বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
হুজুর (সা.)-এর ২৩ বছরের নবুওয়াতি জীবনে ১৩ বছর মক্কায় কাফের-মোশরেকদের নিষ্ঠুর অত্যাচার নির্যাতন ও তাঁর তবলীগের পথে কঠিন ও তীব্র গতিরোধের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। সে সময় তাঁর ও নগণ্য সংখ্যক মুসলমানের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রæর নিরাপত্তার প্রশ্ন ছিল।
মদীনায় হিজরতের পর হুজুর (সা.) মাত্র দশ বছর তবলীগ প্রচারের সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি মদীনার ইহুদী-মোনাফেক ও মক্কার কাফেরদের নানামুখী ষড়যন্ত্র ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সৃষ্ট যুদ্ধ পরিস্থিতির সফল মোকাবিলা করেন তাঁর জানেসার সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে। প্রকৃত পক্ষে মদীনা হতেই শুরু হয় ইসলামের অগ্রযাত্রা। তাই সীরাত লেখকদের বর্ণনা অনুযায়ী, হুজুর (সা.)-এর সর্বমোট ২৩ বছরের নবুওয়াতি জীবনে ইসলাম প্রচারের ফলে তাঁর দুনিয়া হতে বিদায়কালে দেড় হাজার মাইল দীর্ঘ এবং ছয়শ মাইল প্রশস্ত একটি স্বতন্ত্র ইসলামীরাষ্ট্র তিনি রেখে যান, যা ছিল অসংখ্য জাতি-গোত্রের গৃহযুদ্ধের প্রাচীন কেন্দ্রবিন্দু। তবলীগের মাধ্যমে তিনি সকলকে একই কওম বা জাতিতে পরিণত করেন এবং সকলকে একই দ্বীন ধর্মে সমবেত করেন। অতঃপর তিনি বিশে^র রাজণ্যবর্গ ও স¤্রাটগণের নিকট তবলিগী চিঠিপত্র ও প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন। পরিণতিতে বাহরাইনের বাদশাহ, গাসসানের রাষ্ট্র প্রধান, সিরিয়ার গভর্নর, ইয়েমেনের আমির, নইজদের শাসনকর্তা, মিশরের আজিজ, হাবশার বাদশাহ এবং দামেস্কের প্রধান প্রমুখ হুজুর (সা.)-এর নবুওয়াতের প্রতি স্বীকৃতি দান ও ইসলাম গ্রহণ করেন।
এভাবে ইসলামের আলো আরব বিশে^র বাইরেও দ্রæত ছড়িয়ে পড়ে। হিজরি ৮ সালে হুজুর (সা.) দশ হাজার সাহাবাকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা জয় করেন এবং খানা-ই কাবাকে প্রতিমা মুক্ত করেন। এ ঐতিহাসিক বিজয়ের সময় সাধারণ ক্ষমা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মক্কা বিজয়ের ফলে কোরেশদের ইসলাম গ্রহণের মধ্য দিয়ে আরবের অধিকাংশ গোত্র মুসলমান হয়ে যায়। মক্কাবাসীদের ইসলাম গ্রহণ করা যেন সমগ্র আরবে শিরক ও মূর্তি পুজার অবসান ঘটায়।
হুজুর (সা.)-এর জীবদ্দশায় তাঁর তবলীগ প্রচারের ফলে ইসলামের বিস্তৃত সীমানার এক সংক্ষিপ্ত চিত্র উপরে তুলে ধরা হয়েছে। এবার তাঁর তথা কথিত ‘দরিদ্র জীবনের’ ওপর কিছুটা আলোকপাত করা যাক।
যুক্তি প্রদান করা হয় যে, আল্লাহ কোরআনে তাঁকে ফকির বা অভাবী বলেছেন এবং হাদীসে হুজুর (সা.) ‘ফকর’ অভাবকে তাঁর গর্ব বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ দুটি বিষয় ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। প্রথমে কোরআনের একটি আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ওয়া ওযাজাদাকা আয়িলান ফা আগনা।’ অর্থাৎ, তিনি আপনাকে পেলেন নিঃস্ব অবস্থায়। অতঃপর অভাব মুক্ত করলেন। (সূরা দোহা : আয়াত- ৮)।
আয়াতে বর্ণিত ‘আয়িলান’ শব্দের অর্থ নিয়ে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে তা নিরসন করা প্রয়োজন। কোনো কোনো প্রসিদ্ধ আরবি তাফসিরে ‘আয়িলান’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে ‘ফকিরান’ শব্দ দ্বারা। বাংলায় ফকির শব্দের অর্থ অভাবী, দরিদ্র, যে মানুষের কাছে হাত পাতা, ভিক্ষুক, নিঃস্ব ইত্যাদি। আবার এক শ্রেণীর আধ্যাত্মিক সাধককেও ফকির বলা হয়। ‘আয়িলাতুন’ শব্দের মূল আয়লাতুন যার অর্থ অভাব। কোরআনে আল্লাহ বলেন : যদি তোমরা দারিদ্রের আশংকা কর, তবে আল্লাহ ইচ্ছা করলে তার নিজ করুণায় তোমাদেরকে অভাব মুক্ত করবেন। (সূরা তওবা : আয়াত ২৮)।
‘আয়লাতুন’ অর্থ ফকর ও ফকির করা হয়েছে। অর্থাৎ. অভাবগ্রস্ত ও অভুক্ত থাকা। সূরা দোহার আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে ‘আয়িলান’ অর্থাৎ দরিদ্র, নিঃস্ব, অভাবী বলা হয়েছে, কিন্তু ভিক্ষুক বলা হয়নি। হুজুর (সা.) ভিক্ষাবৃত্তির কঠোর সমালোচনা করেছেন। বর্ণিত বিবরণের আলোকে বলতে হয়, হুজুর (সা.)-এর নবুওয়াতপূর্ব অবস্থার কথা আয়াতে বলা হয়েছে, যখন তিনি সাংসারিক হননি হজরত খাদীজা (রা.)-এর সাথে ব্যবসায়িক ও তাঁর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এবং নবুওয়াত জীবনে গণিমতের অর্থ লাভ ইত্যাদি তাঁর সম্পদের অধিকারী হওয়ার পার্থিব কারণ।
মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতি জীবনের পূর্বেই তিনি অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। বিষয়টি স্পষ্ট করে বলার জন্য নবুওয়াতের কিছু বছর পূর্বের দিকে তাকানো জরুরি। হুজুর (সা.)-এর পিতা আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মোত্তালেব ২৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। এরপর রবিউল আউয়াল মাসে হুজুর (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। দাদা আবদুল মোত্তালেব তাঁর অভিভাবকত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৬ বছর বয়সে মাতা হজরত আমেনা এবং ৮ বছর দুইমাস দশ দিন পর দাদারও ইন্তেকাল হয়ে যায়। এ জন্য তার পিতৃব্য আবু তালেব তার অভিভাবক হন। ১২ বছর দুই মাস বয়সে ব্যবসার উদ্দেশ্যে চাচার সাথে তিনি সিরিয়া গমন করেন। এতীম অবস্থায় এটি ছিল তাঁর জীবনের প্রথম অধ্যায়।
২৩ বা ২৪ বছর বয়সে হজরত খাদীজা বিনতে খোওয়াইলেদের বাণিজ্যসামগ্রী নিয়ে তাঁর গোলাম মায়সারাসহ সিরিয়ায় দ্বিতীয় সফরে গমন করেন। এ সফরে হুজুর (সা.)-এর কয়েকটি মোজেযা প্রকাশ পাওয়ার কথা মায়সারা বর্ণনা করেন। ২৫ বছর দুই মাস দশ দিন বয়সে হজরত খাদীজার সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তখন খাদীজার বয়স ৪০ বছর। তিনি বিধবা ছিলেন, ইতিপূর্বে তাঁর দুই বিয়ে হয়েছিল। সেই দুই স্বামীর পক্ষে দুইজন করে চার সন্তান ছিল। তিনি হজরত খদীজার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলে তাঁর সমস্ত ধন সম্পদের অধিকারী হন। হুজুর (সা.)-এর বয়স যখন পঞ্চাশ বছর তখন হজরত খাদীজা ৬৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। এই বিবরণ দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, হুজুর (সা.) নবুওয়াত লাভের পূর্ব হতেই ধনসম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন। তাঁর সে জীবনও অবশ্যই অভাব মুক্ত ছিল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।