পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
হালদার ক্ষতি আর নয়। কর্ণফুলীর পর দেশের দ্বিতীয় প্রধান ‘অর্থনৈতিক নদী’ ও ‘মাছের খনি’ খ্যাত হালদা অবশেষে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বের শীর্ষে উঠে এলো। এই নদীকে সুরক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার।
হালদাকে ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হয়েছে। মাছ, ডলফিনসহ নদীটির বিচরণশীল প্রাণী, জীববৈচিত্র্য শিকার থাকবে নিষিদ্ধ। মুজিববর্ষের অঙ্গীকার অনুযায়ী গত ২২ ডিসেম্বর এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। সরকারি গেজেট মোতাবেক বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ তথা হালদা নদী এলাকায় ১২ দফা নিষেধাজ্ঞা ও শর্ত কার্যকর হবে। এশিয়ায় মিঠাপানির (রুই-কাতলা কার্প জাতীয়) বড় জাতের মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র জোয়ার-ভাটা নির্ভর নদী হালদা ‘মাছের ব্যাংক’ ও ‘জীন ব্যাংক’ হিসেবে বিশ্বখ্যাত। বিদেশি গবেষকগণ হালদা পরিদর্শনকালে নদীটির মৎস্য-বীজের রত্ম-ভান্ডার দেখে বিমোহিত হন। কিন্তু নির্বিচারে মা-মাছ, ডলফিন নিধন, অবাধে জাল ফেলে মাছ শিকার, দখল-দূষণ-ভরাট, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, বালু উত্তোলন, ড্রেজার দিয়ে তলদেশে খোঁড়াখুঁড়ি, পোড়া তেল, রাসায়নিক, নদীতীরে গড়ে উঠা ট্যানারি-কাগজকল-পোলট্রি, বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য নিঃসরণ, উজানে পাহাড়ি জুম ও তামাক চাষের বর্জ্য ভেসে আসা, নদীপাড়ে বৃক্ষ নিধন, পানি নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও রাবারড্যাম নির্মাণ, নদীর বাঁক কেটে ফেলাসহ নানা কারণে স্বাভাবিক গতিপথে বাধা-বিঘ্ন ইত্যাদি কর্মকান্ডে মৎস্য ব্যাংক হালদা বিপন্ন দশায় পড়ে।
এককালে ৭৬ প্রজাতির মাছ হালদায় পাওয়া যেত। ইতোমধ্যে প্রায় ২০ প্রজাতির মাছ, গাঙ্গেয় ডলফিন, বিভিন্ন প্রাণী বিপন্ন প্রায়। বিশেষজ্ঞ, সচেতন নাগরিক মহলের দীর্ঘদিনের দাবি এবং চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তর ও হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হালদা নদীকে সুরক্ষার উদ্যোগ নেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকীতে হালদাকে ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় ঐতিহ্য বা হেরিটেজ’ ঘোষণার মাধ্যমে নদীটিকে সংরক্ষণের দাবি জোরালো হয়। সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই হালদা সুরক্ষার জাতীয় গুরুত্ব স্বীকৃত ও পূরণ হলো নাগরিক দাবি।
হালদা নদীকে সুরক্ষিত ঘোষণার ফলে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিকাউশ জাতীয় মা-মাছেরা অবাধে ডিম ছাড়বে। হালদা যোগান দেবে বার্ষিক হাজার কোটি টাকার ডিম-রেণু-পোনা। দেশের মিঠাপানির মৎস্যসম্পদ হবে সুসমৃদ্ধ। গতকাল শনিবার দৈনিক ইনকিলাবের আছে এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন হালদা সংরক্ষণে নিবিড় ও নিরবচ্ছিন্ন তত্ত্বাবধানকারী বিদায়ী চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক (জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র উপ-সচিব হিসেবে সদ্যবদলি) মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞানী হালদা রিসার্চ সেন্টারের সমন্বয়ক প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেন, হালদা নদীকে সুরক্ষায় আমরা ধারাবাহিক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। মা-মাছ নিধন রোধ, ড্রেজার চলাচল ও বালু উত্তোলন বন্ধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, বর্জ্যসহ নানাবিধ দূষণ বন্ধ, মৎস্যসহ প্রাণিকুলের অবাধ বিচরণে অভয়ারণ্য গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। সচেতন নাগরিক, বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক মহলসহ সবার চেষ্টার ফলে এ বছর হালদায় মা-মাছের ডিম আহরণ এক যুগের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণার ফলে উত্তরোত্তর ডিম আহরণ ও মৎস্য প্রজনন বৃদ্ধি পাবে।
বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণার সুফল পেতে ডিম সংগ্রাহক, হ্যাচারি উদ্যোক্তা, জেলেসহ এলাকাবাসীর করণীয় সম্পর্কে হালদা পাড়ে গড়দুয়ারায় গতকাল দিনভর মাঠ-বৈঠক করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ সেন্টারের গবেষক প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া। মাঠ-বৈঠক থেকে তিনি ইনকিলাবকে জানান, নদীমাতৃক বাংলাদেশে এই প্রথম দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক নদী, মৎস্য ব্যাংক হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করা হলো। এরফলে হালদার অনন্য বৈশিষ্ট্য ও অবদান জাতীয় স্বীকৃতি পেলো। ওয়ার্লড হেরিটেজের পথে একধাপ এগিয়ে গেল। এতদিন হালদা সংরক্ষণে সরকারের নির্দিষ্ট কোনো সংস্থা বা বিভাগের হাতে দায়িত্ব ছিলনা। এখন লিগ্যাল অথরিটি তৈরি হবে। হালদা অতীত অবস্থান ও ঐহিহ্য ফিরে পাবে। ড. কিবরীয়া বলেন, এই ঘোষণার সুফল পেতে হলে উজানে (মানিকছড়ি) তামাক চাষ, ভূজপুর রাবার ড্যাম, সুইচ গেইট, বিভিন্ন উৎস থেকে বিষাক্ত বর্জ্য নির্গমন বন্ধসহ বিরাজমান সমস্যাগুলো নিরসনে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। হালদা নদীর সঙ্গে যুক্ত খালগুলো উন্মুক্ত ও খনন অপরিহার্য।
বঙ্গবন্ধু হেরিটেজের শর্ত
হালদাকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণার ফলে এখন থেকে এ নদীতে কেউ মাছ এবং অন্যান্য বিচরণশীল প্রাণী শিকার করতে পারবে না। এ সংক্রান্ত জারি করা সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশগত মান উনয়নের মাধ্যমে রুই জাতীয় মাছের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও গাঙ্গেয় ডলফিনের আবাসস্থল সংরক্ষণের লক্ষ্যে খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় ও মানিকছড়ি উপজেলা, চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি, রাউজান, হাটহাজারী উপজেলা এবং পাঁচলাইশ থানার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হালদা নদী এবং নদী তীরবর্তী ৯৩ হাজার ৬১২টি দাগের ২৩ হাজার ৪২২ একর জমিকে বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
সরকারের গেজেটে হালদা নদী সুরক্ষায় ১২ দফা নিষেধাজ্ঞা ও শর্ত কার্যকর হবে। যেমন- হালদায় কোনো মাছ ও বিচরণশীল প্রাণী ধরা বা শিকার করা যাবে না। তবে মৎস্য অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে প্রতিবছর প্রজনন মৌসুমে নির্দিষ্ট সময়ে মাছের নিষিক্ত ডিম আহরণ করা যাবে। প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী কোনো প্রকার কার্যকলাপ করা যাবে না। ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট বা পরিবর্তন হয়, এমন কাজ করা যাবে না। নদীর চারপাশে বসতবাড়ি, শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পয়ঃপ্রণালী সৃষ্ট বর্জ্য ও তরল বর্জ্য নির্গমণ করা যাবে না। কোনো অবস্থাতেই নদীর বাঁক কেটে সোজা করা যাবে না। হালদা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ১৭টি খালে প্রজনন মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই) মৎস্য আহরণ করা যাবে না। মাছের প্রাক প্রজনন পরিভ্রমণ সচল রাখার স্বার্থে হালদা নদী এবং সংযোগ খালের পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। রুই জাতীয় মাছের প্রাক-প্রজনন এবং প্রজনন মৌসুমে (মার্চ থেকে জুলাই) ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচল করতে পারবে না।
ডিম সংগ্রহে রেকর্ড
হালদা নদীতে গত ২৩ মে আহরিত হয় ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম। যা এক যুগে সর্বোচ্চ রেকর্ড। ২০১৯ সালে ৭ হাজার কেজি, ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল ২২ হাজার ৬৮০ কেজি (দশ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ), ২০১৭ সালে এক হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮শ’ কেজি, ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি, ২০১৩ সালে ৬২৪ কেজি, ২০১২ সালে এক হাজার ৬শ’ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়।
উপযুক্ত পরিবেশ ও আবহাওয়ায় (‘জো’) ঝাঁকে ঝাঁকে রুই কাতলা মা-মাছ নদীর তলদেশ থেকে উঠে ডিম ছাড়ে। ডিম সংগ্রাহক অভিজ্ঞ জেলেরা নৌকা ও জাল নিয়ে বিশেষ কৌশলে ডিম সংগ্রহ করেন। হালদার পাড়ে কুয়াগুলোতে নিয়ন্ত্রিত পানি ও তাপমাত্রায় ডিম থেকে রেণু, পোনা ফোটানোর পর বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলসহ সারাদেশের পুকুর দীঘিতে সরবরাহ হয়। বিশেষজ্ঞগণ জানান, হালদার পোনার চাহিদা খুবই বেশি। কেননা এই ডিমে ফোটানো রেণু পোনা দ্রæত বর্ধনশীল। যা কম সময়েই ঢাউস সাইজের রুই কাতলা মাছে পরিণত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে হালদা নদীর প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক অবদান কমপক্ষে ৮শ’ কোটি টাকার। বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ ঘোষণার ফলে তা আরও বিস্তৃত হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।