দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
প্রসঙ্গ: বেশ কিছুদিন যাবত হিজড়াদের বিষয়ে নানান কথা, নানান প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে রাস্তাঘাটে, যানবাহনে তাদের চাঁদা দাবী এবং বিশেষ করে পাড়া-মহল্লার বাসায়-বাসায় জোরপূর্বক ঢুকে পড়ে বাচ্চা-শিশুদের কোলে তুলে নিয়ে নাচানাচি এবং দু’হাজার থেকে দশ-পনের হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দাবী করে বসা; না দিলে বা কালবিলম্ব করলে তাৎক্ষণিক অশ্লীল ভাষায় গালি-গালাজ, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি এমনকি কাপড়-চোপড় খুলে ফেলাসহ হেন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করে না।
সংশ্লিষ্ট হানা-দেওয়া বাড়ি-ঘরের মালিক বা গৃহিনিদের কাছে বাস্তবে তাদের দাবীকৃত অর্থ থাকুক চাই না থাকুক, তাদের কাছে ছাড় বলতে কিছু নেই। প্রতিবেশির কাছ থেকে বা পাশের ফ্লাট থেকে বা পার্শ্ববর্তী বাড়ী থেকে ধার-কর্জ করে হলেও, তাদের দাবীকৃত অর্থ অবশ্যই দিতে হবে; নতুবা কোনোভাবেই নিস্তার নেই। এ যে, কত বড় বাস্তবতা এবং কত নির্মম নির্যাতন তা ভুক্তভোগি ব্যতীত আর কাউকে বলেও বুঝানো যাবে না! অবশ্য রাস্তাঘাটে বা যানবাহনে তারা জোরাজুরি তুলনামূলক কম করে থাকে। যে-কারণে বাইরের সাধারণ জনগণ তাদের রুদ্রমূর্তি ও বাস্তব আচরণ বিষয়ে তেমন ওয়াকিফহাল নয়।
অনেকে প্রশ্ন করে থানা-পুলিশ এদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয় না কেন? পার্শ্ববর্তী কেউ তাৎক্ষণিক জবাব দিয়ে দেয়, এদের কাছে থানা-পুলিশও অসহায়। তাই সংশ্লিষ্টরা মামলা- মুকাদ্দামা করলেও তা গৃহীত হয় না। যে-কারণে ভুক্তভোগিরাও নীরবে সহ্য করে যায়! নির্যাতিত হয়েও কারো কাছে সাহায্য কামনার হাত প্রসারিত করতে পারে না বা করে না।
অবশ্য ইদানিং অনেকেই আবার প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন, হুজুর! এরা তো দেখতে বেশ তাগড়া ও সুস্থ্য-সবল মনে হয়; তা হলে এরা কাজকর্ম করতে পারে না? আবার কেউ কেউ প্রশ্ন করে, আয়-উপার্জন, জাগা-জমি-সম্পদ, দায়-দায়িত্ব ও উত্তরাধিকার বিষয়ে ইসলামী শরীয়তে কি এদের ব্যাপারে কোনো কিছু নেই?
এ ছাড়া, কিছুদিন পূর্বে সরকারী একটি সমাজসেবা অফিস থেকে হিজড়াদের মৃত্যু-পরবর্তী সৎকার, কাফন-দাফন বিষয়েও নির্দেশনা জানতে চেয়ে একটি আবেদন এসেছিল। এ সব প্রশ্ন ও আবেদনের জবাব দিতে গিয়ে বিবেকের তাড়া খেয়ে, পর্যায়ক্রমে এদের ব্যাপারে শরীয়তে কোথায় কি নির্দেশনা রয়েছে, তা যথাসাধ্য সাজিয়ে-গুছিয়ে একত্র করার এ প্রয়াস।
মহান আল্লাহর সৃষ্টি হিজড়া নামক এ জনগোষ্ঠি, যারা আমাদের মতোই ‘শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি’ মানবজাতিরই একটি অংশ। তাই শরীয়তসম্মত সঠিক নির্দেশনার আলোকে এদেরকে প্রকৃত মুসলমান হতে সাহায্য করা এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে জনবল হিসাবে যেন কাজে লাগানো যায়, সেই লক্ষ্যে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসার তাওফীক দিন। আমীন!
সংজ্ঞা ও শ্রেণি:
বাংলা ভাষায় পরিচিত ‘হিজড়া’-কে শরীয়ত তথা কুরআন, হাদীস ও ফিকহের ভাষায় বলা হয় ‘খুনছা’ (হিজড়া)। আভিধানিক অর্থে আরবী ‘খুনছা’ শব্দটির মাছদার বা মূলধাতু হচ্ছে ‘আত-তাখান্নুছ’, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে, নরম হওয়া, দূর্বল হওয়া, ভেঙ্গে পড়া, ত্রুটিযুক্ত হওয়া। খুনছা-কে খুনছা বলার কারণ হচ্ছে, সে পুরুষের তুলনায় ভঙ্গুর হয়, দূর্বল হয়, ত্রুটিযুক্ত হয়। আবার নারীর তুলনায় তার অবস্থা কিছুটা উন্নত হয়। কারণ, তার পুরুষ ও নারী উভয়সুলভ লিঙ্গ সংযুক্ত থাকে। যেমন-
“আল-মুনতাকা গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে, ইমাম আবূ হানীফা র. ও ইমাম আবূ ইউসুফ র. বলেন: ‘যেক্ষেত্রে একজন হিজড়া’র পুরুষ ও নারী সুলভ অঙ্গ একই সঙ্গে হয়ে থাকবে এবং সে তার কোনো একটি দ্বারা প্রস্রাব করে; সেক্ষেত্রে তাকে পুরুষ বা নারী প্রশ্নে, সে হিসাবে গণ্য করা হবে। অর্থাৎ সে যদি পুরুষসুলভ অঙ্গ দ্বারা প্রস্রাব করে, তাকে পুরুষ গণ্য করা হবে আর যদি নারীসুলভ অঙ্গ দ্বারা প্রস্রাব করে তা হলে তাকে নারী বলে গণ্য করা হবে। কেননা তখন তার পক্ষে সেটিই আসল দলীলস্বরূপ গণ্য হবে যা দ্বারা প্রস্রাব নির্গত হয় এবং অপরটি ত্রুটি-রোগ বলে ধর্তব্য হবে” (আল-মুসতালাহাত ওয়াল-আলফাযুল ফিকহিয়্যা: খ-২,পৃ-৫৯, মিসর)।
‘তাখান্নুছ’ মানে ‘মেয়েলী আচরণ করা, মেয়েলী স্বভাবসম্পন্ন হওয়া’; (আল-মু‘জামুল ওয়াফী: পৃ-২৬৪)।
আল্লামা যয়নুদ্দীন ইবন নুজাইম মিসরী (র) বলেন,“ ‘নিহায়া’ গ্রন্থের ভাষ্য হচ্ছে, গ্রন্থকার (‘কান্য’ প্রণেতা) যখন একটি অঙ্গবিশিষ্ট নারী ও পুরষের বিধান আলোচনা শেষ করলেন তখন তিনি দু’অঙ্গ সম্বলিতদের বিধান আলোচনা শুরু করলেন” (আল-বাহরুর রায়িক: খ-৮, পৃ-৩৩৪, যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত)। -এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, সাধারণত বাহ্যিকভাবে হিজড়া’দের লজ্জাস্থানকেন্দ্রিক দু’টি অঙ্গই হয়ে থাকে।
পারিভাষিক অর্থে: “ ‘হিজড়া’ হচ্ছে এমন মানুষ যার পুরুষের অনুরূপ পুরুষাঙ্গ এবং নারীর অনুরূপ গুপ্তাঙ্গ বিদ্যমান অথবা বাস্তবে এদের কারো অনুরূপই নয় বরং তার একটি ছিদ্র বিদ্যমান যা পুরুষ-নারী কারো অনুরূপই নয়” (আল-মুসতালাহাত ওয়াল-আলফাযুল ফিকহিয়্যা: খ-২, পৃ-৬০)। মুফতী আমীমুল ইহসান মুজদ্দেদী বারাকাতী (র) হিজড়ার সংজ্ঞা বিষয়ে লিখেন-
“খুনছা’ শব্দটি ‘খানাছা’ হতে নির্গত, মানে দূর্বলতা, কোমলতা। শরীয়তের পরিভাষায় এমন ব্যক্তিকে ‘হিজড়া’ বলা হয় যার পুরুষ ও নারী উভয়বিধ গুপ্তাঙ্গ রয়েছে; কিংবা তার কোনোটিই নেই। আর ‘জটিল হিজড়া’ বলতে, সে মানুষকে বুঝানো হয় যাকে (সাবালক হওয়ার পূর্বে) পুরুষ ও নারী কোনো দিকেই প্রাধান্য দেওয়া যাচ্ছে না” (কাওয়াইদুল ফিকহি: পৃ-২৮২, আশরাফী বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত)।
প্রিয় পাঠক! উক্ত হিজড়া পরিচিতি ও সংজ্ঞা আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, হিজড়া জনগোষ্ঠির লোকজনকে নারী বা পুরুষ হিসাবে বিভাজন বা শ্রেণিবিন্যাস করতে গিয়ে তাদের মধ্যে এমন স্বল্প বা কিছু সংখ্যক হিজড়াও দেখা যাচ্ছে যাদেরকে উক্ত দু’শ্রেণির কোনোটিতেই অন্তর্ভুক্ত করা যাচ্ছে না অর্থাৎ ‘জটিল হিজড়া’। অবশ্য বাহ্যিক এ জটিলতা সাধারণত সাবালক হওয়ার পূর্বে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে; সাবালক হয়ে গেলে যা সাধারণত অবশিষ্ট থাকে না। বিষয়টি আমাদের পরবর্তী আলোচনা থেকে বোঝা যাবে।
লেখক : মুফতীঃ ইসলামি ফাউন্ডেশন, বায়তুল মোকাররম, ঢাকা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।