বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মাহমুদ ইউসুফ
মানুষের বেঁচে থাকার অপরিহার্য শর্ত শরীরে নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্তের উপস্থিতি। রক্তের অনুপস্থিতিতে কোনো প্রাণিই বাঁচতে পারে না। ব্লাড ছাড়া মানবজীবন স্পন্দনহীন। তদ্রুপ সুন্দরবন হলো বাংলাদেশের রক্তের যোগানদাতা। রক্তের প্রবাহ ব্যতীত মানুষ শুধুই কঙ্কাল বা স্ট্যাচু। সুন্দরবন বাদ দিলে বাংলাদেশের অবস্থাও তথৈবচ। সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশের খ্যাতি সুন্দরবন ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য। সুন্দরবনের পরিচিতি বাংলাদেশের কারণে ঘটেনি। সুন্দরবন বা সুন্দরবনের হরিণ, বাঘ, সম্পদরাজি স্বমহিমায় মহিমান্বিত বা নিজস্ব বলে বলিয়ান। তাই বাংলাদেশের টিকে থাকা নির্ভর করছে বিশে^র বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ এ বন টিকে থাকবে কিনা তার ওপর।
ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র বলছে, বাগেরহাটের রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র বা শিল্পকারখানা স্থাপনের ফলে ‘অসামান্য এবং বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ’ সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদ বিপন্ন হতে পারে। জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো সরকারকে চিঠি দিয়ে বলেছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় এই বনের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সরকার ব্যর্থ হলে বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান হারাবে সুন্দরবন। বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে সুন্দরবন নাম লেখাবে বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায়’ (প্রথম আলো : ০৩ নভেম্বর ২০১৪)।
তাই সুন্দরবনের আশপাশে কোনো শিল্প কারখানা বা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র মানে এর বিরুদ্ধে লড়াই করার শামিল। তাই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কাজ শুরু করে বাংলাদেশ ও ভারত সুন্দরবনের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধ আরম্ভ করেছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রভাবে এর ভূ-প্রকৃতিতে মারাত্মক ছেদ ঘটবে। ধ্বংস হবে গাছপালা, পশুপাখি। মহামূল্যবান ঔষধি উদ্ভিদাদি থেকে বঞ্চিত হবে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। বিলুপ্ত হবে বিরল প্রজাতির পশুপাখি। দেশ হারাবে তার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। আবহাওয়া ও জলবায়ু তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলবে।
ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, প্লাবনে ল-ভ- হয়ে যাবে দেশ। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে চাষের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে ফসলি ভূমি। চাষযোগ্য জমি নষ্ট হয়ে যাবে। কৃষিযোগ্য কোনো জমি থাকবে না। সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে খুলনা-বরিশাল বিভাগ বসবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে পড়বে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও এর কুপ্রভাব পড়বে।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে হিন্দু সাম্রাজ্য বিস্তারের খায়েশ ব্যক্ত করেছিলেন। ইন্ধিরা গান্ধী, রাজিব গান্ধী, নরসীমা রাও, অটল বিহারী বাজপেয়ী, এল কে আদভানী, মনমোহন সিং, নরেন্দ্র মোদি কেউই এ স্বপ্ন, সংকল্প থেকে সরে আসেননি। বাংলাদেশের সেকুলার-বাম-রামরা তাদেরকে চিনতে পারেননি বা চিনলেও তাদের পক্ষ নিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন দেশ ও জনস্বার্থের বাইরে গিয়ে। কিন্তু চীন, পাকিস্তান, নেপাল ভারতের সহিংস নীতিকে চিনতে জানতে ভুল করেনি। মহারানা প্রতাপ সিংহ, রঘুজি ভোঁসলে, ভাস্কর প-িত, শিবাজি, বঙ্কিমচন্দ্র, তিলক, লাজপত রায়দের ব্রাহ্মণ্যবাদী মনোবিকারের চূড়ান্ত রূপ দিচ্ছে তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত। জুনাগড়-মানভেদার-হায়দারাবাদ-কাশ্মির-সিকিম ওদের কালো হাত থেকে রেহাই পায়নি। আর্য ভারতীয়রা কখনও অনার্য বা অহিন্দুকে মেনে নেয়নি। এক কালে ভারত ছিল দ্রাবিড়দের স্বর্গভূমি; ছিল জৈন, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের তীর্থভূমি। আর্য হিন্দুদের কাছে তাদের বিলুপ্ত ঘটেছে। অবসান হয়েছে মুসলিম রাজশক্তির। এখানেই তারা থেমে থাকেনি। তাদের মনে গেঁথে আছে ইসলাম ও মুসলিম নিধনের দুর্নিবার আকাক্সক্ষা। এ উদ্দেশ্যেই তারা অগ্রসরমান। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তা বাঁধ, টিপাইমুখী বাঁধ, হাইওয়ে, ট্রানজিট, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ সবই একসূত্রে গাঁথা। মসজিদে খুতবা নিয়ন্ত্রণ, পিস টিভি বন্ধ, পিস স্কুল বন্ধ, জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের তা-ব, বিরোধী দল মত দলন, গ্রেফতার, ক্রসফায়ার, গুম, অপহরণ, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ, জাতির বিবেক সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদদের কারারুদ্ধ, সুন্দরবনের ওপর খড়গহস্ত সবকিছুই হিন্দুস্তানের গোপন পরিকল্পনার অংশবিশেষ।
বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী, চট্টগ্রামের বিস্তৃত জমি পড়ে আছে। সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র না করে বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবনের কোলঘেঁষে কেন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হচ্ছে? যে বিদ্যুৎ কারখানার সিংহভাগ মূলধন জোগাবে বাংলাদেশ অথচ মুনাফা ভোগ করবে ভারত। একসাথে ভারতের বহুমুখী লাভ। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কুপ্রভাবে সুন্দরবনের সব জন্তু জানোয়ার, পাখি চলে যাবে ভারত অংশে। লক্ষ বছর ধরে গড়ে ওঠা ভূপ্রকৃতি ধ্বংস হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে দেশ।
ভারত আর বাংলাদেশের ভারত প্রেমিকরা মিলেমিশে বাংলাদেশের বনভূমি, অর্থনীতি, ধর্মীয়, শিক্ষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, সম্পদরাজি ধ্বংসের উলঙ্গ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। আর বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল, পত্রপত্রিকা, বুদ্ধিজীবীরা ভারত ও সরকারের বন্দনায় মুখরিত। দেশের এই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটা তাদের টক শো কিংবা সভা-সেমিনারে স্থান পায় না। এ অবস্থায় জনগণের ইস্পাত কঠিন দৃঢ় ঐক্য এবং আল্লাহর রহমতই সুন্দরবনের রক্ষাকবচ।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।