দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে এ পৃথিবীতে শুধুমাত্র তাঁর ইবাদত-উপাসনার জন্য সৃষ্টি করেছেন। যাতে ইবাদত-বন্দেগি করে তাঁর যথাযথ পরিচয় লাভ করে তাঁর পরম সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনটাকে সুন্দর করা যায়। চির সুখময় জীবন লাভ করা যায়। আরাম-আয়েশে থাকা যায়। এজন্যই সব নবী-রাসুলগণ, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ি, তাবে তাবেয়ি ও মহান ইমামগণ নিজেদের জীবনের সর্ব সেক্টরে সর্ব হালতে এই মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেছেন। তারা চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষিসহ বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু তাদের অন্তর সর্বদা আল্লাহর মহব্বত-ভালোবাসায় ডুবে থাকত। কোনো সময় আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হতো না। এ সকল মহান মনীষীদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘এরা এমন লোক, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামাজ কায়েম করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না।’ (সুরা নুর : ৩৭)। তারা তো ঐ সকল মহান ব্যক্তিবর্গ যারা প্রচন্ড কনকনে শীতের রাতেও আরামের ঘুম ত্যাগ করে রবের দরবারে হাজিরা দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে যায়। এদের কথা মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। এক জায়গায় বলেছেন, ‘রাতের বেলা তাদের পার্শ¦দেশ বিছানা থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং তারা নিজ প্রতিপালককে ভয় ও আশার সাথে ডাকে।’ (সুরা সাজদা : ১৬)। অন্য জায়গায় এসেছে, ‘তারা রাতের অল্প সময়ই ঘুমাত এবং তারা সাহরির সময় ইস্তেগফার করত।’ (সুরা জারিয়াত : ১৭-১৮) অর্থাৎ রাতের বেশির ভাগ সময় ইবাদতে কাটানোর পরও তারা নিজেদের আমল নিয়ে অহংকার বোধ করে না, বরং ইবাদতের ভুল-ত্রুটির ব্যাপারে চিন্তিত থাকে। ফলে শেষ রাতে আল্লাহর দরবারে বিনয় ও কাকুতি-মিনতির সঙ্গে ইস্তেগফার করে। আরেকটি আয়াতে এসেছে, ‘এবং যারা রাত্রি যাপন করে পালনকর্তার উদ্দেশে সেজদাবনত হয়ে ও দন্ডায়মান হয়ে।’ (সুরা ফুরকান : ৬৪)। সুরা জুমারে এসেছে, ‘তবে কি (এরূপ ব্যক্তি সেই ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে,) যে রাতের মুহূর্তগুলোতে ইবাদত করে, কখনও সেজদাবস্থায়, কখনও দাঁড়িয়ে, যে আখেরাতকে ভয় করে এবং নিজ প্রতিপালকের রহমতের আশা করে? বল, যারা জানে আর যারা জানে না উভয়ে কি সমান? কিন্তু উপদেশ গ্রহণ তো কেবল বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরাই করে।’ (সুরা জুমার : ৯)। অন্যত্র এসেছে, ‘মহিমা ঘোষণা করুন রাত্রির কিছু অংশ ও দিবাভাগে, সম্ভবত তাতে আপনি সন্তুষ্ট হবেন।’ (সুরা তহা : ১৩০)। আরেকটি আয়াতে এসেছে, ‘(হে রাসুল!) তোমার প্রতিপালক জানেন, তুমি রাতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশে, (কখনও) রাতের এক তৃতীয়াংশে (তাহাজ্জুদের নামাজের জন্য) জাগরণ কর এবং তোমার সঙ্গীদের মধ্যেও একটি দল।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল : ২০)।
পবিত্র কোরআনে মহানবী (সা.)-কে তাহাজ্জুদ পড়ার নির্দেশ দানের সঙ্গে সঙ্গে জান্নাতের একটি উঁচু স্তর মাকামে মাহমুদ দানের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে- ‘রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ আদায় করবে, এ হলো তোমার জন্য এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রশংসিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৭৯) মাকামে মাহমুদ আখেরাত ও জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা। মাকামে মাহমুদ ও জান্নাতের সঙ্গে রয়েছে গভীর সম্পর্ক। তা শেষ দিবসে নবীজিকে দান করা হবে। কোনো বান্দা যদি নিয়মিত তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হয় তাহলে আশা করা যায় কোনো এক পর্যায়ে হলেও আখেরাতে নবীজির সাহচর্য তার নসিব হবে।
তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হওয়ার মাধ্যমে নিজ প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। আর রাতের বেলা যেহেতু পরিবেশ শান্ত থাকে, চারদিকে অভন্ড নিরবতা বিরাজ করে তাই তখন তিলাওয়াত ও দোয়া সুন্দর ও সঠিকভাবে সম্পন্ন করা যায় এবং তাতে মনোযোগও দেওয়া যায় পূর্র্ণমাত্রায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই রাত্রিকালের জাগরণ এমন যা কঠিনভাবে প্রবৃত্তি দলন করে এবং যা কথা বলার পক্ষে উত্তম।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল : ৬)।
হাদিসেও তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার অসংখ্য ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে ও বিভিন্নভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ফরজ নামাজের পর সর্বোৎকৃষ্ট নামাজ হলো মধ্যরাতের (তাহাজ্জুদের) নামাজ।’ (মুসলিম : ১১৬৩)। রাতের শেষাংশ দোয়া কবুলের সময়। আল্লাহর কাছ থেকে যেকোনো চাওয়াকে মঞ্জুর করানোর জন্য রাতের শেষাংশ খুবই উত্তম সময়। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মহামহিম আল্লাহ তায়ালা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ থাকাকালে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেন- কে আছ এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি ডাকে সাড়া দেব। কে আছ এমন, যে আমার কাছে প্রার্থনা করবে? আমি তার প্রার্থিত বস্তু তাকে দান করব। কে আছ এমন, যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।’ (বুখারি : ১১৪৫)।
তাহাজ্জুদে রয়েছে মুমিনের মর্যাদা। তাহাজ্জুদ ছাড়া কেউ নেককার হতে পারে না। কোনো ব্যক্তি নেককার আর সে তাহাজ্জুদ পড়বে না এটা হতে পারে না। এ নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। এটি আমাদের পূর্বসূরীদের নিয়মিত আমল ছিল। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা উচিত। কেননা তা তোমাদের পূর্বেকার সজ্জনদের প্রতীক এবং তোমাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের বিশেষ মাধ্যম। এ নামাজসমূহ পাপরাশী বিমোচনকারী।’ (তিরমিজি : ৩৫৪৯)।
মহানবী (সা.) তাহাজ্জুদের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করতেন। তাহাজ্জুদ পড়তে পড়তে তার পদযুগল ফুলে যেত। মুগীরা ইবনে শুবা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী (সা.) এত দীর্ঘ সময় তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন যে, তাঁর পা দুটো ফুলে যেত। তাঁকে বলা হলো আপনি এত কষ্ট করছেন কেন অথচ আপনার পূর্বাপর ত্রুটিসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে (এবং কোরআনে আপনাকে সান্ত¦না দেওয়া হয়েছে) তিনি বললেন, তাই বলে কি আমি (এ মহা অনুগ্রহের জন্য অধিক ইবাদত করে শোকর আদায়কারী বান্দা হব না? (বুখারি : ৪৮৩৬)
নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায়কারীর তাহাজ্জুদ ছুটে গেলে তা কাজা করার সুযোগ রয়েছে। ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের নির্ধারিত অজিফা বা এর কোনো অংশ না পড়েই ঘুমিয়ে পড়ে, তারপর তা ফজর ও জোহরের মাঝখানে পড়ে, তার জন্য এমন সওয়াব লেখা হয় যেন সে রাতেই তা আদায় করেছে।’ (মুসলিম : ৭৪৭) রাসুল (সা.) নিজেও কোনো কারণে তাহাজ্জুদ ছুটে গেলে কাজা করে নিতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রোগব্যাধি কিংবা অন্য কোনো কারণে যদি রাসুল (সা.) তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতে না পারতেন তবে তিনি দিনের বেলায় ১২ রাকাত আদায় করে নিতেন।’ (মুসলিম : ৭৪৬)।
তাহাজ্জুদ সম্পর্কে অনেকের ভুল ধারণা হলো, তাহাজ্জুদ শুধু শেষ রাতেই পড়তে হয়। হাঁ, এটা ঠিক, তাহাজ্জুদ মূলত ঘুম থেকে ওঠে নামাজ পড়ারই নাম, কিন্তু এর বাইরে হাসান বসরি (রহ.)সহ বড় বড় তাবেয়িদের মত হলো এশার পর থেকেই তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত শুরু হয়। এশার পর থেকে যেকোনো নফল নামাজ পড়া হবে তা তাহাজ্জুদ বলে গণ্য হবে এবং রাত জেগে নামাজ পড়ার সওয়াব লাভ করা যাবে। তবে এতে সন্দেহ নেই যে, ভোর রাতে আদায় করলে সে নামাজের মর্যাদা অনেক বেশি। বঞ্চিত হওয়ার চেয়ে প্রথম রাতে পড়ে নেওয়া অনেক ভালো। এশার ফরজ নামাজের পর বিতরের আগে ২/৪ রাকাত তাহাজ্জুদের নিয়তে পড়ে নেওয়া যেতে পারে।
তাহাজ্জুদের সর্বনিম্ন রাকাত সংখ্যা হলো দুই। সর্বোচ্চ রাকাতের কোনো সীমা নেই। হাদিসে কোনো সীমা বলা হয়নি। নবীজি (সা.) সাধারণত ৮ রাকাত পড়তেন দুই দুই রাকাত করে। তিনি বলেছেন, ‘রাতের নামাজ দুই দুই রাকাত করে।’ (তিরমিজি : ৪৩৭)।
রাকাত বেশি হওয়ার চেয়ে দীর্ঘায়িত করার ফজিলত বেশি। বুখারিতে এসেছে, আয়েশা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) তাহাজ্জুদে এত দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, মনে হয় তার পা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হবে। আর নফল নামাজ দীর্ঘায়িত করার মধ্যেও আবার মধ্যে মূল বিষয় হলো কালামে পাকের তিলাওয়াত। এজন্য যথাসাধ্য তিলাওয়াত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত করে নামাজটা প্রাণবন্ত করতে সচেষ্ট হওয়া। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন নামাজ উত্তম? তিনি বললেন, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা।’ (তিরমিজি : ৩৮৭)। তাই আসুন তাবলিগ, তালিম, জিহাদ, প্রশাসনসহ ধর্মীয় ইবাদত ছাড়াও দীনের খালেস ইবাদত তাহাজ্জুদ ও নফল আমলের প্রতি গুরুত্বারোপ করি। এতে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক দৃঢ় ও ঘনিষ্ঠ হবে। অন্যান্য দীনি কাজে বরকত হবে। আল্লাহ আমাদের আমল করার তওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম কাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।