মটর সাইকেল: নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে (নতুন বাস্তবতায়)
মটরসাইকেল নিরাপদ, অধিক সুবিধাজনক, খরচ এবং সময় বাঁচায়। গণপরিবহনে একে অন্যের গা ঘেঁষে চলাচলে প্রতিদিন
কাজী সিরাজুল ইসলাম
যানজট এখন শুধু রাজধানীই নয়, জাতির জন্যও এক বিড়ম্বনার নাম। দেশের অগ্রগতিকে থামিয়ে দিচ্ছে এ ভয়ঙ্কর সমস্যা। যানজটের কারণে যে সময়ক্ষেপণ ঘটছে- অর্থনীতির বিচারে তার ক্ষয় ক্ষতি ভয়াবহ। এ সমস্যা উৎপাদনশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দেশের রফতানি বাণিজ্যকে অনিশ্চিত করে তুলছে। বিদেশিরা বাংলাদেশের রাজধানীকে অস্বস্তির দৃষ্টিতে দেখে যানজটের কারণে। বলা যেতে পারে, যেসব কারণে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বিঘিœত হচ্ছে যানজট তার অন্যতম।
রাজধানী ঢাকায় যানজটের কারণে লোকসান আর ভোগান্তির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ঠিক কতটা অর্থনৈতিক লোকসানের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, কতটা কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, মানুষ কতটা ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছে এ নিয়ে চলছে নানা গবেষণা। কিন্তু কোনো কিছুতেই সফলতা আসছে না।
ঢাকার যানজট নিয়ে এত দুশ্চিন্তার পরও এ থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ এখন পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। বরং দিনদিন আরো সংকুচিত হয়ে আসছে যানচলাচলের রাস্তা। প্রতিনিয়ত ঢাকার রাস্তায় নামছে প্রতিযোগিতা দিয়ে নতুন গাড়ি। একটি শহরে গাড়িচলাচলের জন্য যেখানে ২৫ শতাংশ জায়গা থাকা দরকার, সেখানে মাত্র ৮ শতাংশ জায়গা রয়েছে ঢাকায়।
ভয়াবহ যানজট নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী। যানজটে এখন নাকাল নগরবাসী। সর্বনাশা যানজট দেড় কোটিরও বেশি মানুষের এ মহানগরীকে অচল বা স্থবির নগরীতে পরিণত করেছে বা করতে যাচ্ছে বললেও ভুল হবে না।
একটি শহরে রাস্তার পরিমাণ হওয়া উচিত ২৫ শতাংশ। অথচ ঢাকায় মোট রাস্তার পরিমাণ আয়তনের মাত্র ৮ শতাংশ। পরিকল্পিত ব্যবস্থা নিলে ৮ ভাগ রাস্তা থাকার পরও ঢাকার যানজট নিরসন সম্ভব। ঢাকার চেয়ে কলকাতায় এক সময় যানজট ছিল বেশি। সেই কলকাতার যানজট এখন ঢাকার তুলনায় তুচ্ছ। আয়তনের তুলনায় লন্ডন-সিঙ্গাপুরেও রাস্তা কম। অথচ এ দুই নগরীতে দুঃসহ যানজট নেই। হংকংয়ের ৯০ শতাংশ লোক পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে। ঢাকায় যানজটের পেছনে প্রধান কারণ যথাযথ নগর পরিচালন ব্যবস্থা না থাকা। ঢাকায় বিভিন্ন সময় রাজউক, ডেসা, ওয়াসা, ডেসকো হয়েছে। এগুলোর কাজ আলাদাভাবে দেখার কিছু নেই। এগুলোর যথাযথ সমন্বয় দরকার। সবই আলাদাভাবে গড়ে ওঠায় এবং সমন্বয়হীনভাবে কাজ করায় কোনো লাভ হয়নি।
যানজট সমস্যার রাতারাতি কোনো সমাধান হবে না। সমাধান না হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে জনসংখ্যার ঘনত্ব। ঢাকায় প্রতি একরে প্রায় ৫০০ জন লোক বাস করে। নিউইয়র্কে যেখানে ২৫-৩০ জন। জনসংখ্যার ঘনত্ব ঢাকায় আরও বাড়ছে।
যানজটের জন্য মাত্রাতিরিক্ত অভিবাসনও দায়ী। দেশের প্রতিটি এলাকা থেকে রাজধানীতে প্রতিদিন মানুষ আসে কাজের খোঁজে। ঢাকা পুরোপুরি অর্থনীতিনির্ভর শহর হয়ে গেছে। সরকারের যেসব পরিকল্পনা, তাতে এ অভিবাসন ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। অবকাঠামোর উন্নয়ন আর আইনের কথা যতই বলা হোক না কেন, সবকিছুরই সীমাবদ্ধতা আছে। যে কোনো পর্যায়েই যাওয়া হোক যানজট হবেই, যদি মানুষের সংখ্যা সহনীয় পর্যায়ে রাখা না যায়। এর জন্য বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। যে শহরে লোকসংখ্যা বেশি, সেখানে তিন ধরনের পরিবহনব্যবস্থা দরকার। সারফেস, এলিভেটর ও আন্ডারগ্রাউন্ড। আমাদের এখানে শুধু সারফেসটাই আছে। এটা কোনো বড় শহরের চরিত্র নয়। যানজট নিরসনে পাতাল রেলের কথাও ভাবতে হবে। তবে সবকিছু করতে হবে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই করে।
যানজট নিরসনের লক্ষ্যে সরকারের আশু করণীয় হচ্ছেÑ ছোট ছোট মিনিবাস তুলে দিয়ে ৫২ সিটের বাস ও দোতলা বাস চালু করা। মূল সড়ক থেকে রিকশা সম্পূর্ণরূপে তুলে দেয়া। ট্রাক ও ঠেলাগাড়ি কেবল রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত চলাচলের অনুমতি দেয়া। বর্ধিত ঢাকার সঙ্গে মূল ঢাকায় চলাচলের জন্য অধিকসংখ্যক বাইপাস সড়ক নির্মাণ। রাস্তাগুলো দখলমুক্ত করা। ঢাকায় রাজপথ অপদখল পুরোপুরিভাবে বন্ধ করতে হবে। রাজধানীর রাজপথ দখলমুক্ত হলে যানজট সহনীয় মাত্রায় আসবে। ঢাকা আমাদের রাজধানী। যানজটে ৪০০ বছরের পুরনো আমাদের এই রাজধানী অচল হয়ে পড়–ক তা কাম্য হতে পারে না। নিজেদের স্বার্থেই এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। সরকার, বিরোধী দল, নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবিদ সবাই একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
যানজট জাতীয় অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদনের জন্য যে সময় ব্যয় হওয়ার কথা তা গিলে খাচ্ছে এ সমস্যা। গত এক দশকে যানজটে অপচয় হওয়া সময় ব্যবহƒত হলে বাংলাদেশ বহু আগেই মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতো। ফলে এ সমস্যার সমাধানে আন্তরিক প্রয়াসই এখন সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
ষ লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য, ফরিদপুরÑ১
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।