Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দেশকে পুলিশি রাষ্ট্র বানাবেন না

এসপির আদালত অবমাননা শুনানিতে হাইকোর্ট

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২৬ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

দেশকে পুলিশি রাষ্ট্র বানাবেন না। মানুষের এমন যাতে মনে না হয় যে, দেশ পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় যা দেখলাম তা যদি কুষ্টিয়ার বাস্তব চিত্র হয়, তা হবে জাতির জন্য ভয়ঙ্কর। জাতি উৎকণ্ঠিত। এটা নিরসন করার দায়িত্ব আপনাদের। কে কোন মতাদর্শের, কোন দলের সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। সর্বস্তরের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই পুলিশের দায়িত্ব। পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশ্যে এমন মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত কুষ্টিয়ার হুঙ্কার প্রদানকারী এসপি এসএম তানভীর আরাফাতে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার ওপর শুনানিকালে গতকাল সোমবার বিচারপতি মামনুন রহমান এবং বিচারপতি মো. খিজির হায়াতের ভার্চুয়াল ডিভিশন বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।

গতকাল ক্ষমা চাইতে সকালেই হাইকোর্টে হাজির হন এসপি তানভীর আরাফাত। এ সময় তার সহজাত তর্জন-গর্জন কিছুই ছিলো না। শান্তশিষ্ট, বিনয়ী আচরণে তিনি বরং প্রমাণের চেষ্টা করেছেন যে, বিচার বিভাগের প্রতি তার অসীম শ্রদ্ধা। নিজেকে বিচার বিভাগের একনিষ্ঠ খাদেম হিসেবেও প্রমাণের চেষ্টা করেন। তার পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মনসুরুল হক চৌধুরী এবং আহমেদ ইশতিয়াক। সরকারপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তাহেরুল ইসলাম।

আদালত অবমাননার অভিযোগে গতকাল ছিল এসপি তানভীর আরফাতের হাজিরার তারিখ। শুনানি শেষে আদালত তাকে স্বশরীর হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য করেন। এ সময় পৌর নির্বাচনে ভেড়ামারা পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করা প্রিজাইডিং অফিসার মো. শাহজাহান আলীর পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন অ্যাডভোকেট অনীক আর হক এবং ইশরাত হাসান।

ডিএজি তাহেরুল ইসলাম বলেন, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট’র অসৌজন্যমূলক আচরণের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাত। হাইকোর্টের তলবে হাজির হয়ে তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে এসপি তানভীর আরাফাতের কৌঁসুলি মনসুরুল হক চৌধুরী আদালতে বলেন, পুলিশ সুপার সেদিন ম্যাজিস্ট্রেটকে চিনতে পারেননি। তাই অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়েছে। ভবিষ্যতে তিনি দায়িত্ব পালনে আরও সতর্ক হবেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুল আর কখনো হবে না।

এর আগে অ্যাডভোকেট আহমেদ ইশতিয়াক পুলিশ সুপারের লিখিত আবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করেন। আবেদনে এসপি তানভীর আরাফাত বলেন, বিচার বিভাগের জন্য আমার মনে সর্বোচ্চ সম্মান রয়েছে। কোনো অবস্থাতেই বিন্দুমাত্র অসম্মান দেখানোর কথা দূরে থাক, বরং বিচার বিভাগের দেয়া কাজে নিয়োজিত হতে পারলে নিজেকে সম্মানিত বোধ করি। এ ঘটনায় আমি মনের গভীর থেকে অনুতপ্ত। আদালতের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

আবেদনের শুনানির এক পর্যায়ে আদালত পুলিশ সুপারকে বলেন, পুলিশকে কথায় নয় কাজে পটু হতে হবে। কে কোন মতাদর্শের, কোন দলের সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। সর্বস্তরের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা পুলিশের দায়িত্ব। আদালত বলেন, কারো জন্য ভীতিকর না হয়ে তাদের কর্মকান্ডে মানুষের বন্ধু হতে হবে। পত্র-পত্রিকায় যা দেখলাম, তা যদি কুষ্টিয়ার বাস্তব চিত্র হয়, তা হবে জাতির জন্য ভয়ঙ্কর। এমন যাতে মানুষের মনে না হয় যে দেশ পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। দেশকে পুলিশি রাষ্ট্র বানাবেন না। জাতি উৎকণ্ঠিত, এটা নিরসন করার দায়িত্ব আপনাদের। শুনানি শেষে আদালত তানভীরের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা রুলের শুনানির পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন।

এর আগে কুষ্টিয়া ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মহসীন হাসানের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ করেন ওই ম্যাজিস্ট্রেট স্বয়ং। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার ব্যখ্যা দিতে গত ২০ জানুয়ারি পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাতকে তলব করে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে না- এই মর্মে স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করা হয়।
এদিকে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ভোট কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো.শাহজাহান আলী এবং তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঘটনার মূল হোতা এসপি এসএম তানভীর আরাফাতকেই নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। শাহজাহান আলীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এ আদেশ দেন। আদালত এসপির উদ্দেশ্যে বলেন, বিচার বিভাগের প্রতি আপনাদের মনোভাব আগামী দিনের কর্মকান্ডে কতটা প্রতিফলিত হয়েছে, সেটা দেখতে চাই। পরে আদালত তাকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেন।

প্রসঙ্গত: গত ১৬ জানুয়ারি ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মহসিন হাসান। ভোটের দিন দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশ সুপার তানভীর আরাফাত এবং পুলিশ সদস্যরা তার সঙ্গে ‘অসৌজন্যমূলক’ আচরণ করেন এবং দায়িত্ব পালনে বাধা দেন।

এ বিষয়ে পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আরজি জানিয়ে গত ১৭ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ করেন বিচার বিভাগীয় এই কর্মকর্তা। ওই আবেদনের অনুলিপি আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের আইজি এবং সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জনারেল কার্যালয়েও পাঠানো হয়। অভিযোগ মতে, ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে ১৪ জানুয়ারি থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যস্ত প্রথম শ্রেণির জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মহসিন হাসান দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এর মধ্যে ১৬ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের সময় সকাল ১০টায় ভেড়ামারা পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ওই ঘটনা ঘটে।

মহসিন বলেন, ওই কেন্দ্রে ‘কতিপয় ব্যক্তিকে’ ভোট কেন্দ্রের বুথের ভেতর লম্বা বেঞ্চে পোলিং এজেন্টদের সঙ্গে বসে থাকতে দেখি। এ বিষয়ে কথা বলতে তখন আমি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তাকে বুথের বাইরে ডেকে আনি।
তখনই এসপি তানভীর আরাফাতসহ ৪০/৫০ জন ওই ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করেন। তিনি প্রবেশ করেই প্রিজাইডিং অফিসারকে উচ্চস্বরে তলব করেন। তাৎক্ষণিক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন ফোর্স প্রিজাইডিং অফিসারকে আমার সাথে কথা বলতে না দিয়েই তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করেন। তখন আমি নিজের পরিচয় দিয়ে বলি প্রিজাইডিং অফিসারের সাথে একটি বিষয়ে কথা বলছি। কথা শেষ হলে উনাকে নিয়ে যান।

এরপরেও এএসপি মোস্তাফিজুর রহমান ধমক দিয়ে প্রিজাইডিং অফিসারকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ সুপার তানভীর আরাফাত আমার দিকে অগ্রসর হন এবং আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কে? কী করেন এখানে?’ আমি আমার পরিচয় দিলে তিনি আরও ক্ষিপ্ত স্বরে বলেন, ‘আপনি এখানে কী করেন? বেয়াদব! বের হয়ে যান এখান থেকে’! আমি পুলিশ সুপার ও তার ফোর্সদের আক্রমনাত্মক চরম অসৌজন্যমূলক ও মারমুখি আচরণে হতচকিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি। পুলিশ সুপার ও তার সঙ্গী ফোর্সদের আচরণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিমালা ২০১০ এর ৬৯,৭০,৭৪,৮০ ও ৮১ বিধির সরাসরি লঙ্ঘন। তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রার্থনা করছি।



 

Show all comments
  • Harunur Rashid ২৬ জানুয়ারি, ২০২১, ৩:০০ এএম says : 0
    Hon. Judges, it is a police state already. Thanks for noticing it.
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ ইব্রাহীম মোঃ ইব্রাহীম খলিল ২৬ জানুয়ারি, ২০২১, ৩:২২ এএম says : 0
    এই পুলিশ সুপার তো পুরাতন বেয়াদব,তাকে উপযুক্ত শান্তি প্রদান করা বিচার বিভাগের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাই আশা করি সে উপযুক্ত শান্তি পাবে।
    Total Reply(0) Reply
  • সোহেল ২৬ জানুয়ারি, ২০২১, ৩:৫৫ এএম says : 0
    ইসলামকে যে অপমান করে দুনিয়াতে সে লাঞ্চিত হবেই হবে
    Total Reply(0) Reply
  • Bazlur Rashid ২৬ জানুয়ারি, ২০২১, ৩:৫৫ এএম says : 0
    এসপিরা ভাবে নিজেকে জেলার ত্রাণকর্তা আর ওসি সাহেব রা উপজেলার ত্রাণকর্তা,,,,,,, একেবারে জমিদারি স্টাইল
    Total Reply(0) Reply
  • Kabir Hossain ২৬ জানুয়ারি, ২০২১, ৩:৫৫ এএম says : 0
    আল্লাহ তোমাকে প্রকাশ্যে লাঞ্চিত করল।এখনো তুমি তা যদি বুঝতে না পার। আফসোস তোমার জন্য।
    Total Reply(0) Reply
  • Sajib Ahmed ২৬ জানুয়ারি, ২০২১, ৩:৫৬ এএম says : 0
    আলেমদের কটুক্তি করলে আল্লাহ তাকে অবশ্যই অপমানজনক শাস্তি দিবেন প্রমাণিত।
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ দুলাল মিয়া ২৬ জানুয়ারি, ২০২১, ৯:৪৯ এএম says : 0
    আলেমদের অহংকার করলে এই দেশে এসপি টেসপি মন্ত্রী মিনিস্টার কেউ রেহাই পাবে না সাবধান হয়ে যাও আমি আলেম নয় কিন্তু আলেমরা আমার কলিজার টুকরা।......................
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হাইকোর্ট


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ