Inqilab Logo

বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভাঙন দূষণ দুর্ভোগ

বছরজুড়ে ঢাকার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি : চলাচলের অযোগ্য অর্ধেক

ইয়াছিন রানা | প্রকাশের সময় : ১১ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

ভাঙা রাস্তা, ভাঙা রাস্তার কারণে পরিবেশ দূষণ আর দুইয়ে মিলে রাজধানীবাসীর ভোগান্তি চরমে। প্রতিবছরই ঢাকার দুই মেয়র, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলে আসছেন, আগামী বছর রাজধানীবাসীর দুর্ভোগ থাকবে না। সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান করে রাজধানীর উন্নয়ন করা হবে। কিন্তু তাদের বক্তব্যের সাথে কাজের সত্যতা মিলছে না। অপরিকল্পিত উন্নয়ন কাজের কারণে ভাঙা রাস্তা ও বায়ু দূষণের ভোগান্তি সহ্য করে আসছেন নগরবাসী। ঢাকার দুই সিটির মেয়র নানা উদ্যোগ নিলেও সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয় করতে পারছেন তারা। ফলে নগরবাসীর ভোগান্তিও কমছে না। দূষণে মানুষ ঠান্ডা, কাশি, শ্বাসকষ্টসহ বহুবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

সূত্র জানায়, বর্তমানে ঢাকা শহরের প্রায় ৩০ শতাংশ রাস্তা ভাঙা। এ ভাঙার কারণে ঢাকার অর্ধেক রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মোট সড়কের পরিমাণ প্রায় ৩৪০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ১০২০ কিলোমিটার সড়ক ভাঙাচোরা। পুরো রাজধানী জুড়ে চলছে ঢাকা ওয়াসা, তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, ডেসকো, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিআরটি’র উন্নয়ন কাজ। আর এ কাজের কারণে রাজধানীর বায়ূ দূষণ বিশ্বের সব শহরের চেয়ে বেশি।

রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর থেকে বিমানবন্দর, কাওলা থেকে বনানী ফ্লাই ওভারের কাজ চলছে। এ রাস্তায় কোন পথচারী হেটে গেলে তার চেহারা চেনা যায় না, ধূলাবালি মেখে চেহারা পরিবর্তন হয়ে যায়। তুরাগ, দক্ষিণ খান, উত্তরখানের রাস্তা ক্ষতবিক্ষত। দক্ষিণখানে চলছে ঢাকা ওয়াসার পানির পাইপ বসানোর কাজ। হাউজবিল্ডিং থেকে দিয়াবাড়ি যাবার রাস্তায় প্রচুর ধূলাবালি। বসুন্ধরা থেকে নতুন বাজার গুলশান-২ হয়ে বনানী পর্যন্ত ডেসকোর ভূগর্ভস্থ্য বিদ্যুৎ লাইন বসানোর কাজ হচ্ছে। এ কাজ অনেকটুকু হয়ে গেলেও রাস্তার কার্পেটিং করা হচ্ছে না। ফেলে রাখা বালু এবং ইটের কারণে বায়ু দূষণ হচ্ছে। মধ্যবাড্ডা থেকে আফতাব নগরেও চলছে ডেসকোর কাজ। এখানেও একই অবস্থা।

ফার্মগেট থেকে চন্দ্রিমা উদ্যানের সামনে পর্যন্ত চলছে ড্রেনেজের কাজ। উত্তরার পিছন দিক থেকে শুরু হওয়া মেট্রোরেলের কাজ চলছে মিরপুর, ফার্মগেট, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেস ক্লাব, পল্টন হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত। কয়েক বছর ধরে এ উন্নয়নের ভোগান্তি পোহাচ্ছে নগরবাসী। এছাড়া মিরপুর ১০ নম্বর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ড্রেনেজের কাজ চলছে। মাত্র এক লেনে গাড়ি চলাচল করছে। কালশি এলাকায় ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজের জন্য দীর্ঘদিন ধরে মারাত্মক ধুলোবালুর সৃষ্টি হচ্ছে। একদিকে ক্ষতবিক্ষত সড়ক। অন্যদিকে ধুলোবালু সৃষ্ট বায়ুদূষণে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। মিরপুর-১১ নম্বর ভাষানী মোড় থেকে লালমাটিয়া সড়ক, মিরপুর-১২ নম্বর সড়কে ড্রেনেজ সংস্কারের কাজ চলছে, মিরপুর মোহাম্মদীয়া সড়ক, বিহারী পল্লী সড়কটি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার কাজের জন্য বন্ধ। তুরাগের শাপলার মোড় থেকে ওয়ালটন মোড়, রানাভোলা ৬ নম্বর সড়কে ‘সড়ক, ফুটপাত ও ড্রেনেজ’র উন্নয়ন কাজ চলছে। পুরান ঢাকার বংশাল থেকে বাংলাদেশ মাঠ পর্যন্ত সড়কটি দীর্ঘদিন থেকে খুঁড়ে ফেলে রাখা হয়েছে। মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনের সড়কেরও বেহাল দশা। হাজারীবাগে দীর্ঘ তিনমাস ধরে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে।

ধুলো দূষণে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে পানি ছিটানো হলেও সেটা তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। কেননা ৩০-৪০ মিনিট পরে সেটা আগের অবস্থায় চলে আসে। ঢাকা মহানগরীর সড়ক খনন নীতিমালা ২০১৯ অনুযায়ী সব ধরনের উন্নয়ন কাজের খোঁড়াখুঁড়ি দিনের পরিবর্তে রাতে করা বাধ্যতামূলক হলেও বাস্তবে সেটা লংঘন হচ্ছে। এছাড়া উন্নয়ন কাজে জড়িত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওপর দায়িত্ব বর্তায় ওই সড়কের সমস্যা লাঘবে ভূমিকা রাখা। এক্ষেত্রে সড়ক ভেঙে গেলে যথাসময়ে সংস্কার এবং অন্য কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে তা সমাধান করবে। আর ধুলোবালি রোধে নিয়মিত পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করবে। বিধান অনুযায়ী, এটা বাধ্যতামূলক হলেও কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেসব মানছে না। সড়ক খনন নীতিমালায় ওয়ান স্টপ সমন্বয় সেল গঠনের সুপারিশ থাকলেও সেটা বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না।

বায়ূদূষণরোধে নির্মানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি পরিবেশ অধিদফতরের নির্দেশনা হলো রাজধানীতে সেবা সংস্থাগুলোর উন্নয়নকাজ পরিচালনায় ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানো, নির্মাণসামগ্রী ঢেকে পরিবহন ও মজুদ করা। যত্রতত্র ফেলে না রাখা এবং ধুলিদূষণ নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত বেষ্টনী ব্যবহার করতে হবে। সেই সঙ্গে রাস্তার পাশে ড্রেন বা নর্দমা থেকে ময়লা বা বর্জ্য অপসারণ করে তা ফেলে না রেখে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যেতে হবে। রাস্তার নানাবিধ কাজ যথাসম্ভব রাতে করা ও নির্ধারিত স্থানটি যতদূত সম্ভব ঢেকে রাখা এবং দৈনিক একাধিকবার পানি ছিটাতে হবে। রাস্তায় বিভিন্ন সার্ভিস ফ্যাসিলিটির মধ্যে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন সংস্থার স্থাপন বা মেরামতে বার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন এবং একই রাস্তা বারবার খোঁড়াখুঁড়ি করা যাবে না।

একই সঙ্গে সার্ভিস ফ্যাসিলি স্থাপন বা মেরামত শেষে ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে দ্রæততম সময়ের মধ্যে রাস্তা কার্পেটিং করে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। উন্মুক্ত স্থানে আবর্জনা রাখা ও পোড়ানো রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ধুলা যাতে না ওড়ে সে জন্য প্রতিষ্ঠানের আওতায় উন্মুক্ত স্থানে সবুজ আচ্ছাদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এসব নির্দেশনা প্রতিপালন নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় চলমান উন্নয়ন কাজে এসবের কিছুই লক্ষ্য করা যায়নি।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সঠিক নজরদারি আর ঠিকাদারদের হেয়ালিপনা-ই শহরে বায়ূ দূষণের জন্য দায়ী। যার ফল ভোগ করছে নগরবাসী। সরকারের কঠোর নজরদারি ছাড়া এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন তারা।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ঢাকার অন্যান্য সেবা সংস্থাগুলোকে সিটি কর্পোরেশনের নেতৃত্বে কাজ করতে হবে। তবে প্রকৃত পক্ষে সিটি করপোরেশন যদি নজরদারির কাজটি সঠিকভাবে করতে এবং অনিয়মের শাস্তি নিশ্চিত করতো তাহলে এতোটা বিপর্যয় হতো না। কিন্তু করপোরেশন-ই তো তাদের কাজটি সঠিকভাবে করছে না। তাই ঠিকাদাররাও হেয়ালিপনা করছে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে বছরব্যাপী খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ এবং এর দ্বারা সৃষ্ট ঝুঁকি থেকে উত্তরণে অবশ্যই সরকার প্রধানকে নজরদিতে হবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস অক্টোবর মাসে সংশ্লিষ্ট সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কর্মপরিকল্পনা জমা দিতে চিঠি দিয়েছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময় ৩১ অক্টোবরের মধ্যে অনেক সেবা সংস্থা তাদের কর্মপরিকল্পনা জমা দেয়নি। এজন্য ডিএসসিসি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওই সেবা সংস্থাগুলোকে চলতি অর্থবছরে কোনো উন্নয়ন কাজ করতে দেয়া হবে না।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, সেবা সংস্থাগুলোর প্রকল্প অনুমোদন ও অর্থের সংস্থান ভিন্ন ভিন্ন সময়ে হওয়ায় যখন-তখন খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করা যাচ্ছে না। আমরা দুই মেয়র আলাপ-আলোচনা সাপেক্ষে বিদ্যমান সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি। উন্নয়ন কাজের কারণে অনেক ধুলোবালু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। বিধি মোতাবেক যারা উন্নয়ন কাজ করবে তাদের পানি ছিটিয়ে ধুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তারা সেটা করছে না।



 

Show all comments
  • Jasmin Akhter ১১ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৪৫ এএম says : 0
    World ar kono desha amon road cutting hoi na.
    Total Reply(0) Reply
  • তানবীর ১১ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৪৬ এএম says : 0
    ঢাকার অনেক গলিতে অপরিকল্পিত ভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও রাস্তা কাটায় সীমাহীন জনদুর্ভোগে পরেছে রাজধানীবাসি।
    Total Reply(0) Reply
  • নুরজাহান ১১ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৪৭ এএম says : 0
    টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে বছরব্যাপী খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ এবং এর দ্বারা সৃষ্ট ঝুঁকি থেকে উত্তরণে অবশ্যই সরকার প্রধানকে নজরদিতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • জাবেদ ১১ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৪৮ এএম says : 0
    সড়ক খনন নীতিমালায় ওয়ান স্টপ সমন্বয় সেল গঠনের সুপারিশ থাকলেও সেটা বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না।
    Total Reply(0) Reply
  • আরাফাত ১১ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৪৮ এএম says : 0
    আমরা একটা আজব শহরে বাস করছি
    Total Reply(0) Reply
  • মিনহাজ ১১ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৪৯ এএম says : 0
    উন্মুক্ত স্থানে আবর্জনা রাখা ও পোড়ানো রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Jack Ali ১১ ডিসেম্বর, ২০২০, ৪:৫১ পিএম says : 0
    They have destroyed our Sacred Mother Land in every way. They cannot get away severe Punishment from Allah because of their heinous crime against us.
    Total Reply(0) Reply
  • Jack Ali ১১ ডিসেম্বর, ২০২০, ৪:৫১ পিএম says : 0
    They have destroyed our Sacred Mother Land in every way. They cannot get away severe Punishment from Allah because of their heinous crime against us.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভাঙন

২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ