের একান্ত ইচ্ছা। আমরা আমাদের বংশের কত পুরুষ পর্যন্ত জানি? এটা আমাদের দৈন্যতা। এটাও আমাদের প্রভুর পথে চলতে উৎসাহিত করে না। আমরা যদি আমাদের আল্লাহ ওয়ালা পূর্ব পুরুষগনের কথা জানতাম তবে আমাদের মহান রবের পথে চলার জন্য প্রেরণা যোগাত। নিজের আলসেমী ঝেরে ফেলার জন্য উপকারী হতো।
আমার চতুর্থ পূর্ব পুরুষ হযরত মাওলানা ইয়াজ উদ্দিন মুন্সি রাহঃ। তিতাস বিধৌত ব্রাহ্মনবাড়ীয়া জেলার অন্তর্গত নবীনগর থানার একেবারে দক্ষিনে কুমিল্লা মুরাদনগরের লাগোয়া সাতমোড়া ইউনিয়নের চুউরিয়া গ্রামে আমাদের অবস্থান। হযরত মাওলানা ইয়াজ উদ্দিন মুন্সি রাহঃ এই গ্রামের আমাদের বংশের তৃতীয় পুরুষ। তাঁর পিতার নাম মুন্সি নিজাম উদ্দিন দাদার নাম ঈসা খাঁ। ঈসা খাঁ বর্তমান কসবা থানার পুরকুল গ্রাম থেকে এসে চুউরিয়া বসবাস শুরু করেন। আমি ঈসা খাঁর পূর্বে আর কারো নাম জানতে পারি নি। ঈসা খাঁ আমার বংশের সপ্তম পূর্ব পুরুষ। এই হিসাবে আমার বংশ ধারার সপ্তম পুরুষ পর্যন্ত আমি জানি। এটা সত্যই আফসোসের বিষয়। অথচ দেখা যায় আরবগন তাদের অনেক অনেক পূর্ব পুরুষ পর্যন্ত বংশ তালিকা জানেন। এই বিষয়টিও একটি সচেতনতার বিষয়। ইসলাম বংশগত কৌলিন্য সমর্থন করে না। এখানে তাকওয়াই পরিচয়ের আসল। তবে বংশ তালিকা অনেকের জন্য পথ চলায় প্রেরণার বাতিঘর। ঈসা খাঁর তিন পুত্র ছিলেন নিজাম উদ্দিন, মাহতাব উদ্দিন ও জৈন উদ্দিন।
হযরত মাওলানা ইয়াজ উদ্দিন মুন্সি রাহঃ একজন আল্লাহ ওয়ালা আলেম ছিলেন। তিনি তৎকালে অত্র এলাকার বড় ঈদগাহ বর্তমান দশমৌজা বাজারের পাশের ঈদগাহের ইমাম ছিলেন। এই ঈদগাহটি ছিল আশপাশের কয়েক গ্রাম মিলে। বর্তমানেও এই ঈদগাহে ছোট শিকানিকা, বড় শিকানিকা ও কাজেল্লার জনগন নামাজ আদায় করেন। পরবর্তীতে চুউরিয়া শাহী ঈদগাহের মৃত্যু পর্যন্ত ইমাম ছিলেন। এলাকার মানুষ তাঁকে আল্লাহ ওয়ালা, আল্লাহর ওলি হিসেবে জানে এবং মানে। শিকানিকার হয়রত মাওলানা বন্দে আলী রাহঃ এর উস্তাদ ছিলেন হযরত মাওলানা ইয়াজ উদ্দিন মুন্সি রাহঃ। তাঁর জন্ম ও মৃত্যু সাল সম্পর্কে জানা যায়নি। তবে লোক মুখে যতটুকু জানা যায় যে তিনি আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে ১৩২৯ বাংলা সনে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। শত বছর আগে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেও গ্রাম বা এলাকার মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। আমাদের গ্রামের বসতি কবে থেকে শুরু হয়েছে তা জানা না থাকলেও ইয়াজ উদ্দিন মুন্সি রাহঃ এর বাড়িতে আমাদের পুরান বাড়ি বর্তমান জনাব শাহ জাহান চেয়্যারম্যানের বাড়িতে গ্রামের প্রথম মসজিদ নির্মিত হয়। বর্তমানে ঐ বাড়িতে মসজিদ ভিটার ২ শতাংশ জায়গাও রয়েছে। পরবর্তীতে ইয়াজ উদ্দিন মুন্সি রাহঃ আমাদের বর্তমান বাড়ি করে করে চলে আসেন এবং নিজের বাড়ির পুকুরের পশ্চিম উত্তর কোনে পুরো গ্রামের সকলকে নিয়ে তৎকালিন সময়ের ইট চুন সুরকি দিয়ে মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদের দেয়াল ছিল প্রায় ২৪ ইঞ্চ পুরো। উপরের ছাদ কাঠের তীর ও কাঠের মাচার উপর চুন সুরকির ঢালাই দেয়া। উক্ত মসজিদটি ১৯৯৬ সালে মানুষের সংকুলান না হওয়ায় এবং অনেক পুরনো হওয়ায় ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এই মসজিদের পূর্ব উত্তর কোনে ইয়াজ উদ্দিন মুন্সি রাহঃ এর কবর রয়েছে। (চলবে)
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।