বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মো. জুয়েল আক্তার
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের দাবিতে আন্দোলন আজকে নতুন নয়। আমারা যখন ছাত্র ছিলাম, হলের দাবিতে আন্দোলন আমরাও করেছি। আমাদের সময় আন্দোলন হয়েছে হল উদ্ধার করার দাবিতে। আর এখন আন্দোলন হচ্ছে নতুন হল নির্মাণের দাবিতে। এটা বেগবান হতে শুরু করে নাজিমউদ্দিন রোড থেকে যখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সরিয়ে নেয়া হলো কেরানিগঞ্জে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের পর থেকেই জবির শিক্ষার্থীরা সেখানে হল নির্মাণের দাবি করে আসছে। এরই অংশ হিসেবে নতুন হল নির্মাণের সুস্পষ্ট ঘোষণা এবং পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারের জমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে হস্তান্তরের দাবিতে আন্দোলন ও ধর্মঘট পালন করছেন শিক্ষার্থীরা। পরিত্যক্ত কারাগারের জমিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার নামে চারটি হল নির্মাণ করার দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। সেই সঙ্গে সরকারের পরিকল্পনানুযায়ী সেখানে জাদুঘর, গবেষণাকেন্দ্র ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করার আহ্বান জানান তারা। প্রতিষ্ঠার এক দশক পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো শিক্ষার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি চলমান জঙ্গি ইস্যু নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা বাসা-বাড়ি ও মেসে আতংকের মধ্যে জীবনযাপন করছে। হল না থাকায় প্রায় সকল শিক্ষার্থীকেই থাকতে হয় মেস করে। জগন্নাথের শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ করে জানা যায় এখন প্রায়ই পুলিশ হানা দেয় তাদের মেসে। সব থেকে বিপদে পরে যাদের কোনো পরিচিত বা আপনজন ঢাকায় নেই তারা। কেননা, না জেনে অনেক সময় ভুল যায়গায় উঠে পরে তারা আর এতেই ঘটে যতো বিপত্তি। কিছু বুঝে উঠার আগেই তাদের যায়গা হয় শ্রী ঘরে। সারাক্ষণই আতঙ্কে সময় পার করতে হয় জবির শিক্ষার্থীদের।
পুরান ঢাকায় অধিকাংশ এলাকার ভবনগুলো রংচটা, পলেস্তার উঠা, জরাজীর্ণ। ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে আছে একটির গায়ে অন্যটি। নিচতলায় লোহালক্কড়ের কারখানা, চিপা গলি, অন্ধকার সিঁড়ি এখানকার চেনা চিত্র। এমন পরিবেশের সঙ্গে কেবল লেখাপড়ার জন্যই প্রতিনিয়ত লড়াই করে থাকতে হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের। পুরান ঢাকার প্রায় সব বাসার একই হাল। তাও ভাড়া পাওয়া যায় না। অনেক অনুরোধের পর ব্যাচেলরদের ঠাঁই করে নিতে হয় ষষ্ঠ বা সপ্তম তলায়। এরপর মেসে প্রায়ই নানা রকম সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। স্থানীয় লোকজন প্রায়ই মেসে নানা ধরনের ঝামেলা সৃষ্টি করে। কারণে-অকারণে প্রায়ই তাদের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করে। মেসের ভেতর জোর করে মাদক সেবন আর জুয়ার আড্ডা বসায়। বাধা দিলে মারপিট করে। মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তাদের ভাষ্য, ‘আমগোর মহল্লায় আমরা যা বলুম তাই মানতে হইব। ভাল না লাগলে এলাকা ছাইড়া জাউগা।’ এছাড়া মেসের পরিবেশও থাকার উপযোগী না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েও তাদের প্রতি মাসে খাওয়া-থাকা বাবদ প্রায় ৬-৭ হাজার টাকা খরচ হয়। এর পর মালিক প্রতিবছরে ১-২ বার ভাড়া বাড়ায়। এক রুমে ৫-৬ জন গাদাগাদি করে থাকতে হয় ভাড়ার টাকা কমানোর জন্য। তাতেও হয় না। এখানে কোনো রিডিং রুম নেই। কোনো বিনোদনের জায়গা নেই। এতে একাডেমিক পড়ালেখার সুযোগ খুব কম পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। আর বাড়তি জ্ঞানচর্চা করার তো প্রশ্নই ওঠে না। প্রতিদিন ক্লাস করতে গিয়ে তাদের এমন অসহনীয় কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। ক্যাম্পাসে হল না থাকায় এমন দুর্ভোগ তাদের নিত্যসঙ্গী।
এর সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন আতঙ্ক, ব্যাচেলর ভাড়া হবে না। ব্যাচেলরদের কেউ মেসভাড়া দিতে চায় না। যদিও অনেক তদবিরে মেলে। তাতে সমস্যার শেষ নেই। প্রায়ই পানি থাকে না। সকাল ৯টার পর পানি বন্ধ। রাত ১১টার পর গেট বন্ধ। জানালায় দাঁড়ানো যাবে না। ছাদে ওঠা নিষেধ। এমন আরও অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় এখানকার শিক্ষার্থীরা। কমবেশি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই আবাসিক ব্যবস্থা আছে। অথচ ২৩ হাজার ছাত্রছাত্রীর এ ক্যাম্পাসের কেউ হলে থাকতে পারে না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর সবাই জানতে পারে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েও এখানে কোনো হল নেই।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সঙ্কট নিয়ে নতুন করে আলোচনা করার দরকার পরে না। তারপরেও বলতে হয়, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এই বিশ্ববিদ্যালয় এক সময় ছিল ব্রাহ্মদের স্কুল। জ্ঞানের আলো ছড়াতে ১৮৫৮ সালে শুরু হয় যার পদযাত্রা। ১৮৭২ সালে এর নাম বদলে রাখা হয় জগন্নাথ স্কুল। পরে তা উন্নীত হয় কলেজে। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পরিবর্তিত হয় ১৯৪৯ সালে। সর্বশেষ এই প্রতিষ্ঠানটি ২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ পাসের মাধ্যমে একটি পূর্ণাজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ হাজার শিক্ষার্থী, ৫ শতাধিক শিক্ষক এবং তিন শতাধিক কর্মচারীদের কোনো আবাসিক ব্যবস্থা নেই। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে কাগজে-কলমে এক ডজন হল আছে। তাতে শিক্ষার্থীদের স্থান নেই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একাধিকবার ফুঁসে উঠেছে তাদের জায়গা দখলমুক্ত করতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সফলতা আসেনি।
তারপরেও জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার পর থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নানা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ৩৫তম বিসিএস-এ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮১ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরির জন্য মনোনীত হয়েছে। এটা সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিচারে ঢাকা বিম্ববিদ্যালয়ের পরেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান বলা যায়। ভর্তি পরীক্ষার সময়ও দেখা যায় ঢাবির পরেই সব থেকে বেশি শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতা করে জগন্নাথে ভর্তি হওয়ার জন্য। মাত্র ১০-১১ বছরের মধ্যে এমন অবস্থান অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় করতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
একটু আলোচনা না করলেই নয়, কীভাবে দখল হলো জবির হলগুলো। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থাকা অবস্থায় এর হল ছিল ১২টি। সরকারের মৌখিক নির্দেশে পুরান ঢাকার ১২টি পরিত্যক্ত বাড়িতে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বসবাস করতেন। ১৯৮২ সালে এরশাদ সরকারের সময় দখলে চলে যায় ভবনগুলো। এই বাস্তবতায় ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে জগন্নাথ কলেজ। এরপর আমরা হলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করি। আন্দোলনের মুখে প্রথম ভিসি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম খান বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখল সম্পত্তির খোঁজ নিতে একটি কমিটিও গঠন করেন। দীর্ঘদিন কাজ করে ২০০৮ সালের ২৯ জুন চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেয় কমিটি। তারা জানায়, ১২টির মধ্যে ছয়টি হলই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সম্পত্তি। বাকি জায়গা খাসজমি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দখলে থাকায় এগুলোর দখল পেতেও সমস্যা হবে না। রিপোর্টের কপি শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও জমা দেয়া হয়। এরপর আরও পাঁচবার কমিটি গঠনের পর ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের মুখে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়। তাতেও কোনো ফল হয়নি। এভাবে বারবার আন্দোলন হয় আর উদ্ধার কমিটি গঠন হয়ে থেমে যায়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না।
এবার আসি পরিত্যাক্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের আলোচনায়। পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে ১৭৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। কিন্তু বর্তমানে কেন্দ্রীয় কারাগার সরিয়ে নেওয়া হয়েছে কেরানীগঞ্জে। আর নাজিমউদ্দিন রোডের জায়গায় হবে বিনোদনকেন্দ্র। পরিকল্পনা অনুযায়ী এখানে থাকছে শপিংমলও। সেই সঙ্গে হবে সবুজ-আধুনিক পার্ক, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ব্যায়ামাগার ও কনভেনশন সেন্টার এবং ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণে জাদুঘর। বিশাল আয়তনের এ এলাকায় আরও থাকবে পর্যাপ্ত হাঁটার জায়গা। সেজন্যে ভাঙাভাঙির কাজও শুরু করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
অন্যদিকে হল শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি। যতোদূর জানতে পারছি, এই দাবির প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন একাত্বতা ঘোষণা করেছে। গত ৮ আগস্ট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮তম জরুরি একাডেমিক সভায় কেন্দ্রীয় কারাগারের পরিত্যক্ত জমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থায়ীভাবে দিতে একাডেমিক কাউন্সিল সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর আগে ২০১৪ সালের ২৩ মার্চ কেন্দ্রীয় কারাগারের জমির দাবিতে স্বরাষ্ট্রসচিব বরাবর আবেদন করে। কিন্তু এখনো এ বিষয়ে কোনো সাড়া মেলেনি। কেন সাড়া মেলেনি তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারবে। শিক্ষার্থীদের হল আন্দোলন এটি যৌক্তিক দাবি। তবে কোনোভাবেই আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা করা যাবে না। সরকার যদি জমিটা শিক্ষার উন্নয়নে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে বরাদ্দ দিয়ে নির্দেশনা দেয় যে জাতীয় চার নেতা ও বঙ্গবন্ধুর নামে হল করা ও যাদুঘর নির্মাণ করার তাহলে তাদের স্মৃতি যেভাবে সংরক্ষণ করা যাবে অন্য কোনো কিছু করে, সেভাবে সম্ভব কিনা তা কর্তৃপক্ষকে ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।
য় লেখক : প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঢাকা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।