Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সুন্দরবনে অসুন্দরের থাবা কেন

প্রকাশের সময় : ২৭ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হারুন-আর-রশিদ

বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রাণকেন্দ্র এবং আল্লাহ প্রদত্ত প্রকৃতির সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন আজ অসুন্দরের থাবায় আক্রান্ত। এটা ভাবনার বিষয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতসহ বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের ভাবনার বিষয় এখন সুন্দরবন। এক যুগ ধরে ধীরে ধীরে সুন্দরবনকে নানা অসুখে আক্রান্ত করছে? যার ৮০ শতাংশই মানবসৃষ্ট অসুখ বা দুরারোগ্য ব্যাধি বললে মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না।
সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনভূমি। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় সুন্দরবন একটি সংরক্ষিত স্থান। সেহেতু সুন্দরবনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিস্তৃত এই বনভূমির বর্তমান আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবনের বাংলাদেশের অংশ ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার এবং অবশিষ্ট অংশ তিন হাজার ৯৮৩ বর্গকিলোমিটার ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের। সুন্দরবনকে ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। সুন্দরবনকে জালের মতো জড়িয়ে রেখেছে সামুদ্রিক ¯্রােতধারা, কর্দমাক্ত চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ছোট ছোট দ্বীপ। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃতি প্রায় ৭৫ কি.মি. এবং পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃতি প্রায় ৯০ কি.মি.। সুন্দরবনের জেলাসমূহ হলোÑ সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি, খুলনা জেলার দাকোপ ও কয়রা, এবং বাগেরহাট জেলার মংলা ও শরণখোলা। সুন্দরবন এলাকা বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। নদীনালা ৪০০, দ্বীপ ২০০, মাছ ৪০০ প্রজাতির, পাখি ৩২০ প্রজাতির, স্তন্যপায়ী প্রাণী ৫০ প্রজাতির, সরীসৃপ ৫০ প্রজাতির। উল্লেখযোগ্য বৃক্ষের নামÑ সুন্দরী, গরান, গেওয়া, কেওড়া, পশুর, বাইন, ধুন্দল, ওড়া ইত্যাদি। এ ছাড়া সুন্দরবনেও আছে সমুদ্র সৈকত। মনোমুগ্ধকর দর্শনীয় স্থান নীলকমল (হিরণ পয়েন্ট) দুবলারচর এবং কটকা। সুন্দরবন বলতেই বোঝায়Ñ নির্মল বাতাস, প্রকৃতির নীরবতা, কোলাহল ও দূষণমুক্ত এলাকা, নদীবেষ্টিত সুন্দরবনে লঞ্চে ভ্রমণের সময় রাস্তার ধুলাবালি নেই, নেই গাড়ির ঝাঁকুনি। একটি পরম তৃপ্তিদায়ক পরিবেশ নিয়ে সুন্দরবন।
নৈসর্গিক সুন্দরবনের একদিকে অথৈ জলরাশি, বিশুদ্ধ বায়ু সবুজে বেষ্টিত, অন্যদিকে কোলাহলমুক্ত পরিবেশ সুন্দরবনকে চিরযৌবনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বিশ্বের নানা স্থান থেকে আগত ভ্রমণবিলাসী পর্যটকরা। যে কথাটি না বললেই নয়Ñ ১৯১১ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশীদার সুন্দরবনের মোট আয়তন ছিল প্রায় ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় অর্ধকোটি মানুষের জীবিকার প্রাণকেন্দ্র। বিগত সময়ে সিডর, আইলা, নার্গিসে বহুমাত্রিক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সুন্দরবন অত্যন্ত দ্রুততার সাথে বৈরী আবহাওয়ার বিরুদ্ধে নিজস্ব শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বৈরী প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানবঢাল হিসেবে কাজ করেছিল। অতীতে, বর্তমানে এবং ভবিষ্যতেও সুন্দরবন বাংলাদেশ রক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে।
বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জীববৈচিত্র্যের এই সুন্দরবন বাংলাদেশের সম্পদÑ তাই এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। সুন্দরবনকে ঘিরে বিকশিত হতে পারে আমাদের পর্যটন খাত। উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে দিলে এই সুন্দরবন থেকেই আয় করা সম্ভব কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। এর জন্য প্রয়োজন জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ সুন্দরবন উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ করা। কিন্তু আমরা দেখছি বিগত এক দশকে উন্নয়নের নাম দিয়ে সুন্দরবনকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষিপ্ত করা হচ্ছে।
উজানের দেশ ভারত থেকে মিষ্টি পানি প্রবাহে বাধাদানে সুন্দরবন অঞ্চলের লবণাক্ততা বাড়ছে। অতিরিক্ত লবণাক্ততা বনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আইপিসিসির চতুর্থ প্রতিবেদন অনুসারে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা ৩০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেলে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল খ্যাত বাঘ একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং এক মিটার উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে পুরো সুন্দরবন তলিয়ে যাবে। বিগত কয়েক বছর বিভিন্ন গবেষণায় প্রতিফলিত হয়েছে চোরা শিকারিদের তৎপরতা বৃদ্ধির কারণে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হরিণের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। বন বিভাগ এবং বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী ট্রাস্টের এক জরিপে বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে রয়েল বেঙ্গল টাইগার কমেছে ৭০ শতাংশ, অন্যদিকে ভারতের অংশে বেড়েছে ৩০ শতাংশ। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাণী বাঘ সংরক্ষণে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সুন্দরবনে বর্তমানে ১৩ ধরনের প্রক্রিয়ায় মাছ ধরা হয়। এর মধ্যে কারেন্ট জাল, ঠেলা জাল, রকেট জালের কারণে মাছের সীমাহীন ক্ষতি হচ্ছে। বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরার প্রবণতা ইদানীং বেড়ে যাওয়ায় সুন্দরবন মৎস্যহীন এলাকায় পরিণত হচ্ছে। সম্প্রতি সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার জনগণ বাগদা চিংড়ি পোনা আহরণ করাকে একটি অন্যতম পেশা হিসেবে নিয়েছে। গবেষকদের গবেষণায় দেখা গেছে, চিংড়ি পোনা আহরণ করতে গিয়ে অন্য প্রজাতির কোটি কোটি পোনা মাছ অবলীলায় ধ্বংস করা হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে সমুদ্র স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলা ইত্যাদি কারণে নদীর সীমানা পরিবর্তন, বন্যা ও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবনের স্বভাবসুলভ প্রকৃতিগত অবস্থা রুগ্ন হচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও বরগুনার প্রায় ১৭টি উপজেলার লাখ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে তাদের জীবন-জীবিকার জন্য সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। এই সংখ্যা প্রতিদিনই জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া অনেকেই অবৈধভাবে বাঘ, হরিণ শিকার, মাছ ধরা এবং বৃক্ষ নিধন পেশায় জড়িয়ে পড়েছে। জলোচ্ছ্বাস, বন্যা বা সাইক্লোনের পাশাপাশি জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তনের কারণে বঙ্গোপসাগর ক্রমেই উত্তাল হয়ে উঠছে। সুন্দরবনের আশেপাশে লাখ লাখ হেক্টর আবাদি জমিতে লবণ পানি আটকিয়ে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় সমুদ্র থেকে জলোচ্ছ্বাসে আসা লোনা পানিতে নি¤œভূমিতেও মাঝে-মধ্যে সৃষ্টি হয় দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর রিমোর্ট কন্ট্রোলের মাধ্যমে রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। ধাপে ধাপে এই প্রকল্পের নানা অংশের নির্মাণ কাজও সমানতালে এগিয়ে চলছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। উদ্যোগ ভালো, তবে এটি হচ্ছে কয়লাভিত্তিক উৎপাদন কেন্দ্র, যার অর্থ দাঁড়ায় কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। আর সেই কয়লা আমদানি হবে ভারত থেকে। জানা গেছে, সমুদ্রপথে কয়লা আনা হবে বঙ্গোপসাগরের আকরাম পয়েন্টে। সেখান থেকে ছোট ছোট জাহাজে করে সুন্দরবনের মধ্যদিয়ে নদীপথে তা রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পাঠানো হবে। পরিসংখ্যানে জানা যায়, বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়বে। প্রতিদিন জাহাজে করে ১৩ হাজার টনের বেশি কয়লা আসবে। এই প্রকল্পটি গড়ে উঠেছে যৌথভাবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এবং ভারতের কোম্পানি ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তা আজীবন চালু থাকবে। অল্প টাকা বিনিয়োগ করেও ভারতের মালিকানা থাকছে উক্ত প্রকল্পে ৫০ ভাগ। প্রথম আলো ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সংখ্যায় অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ একটি নিবন্ধ লিখেছেনÑ “দেশকে যা বিপন্ন করে, তা উন্নয়ন নয়”। তার নিবন্ধের সাথে গোটা জাতি একমত পোষণ করবে বলে আমরা মনে করি। আনু মুহাম্মদের নেতৃত্বে সাত দফা দাবিতে ২০১৩ সালের ২৪ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে সুন্দরবন লংমার্চ সুসংগঠিত করেছিল তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। ওই জাতীয় কমিটি দফায় দফায় পরবর্তী সময়েও বড় বড় কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, এবং করছে। কিন্তু সরকারের হাত-পা যখন বাঁধা থাকে বিশেষ একটি রাষ্ট্রের কাছে তখন জনহিতকর এসব কর্মসূচির বাস্তবায়ন দূরের কথাÑ মিটিং-মিছিলে হামলা-মামলা করে জনস্বার্থের কণ্ঠ রোধ করাই যেন শাসকগোষ্ঠীর কাজ হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষমতার স্বার্থে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থ তখন গৌণ হয়ে যায়।
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মারাত্মক পরিবেশগত প্রভাবের কথা বিবেচনায় এনে ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ২০১০ সালের ইআইএ গাইডলাইনে অভয়ারণ্য, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকার ২৫ কিলোমিটার পরিসীমার মধ্যে এ ধরনের কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সে হিসাবে ভারতইবা কেন বাংলাদেশের এ উদ্যোগকে বাহবা দিচ্ছেÑ নিশ্চয়ই এ ক্ষেত্রে তাদের বিরাট রয়্যালিটি রয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ বিনিয়োগের পেছনে।
সম্প্রতি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর কাউন্সিলের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলেছেনÑ সুন্দরবনের পাশে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে হাসিনা সরকার দেশকে সা¤্রাজ্যবাদী পুঁজির অবাধ লুণ্ঠনের ব্যাপক সুযোগ করে দিয়েছে। এ প্রকল্পটি পুরোপুরি জাতীয় স্বার্থবিরোধী। এর আগেও তারা বিদ্যুৎ সংকট নিরসনের কথা বলে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে পুকুরচুরির ঘটনা ঘটিয়েছে। এখন উন্নয়নের ছবক দিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবন, কৃষি জমি ধ্বংস করে স্পেশাল ইকোনমিক জোন, কয়লা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের নামে দেশকে বেনিয়াগোষ্ঠীর পুঁজির অবাধ লুণ্ঠনের ক্ষেত্র ভূমিতে পরিণত করেছে। সরকার বলছে, দূষণ রোধের ব্যবস্থা থাকবে ফলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। গবেষণা তথ্যে দেখা গেছে যত উন্নত প্রযুক্তিই ব্যবহার করা হোক না কেন, দূষণের হার ৮ থেকে ১০ শতাংশ কমতে পারে, এর বেশি নয়। সুতরাং জীববৈচিত্র্য-বৃক্ষরাজি ধ্বংসের সব উপকরণই বিদ্যমান থাকছে রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে।
আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র জনগণের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে সে দেশে চারটি বড় ধরনের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প এ বছর জুন মাসে (২০১৬) বাতিল করে দিয়েছে। বাতিল হওয়া এলাকার নাম হলোÑ কর্নাটক, ছত্তিশগড় মহারাষ্ট্র ও উড়িষ্যার মতো রাজ্য সরকারগুলো এবং সে অঞ্চলের মানুষের আপত্তির কারণে কেন্দ্রীয় সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, প্রকল্প চারটি বন্ধ করে দেয়। জনগণের স্বার্থে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ও বৃক্ষরাজির স্বার্থে সর্বোপরি ১৭টি উপজেলার প্রায় এক কোটি মানুষের কথা কেন আমাদের সরকার ভাবতে চাইছে না। বিষয়টি বুঝে আসে না। বাংলাদেশ জনবহুল একটি ক্ষুদ্র এলাকার দেশ। সেখানে যদি বিস্তীর্ণ এলাকা ভুল পদক্ষেপের কারণে ধ্বংস হয়ে যায়, এর জন্য বর্তমান শাসক গোষ্ঠীকে চরম মাশুল দিতে হবে। আন্তর্জাতিক নীতিমালায় নি¤œতম ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল জাতীয় স্বার্থে সংরক্ষিত রাখতে হবে। আমাদের আছে মাত্র ১০ শতাংশ। তারপর যদি সুন্দরবনের অভয়ারণ্য পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে বনভূমির মারাত্মক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে যাবো আমরা। মানুষ অক্সিজেনের অভাব অনুভব করবে। বর্তমানে উন্নত বিশ্ব জনজীবনের ঝুঁকি ও মারাত্মক ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে পরমাণু বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দিয়েছে। তারা প্রকৃতির কাছে মাথানত করেছে। প্রকৃতির ক্ষতি করলে উল্টো প্রকৃতি মানুষের ক্ষতি করে। সম্প্রতি জাতিসংঘ ও ইউনেস্কোর প্রতিনিধিরা সুন্দরবন অঞ্চলটি ঘুরে দেখেছেন। তারাও আশ্বস্ত ও আস্থা প্রকাশ করেননি রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে।
এক কথায় সুন্দরবন বহুভাবেই বিপদগ্রস্ত আছে। বর্তমানে কমপক্ষে দুটি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বড় আকারের হুমকি সৃষ্টি করেছে। সরকারের বন বিনাশী প্রকল্প, বারবার তেল ও কয়লাবাহী জাহাজ ডুবি, বনের ভিতর দিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল সুন্দরবনে বসবাসরত প্রাণিকুলের জীবন ধ্বংসের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছে। আমরা যে যত কথাই বলি না কেন আন্তর্জাতিকভাবে সুন্দরবনের একটি বড় ধরনের মূল্যায়ন ছিল। অথচ এখন তার অকাল মৃত্যু হতে চলেছে, তা ভাবতেও কষ্ট হয়। সুন্দরবনের নৈসর্গিক সৌন্দর্য এখন ভাটার দিকে অগ্রসরমান। আমরা কতিপয় ক্ষমতাধারী মানুষ ঋতু বৈচিত্র্যের প্রাকৃতিক মাধুর্যে ভরা সুন্দর বাংলাদেশটাকে অসুন্দর করে ফেলছি। সুন্দরবনকে অসুন্দর করছি। ইদানীং বিশ্ব ঐতিহ্যের ধারক-বাহক নয়নাভিরাম আমাদের এই সুন্দরবনকে ঝুঁকিতে ফেলে এর চতুর পাশে ভারী শিল্পকারখানা গড়ে তোলার জন্য জমি কেনার হিড়িক পড়েছে। ইতোমধ্যে ৩০০ শিল্পগোষ্ঠী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আশপাশের গ্রামগুলোতে প্রায় ১০ হাজার একর জমি কিনেছেন। যারা জমি কিনেছেন তারা শাসক দলের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী শিল্পগোষ্ঠী এবং সরকারি দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও রয়েছেন। আমরা মনে করি, এর বিরুদ্ধে আরো শক্তিশালী ভূমিকা পালনে পরিবেশবাদীদের এগিয়ে আসতে হবে। পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন সম্প্রতি বলেছেন, সুন্দরবনের পাশজুড়ে যারা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য জমি কেনার অনুমোদন পেয়েছে, তাদের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের কোনো দায়িত্ব নেই। এ ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। দেশের জন্য সুন্দরবন যেমন প্রয়োজন, তেমনি শিল্প প্রতিষ্ঠানও প্রয়োজন। আমাদের বুঝতে কষ্ট হয়, তাহলে কি বন মন্ত্রণালয় সরকারের বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান?
সুন্দরবন আমাদের মাতৃতুল্য। মায়ের মনে ব্যথা দিলে মা যেমন কষ্ট পায় তেমনি সুন্দরবনের মনে ব্যথা দিলে তার মনযাতনায় আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠবে। একটি সুন্দরবন তার দুই রূপ হতে পারে না। শিল্প কারখানা, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে জনজট, যানজট, জলজট এসব ঘটবে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সুন্দরবনের শ্যালা নদীর মধ্যে তৈলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনায় ৭০ কিলোমিটারব্যাপী তেল ছড়িয়ে পড়ার কারণে ৩৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করে এক দীর্ঘমেয়াদি বন বিপর্যয়ের সূত্রপাত ঘটেছে। ভয়াবহ বিপর্যয়ে এত উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণী এবং বন্যপ্রাণীর জীবনহানি ঘটার পরও শাসকদল বলেছিল কিছুই হয়নি। ভবিষ্যতেও কিছু হবে না। আমরা সোচ্চার কণ্ঠে বলতে চাই, ভারতীয় অংশে সুন্দরবনের যেভাবে সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে বাংলাদেশেও সেরকম ব্যবস্থা সময়ের দাবি।
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামিস্ট
যধৎঁহৎধংযরফধৎ@মসধরষ.পড়স



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সুন্দরবনে অসুন্দরের থাবা কেন
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ