দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষমা ছিল অপূর্ব, অসাধারণ ও নজিরবিহীন। তিনি ইসলামের সুবেহ সাদেকে ক্ষমার যে নিদর্শন রেখে গেছেন, তা আমাদের জন্য পরম গৌরবের ও অনুসরণীয়। তার ক্ষমা ছিল প্রকৃত বীরের ক্ষমা, সেখানে কোনো স্বার্থ বা দুর্বলতা ছিল না। মানুষকে ক্ষমা করাই ছিল তার ধর্ম। তিনি আত্মীয়-অনাত্মীয়, শত্রু-মিত্র, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-মূর্খ সবার অপরাধকে ক্ষমা করে দিয়েছেন দ্বিধাহীনচিত্তে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে বর্বর আরব জাতি দীর্ঘ ১৩টি বছর ধরে তার নিজের ওপর, তার পরিবার-পরিজন ও সাহাবাদের ওপর অকথ্য ও অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছিল, অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তাকে নিদারুণভাবে যন্ত্রণা দিয়েছিল, তারা সবসময় তাকে পথে-ঘাটে পর্বত-প্রান্তরে নির্লজ্জভাবে আঘাত, ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছিল, এমনকি তাকে এই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার অক্লান্ত চেষ্টা ও বিরামহীন প্রয়াস চালিয়েছিল, তাদেরকে আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শর্তহীন ক্ষমা করেছিলেন। ক্ষমার এমন মহৎ নিদর্শন পৃথিবীর আর কোনো ইতিহাসে নেই।
জন্মের ছয় মাস আগে বাবা হারানো মুহাম্মাদকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেন তার চাচারা। বাবার অভাব পূরণে চাচাদের চেষ্টার কমতি ছিল না। হজরত হামজা ছিলেন তাদের অন্যতম। পিতাতুল্য চাচাকে নির্মমভাবে হত্যা করে কলিজা পর্যন্ত চিবিয়ে খায় আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা। চাচার বুকে বর্ষা বসায় ওয়াহশি। মক্কা বিজয়ের পর আবু সুফিয়ান এবং হিন্দাকে ক্ষমা করে দিলেও ওয়াহশিকে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ওয়াহশি লুকিয়ে লুকিয়ে হজরতের সামনে এসে বলেন, আমি জানি আপানি দয়ার নবী। মানবতা এবং ক্ষমার নবী। আমাকে ক্ষমা করে দিন। এমন জঘন্য অপরাধীকেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্ষমা করে শুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ দেন।
ইহুদিরা খুব দুষ্ট। এরা সবসময় নবীদেরকে কষ্ট দিয়েছে। ভালো কাজে বাধা দিয়েছে। ভালো মানুষদের রক্ত ঝরিয়েছে।
আমাদের প্রিয় নবীজীকেও এরা অনেক কষ্ট দিয়েছে। একবার এক ইহুদি জাদু করে বসল নবীজীকে। নবীজী তখন অনেক কষ্ট পেলেন। জাদু বলে কথা। বুঝতে পারছিলেন না কী হয়েছে। কেন এত কষ্ট হচ্ছে। কেন এমন এলোমেলো লাগছে। কিন্তু আমাদের প্রিয় নবী ছিলেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা। তাই আল্লাহ তা‘আলা স্বপ্নের মাধ্যমে নবীজীকে সব জানিয়ে দিলেন।
নবীজী একদিন ঘুমাচ্ছিলেন। স্বপ্নে দেখেন, দু’জন লোক এসে একজন বসল মাথার কাছে। আরেকজন পায়ের কাছে। এরপর তারা বলাবলি করতে লাগল-
: এ মানুষটির কী হয়েছে?
: তাঁকে জাদু করা হয়েছে।
: কে জাদু করেছে?
: বনী রুযাইকের লাবীদ ইবনে আ‘সাম নামে এক লোক।
: কোথায় জাদু করেছে?
: মাথা থেকে পড়ে যাওয়া চুল ও চিরুনির মাঝে।
: এখন সেটা কোথায় আছে?
: যারওয়ান ক‚পে।
নবীজী ঘুম থেকে উঠে সেখানে গেলেন। ক‚পটি দেখেই চিনতে পারলেন- এটাই স্বপ্নে আমাকে দেখানো হয়েছিল। কুপের নিচ থেকে বের করে আনা হল সেই চুল-চিরুনি। আর চুল-চিরুনির গিঁটগুলো খুলতেই নবীজী পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন। [সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৭৬৩]
জাদুর কারণে প্রিয় নবীজী ছয় মাস যাবত কষ্ট করছিলেন। যখন সুস্থ হলেন দুষ্টু ইহুদির কথা জেনেও তাকে কিছু বললেন না। ক্ষমা করে দিলেন।
জীবনের এক কঠিনতম সময়ে আমাদের প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফে গিয়েছিলেন, আশা করেছিলেন তায়েফবাসী তাঁর কথা শুনবে, তাঁকে সহযোগিতা করবে। কিন্তু সহযোগিতার পরিবর্তে তিনি পেলেন অপমান। তাঁর শরীর থেকে রক্ত গড়িয়ে পায়ে গিয়ে জমাট বাঁধল। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর কাছে একজন ফেরেশতা এলেন। ফেরেশতা তায়েফের দু’পাশের পাহাড় এক করে দিয়ে তায়েফবাসীকে হত্যা করার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তর ছিল, ‘(না, তা হতে পারে না) বরং আমি আশা করি মহান আল্লাহ তাদের বংশে এমন সন্তান দেবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদাত করবে, তাঁর সঙ্গে শরিক করবে না।’’ [বুখারি, খন্ড : ৪, অধ্যায় : ৫৪, হাদিস : ৪৫৪]
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, এক লোক এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললো আমাদের গোলাম কর্মচারীরা তো ভুলত্রুটি করে থাকে; তাদেরকে আমরা কতবার ক্ষমা করবো? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু না বলে চুপ রইলেন। লোকটি আবার প্রশ্ন করলো। এবারও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ রইলেন। লোকটি যখন তৃতীয়বার প্রশ্ন করলো। তখন রাসূল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “প্রতিদিন তাকে সত্তর বার মাফ করে দিবে।’’ [আহমদ : ৫৬৩৫]
এবার শুনুন রাসূলুল্লাহ এর দশ বছরের খাদেম অন্যতম সাহাবী হজরত আনাস রাদিআল্লাহু আনহু কী বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষমা বিষয়ে। হযরত আনাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, “আমি দশ বছর ধরে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমত করেছি। তিনি আমার কোনো আচরণে বিরক্ত হয়ে কখনো উহ্ বলেননি এবং কখনো বলেননি যে, অমুক কাজ কেন করলে? অমুক কাজ কেন করলে না?” [মুসলিম, কিতাবুল ফাযাইল ২/২৫৩]
হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একবার এক বেদুঈন মাসজিদে পেশাব করে দিল। লোকেরা তা দেখে তেড়ে এল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তাকে ছেড়ে দাও এবং এক বালতি পানি ঢেলে স্থানটি ধুয়ে দাও। মনে রেখ, তোমাদেরকে সহজ-সাধ্যকারী হিসেবে পাঠানো হয়েছে, কাঠিন্য সৃষ্টিকারী হিসেবে নয়।” [বুখারী, কিতাবুল উযূ, ১/৩৫]
তার ক্ষমার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল, মক্কা বিজয়ের ঘটনা। মক্কার কাফেররা নবুওয়াতের একুশ বছর পর্যন্ত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার নাম উচ্চারণারীদের ওপর নির্যাতন চালাতে থাকে। জুলুম উৎপীড়নের এমন কোনো পদ্ধতি ছিল না, যা ওরা প্রয়োগ করেনি। অবশেষে ওরা তাকে বাস্তুভিটা ও স্বদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করে। কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর ইসলামের এই জঘন্য শত্রুদল পুরোপুরিভাবে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়া ও কৃপার পাত্র হয়ে পড়ে। তার একটি অঙ্গুলির ইশারা ওদের সবাইকে রক্তগঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে পারত। কিন্তু বাস্তবে হয়েছি কী!
এককালের দোর্দন্ডপ্রতাপ কুরাইশ সরদাররা ভয় ও অনুশোচনার ভারে মাথা নত করে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে দন্ডায়মান। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা আমার নিকট কীরূপ আচরণ প্রত্যাশা করো? ওরা সম্মিলিত কণ্ঠে জবাব দিলো, হে সত্যবাদী, হে বিশ্বস্ত, আপনি আমাদের সম্ভ্রান্ত ভাই, সম্ভ্রান্ত ভ্রাতুষ্পুত্র। আমরা সর্বদাই আপনাকে দয়ালরূপে পেয়েছি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “অদ্য আমি তোমাদের তা-ই বলব, যা হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম তার ভ্রাতাদের বলেছিলেন। তিনি বললেন, তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। যাও আজ তোমরা সকলেই মুক্ত।” [শিফা; সীরাতে ইবনে হিশাম]
যুদ্ধ-স¤্রাট আবু সুফিয়ানের যখন শুভবুদ্ধির উদ্রেক হল তখন তিনিও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে আত্মসমর্পণ করলেন। নবীজী তাকে শুধু ক্ষমাই করলেন না, ঘোষণা করলেন, যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে তারাও নিরাপদ। রাসূলের এ মহানুভবতা আবু সুফিয়ানের হিংসাকে চিরতরে বিনাশ করে দেয়। তিনি খালেস মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান।” [আসসীরাতুন্নবিয়্যাহ পৃ. ৩৪৯; যাদুল মা‘আদ, ১/৪২১]
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর কথা কার না জানা। যে ছিল মদিনার মোনাফেকদের নেতা, আম্মাজান হজরত আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহার ওপর মিথ্যা অপবাদ রটনাকারী। এই আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর মৃত্যুর সময়কার ঘটনা : আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ছেলের নামও আব্দুল্লাহ, তিনি ছিলেন পাক্কা মুসলমান। বাবার মৃত্যুশয্যার সঙ্গীন মুহূর্তে ছেলে আবদুল্লাহ দৌড়ে এলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে। লাজ-লজ্জার কথা না ভেবে, অশ্রু চোখে আবদুল্লাহ রাসূলের কাছে আবেদন জানালেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনার মুখের খানিকটা উচ্ছিষ্ট পানি দেবেন? হয়তো আপনার উচ্ছিষ্ট পানির বরকতে আমার আব্বার গোনাহ মাফ হয়ে যাবে।’
আল্লাহর রাসূল দেরি করলেন না, তখনই নিজের মুখের বরকতময় উচ্ছিষ্ট পানি আবদুল্লাহর হাতে দিয়ে দিলেন। এমন কট্টর মুনাফেককেও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাফ করে দিলেন। শুধু তাই নয়, আরো শুনুন- অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মৃত্যু হয়। ছেলে আবদুল্লাহ এক বুক দুঃখ নিয়ে আবার দৌড়ে এলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে। বুকে দুঃখ, চোখে মুখে অনুশোচনার লজ্জা, বাবার পাপের ভার যেন তার বুকে ভারী পাথর হয়ে বসে আছে। তবু সাহস করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আবেদন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আব্বা মারা গেছেন। আপনার গায়ের একটা জামা দেবেন, আব্বার কাফন দিবো। হয়তো আপনার জামার বরকতে তার কবরের আজাব মাফ হয়ে যাবে।’
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেরি করলেন না, তখনই নিজের জামাটি আবদুল্লাহর হাতে দিয়ে দিলেন। ভাবেনতো সে ছিল মুনাফেক ও কট্টর শয়তান। ক্ষমা দেখালেন। এখনই আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের জানাজা পড়ানো হবে। এমন সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এলেন সেখানে। ইবনে উবাইয়ের ছেলে আব্দুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখে দৌড়ে এসে লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে মিনতি করে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আব্বার জানাজাটা আপনি পড়াবেন?’ রাসূল একবারও চিন্তা করলেন না, একবারও ভাবলেন না আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের অতীত অপকর্মের ব্যাপারে, সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলেন, ‘হ্যাঁ, কেন নয়? অবশ্যই তার জানাজা পড়াবো।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের জানাজা নামাজের কাতার সোজা করতে বললেন। এই হলো ক্ষমা প্রদর্শন।
হজরত জাবের রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, একবার তিনি এক যুদ্ধের অভিযানে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলেন। যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যাবর্তন করলেন, তখনও তিনি তার সঙ্গে ছিলেন। দ্বিপ্রহরের দিকে বিশ্রামের সময় হলে তারা কাঁটাওয়ালা বৃক্ষপূর্ণ একটি উপত্যকায় পৌঁছলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বাবলা গাছের নিচে (বিশ্রামের জন্য) নেমে গাছের শাখায় তরবারি ঝুলিয়ে রাখলেন। এদিকে আমরাও শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ডাক শুনতে পেলাম।
আমরা গিয়ে দেখলাম, তার নিকট এক বেদুঈন ব্যক্তি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সে সুযোগে এ লোকটি আমার ওপর আমার তরবারিটি উত্তোলন করেছিল। আমি হঠাৎ জাগ্রত হয়ে দেখলাম তার হাতে কোষমুক্ত তরবারি। সে আমাকে লক্ষ্য করে বলল, বল, এখন আমার হাত থেকে কে তোমাকে রক্ষা করবে? আমি বললাম, ‘আল্লাহ’, ‘আল্লাহ’, ‘আল্লাহ’ তিনবার। এতে তার হাত থেকে তরবারি নিচে পড়ে গেল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তরবারি নিজের হাতে তুলে নিয়ে বললেন, এখন কে তোমাকে আমার হাত হতে রক্ষা করবে? তখন বেদুঈন বলল, আমি আশা করি, আপনি উত্তম তরবারি ধারণকারী হবেন।
অর্থাৎ আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি এ সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই এবং আমি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল? তখন বেদুঈন বলল, আমি এটা বলব না; কিন্তু আপনার সঙ্গে এ ওয়াদা করছি যে, আমি আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না এবং ওই সব লোকের সঙ্গেও থাকব না যারা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ছেড়ে দিলেন। সে তখন তার সঙ্গীদের নিকট ফিরে এসে বলল, আমি মানব জাতির একজন শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তির কাছ থেকে তোমাদের নিকট এসেছি।” [বুখারি : ২৯১০; মুসনাদে আহমদ : ১৫১৯০]
একবার এক ইহুদি আল্লাহর হাবীবকে মারতে এসে তার মেহমান বনে গেলো। রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথাসাধ্য আপ্যায়ন করে শোয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু শয়ন প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে ইহুদি লোকটি বিছানায় পায়খানা করে চলে গেলো। সকালে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কোনো সন্ধান পেলেন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা মুবারক মলিন হয়ে গেলো। আফসোস আর আক্ষেপ করে বলতেছিলেন, ‘হায়! আমি বুঝি তার যথাসাধ্য আপ্যায়ন করতে পারিনি’।
একবার এক যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে জয়নব নামের এক সম্ভ্রান্ত ইহুদি হজরতকে দাওয়াত করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, খাবারের সঙ্গে বিশ মাখিয়ে হজরতকে মেরে ফেলা। খাবার মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হজরত বিষের বিষয় বুঝতে পারলেন। ততক্ষণে পাশের সাহাবি বিষমাখা খাবার গিলে ফেলেছেন। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
জয়নবকে বন্দি করে হজরতের সামনে আনা হল। হজরত জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেন এমনটি করলে? জয়নব বলল, আপনাকে মেরে ফেলার জন্য। পৃথিবীর যে কোনো স¤্রাটই এ নারীকে সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করে ফেলত। আর এটা বৈধও ছিল। কিন্তু মানবতার নবী, ক্ষমার নবী বললেন, জয়নব!আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম।
যায়েদ নামের এক ইয়াহুদী পাদ্রী মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে একটি অগ্রিম কেনা-বেচা করল। নির্ধারিত সময়ের ২/৩ দিন পূর্বেই সে এসে মাল পরিশোধের দাবি করল। এমনকি চাদর মুবারক টেনে নবীজীর সঙ্গে বেআদবী করল। বিকৃত চেহারায় রূঢ় কণ্ঠে নবীজীর দিকে তাকিয়ে বলল, হে মুহাম্মাদ! আমি তোমাকে চিনি। তোমরা আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর, বড় টালবাহানাকারী।’ সেখানে উপস্থিত ছিলেন হযরত উমর ফারুক রাদিআল্লাহু আনহু। নবীজীর সাথে লোকটির এ অশিষ্ট আচরণ দেখে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে তাকে ধমক দিলেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখে ছিল হাসি। তিনি উমর রাদিআল্লাহু আনহুকেক বললেন, উমর! আমি ও এ ব্যক্তি তোমার থেকে অন্যরূপ আচরণ পাবার হকদার ছিলাম। দরকার তো ছিল তুমি আমাকে সত্বর তার প্রাপ্য আদায় করার পরামর্শ দিতে আর তাকে কথায় ও আচরণে ন¤্রতা অবলম্বনের তাগিদ দিবে। এরপর তিনি উমর রাদিআল্লাহু আনহুকে প্রাপ্য পরিশোধের নির্দেশ দেন এবং তাকে আরো ২০ সা বেশি দিতে বলেন, যা ছিল উমর রাদিআল্লাহু আনহু কৃর্তক লোকটিকে ধমক দেওয়ার বদলা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ সহিষ্ণু আচরণ লোকটির ইসলাম গ্রহণের কারণ হয়। যাওয়ার পথে যায়েদ উমর রাদিআল্লাহু আনহুকে বললেন, হে উমর! আমি হচ্ছি ইয়াহুদী-পন্ডিত যায়েদ ইবনে সানা। আসলে লেনদেন আমার উদ্দেশ্য ছিল না, বরং মহানবীর ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা পরীক্ষা করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। কারণ শেষ নবীর অন্যতম গুণ হবে এই যে, তাঁর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা ক্রোধের ওপর প্রবল থাকবে, যতই রূঢ় আচরণ করা হবে তার ক্ষমা ততই বৃদ্ধি পাবে। অতএব ওমর! আমি যা চেয়েছি তা পেয়ে গেছি। এরপর তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে খালেছভাবে ঈমান আনেন এবং তাঁর অঢেল সম্পদের অর্ধেক উম্মতের জন্য দান করে দেন।” [মুসনাদে আহমদ, ৩/১৫৩, আখলাকুন্নাবী পৃ. ১২৪]
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হৃদয়ের বিশালতা, ঔদার্য, মহানুভবতা, দয়া ও ক্ষমার এমন দৃষ্টান্তের কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। বরং তার মহান আদর্শকে অনুসরণ করে, আমরা যেন নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা ও হিংস্রতা পরিহার করে ক্ষমাশীলতার মহান গুণে এই পৃথিবীকে আরও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারি। সমস্ত মানুষ এক আদম সন্তান। সব মুসলিম ভাই ভাই। অন্যের প্রতি আচরণেও থাকা উচিত ভ্রাতৃত্বের স্পর্শ এবং অন্যের আচরণ গ্রহণেও চাই ঔদার্য্যরে ছোঁয়া। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত তো আমাদের সে শিক্ষাই দান করে। এ সুন্নতের অনুসরণ করলে আমাদের জীবন হতে পারে অনেক সুন্দর, অনেক শান্তিময়। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।