দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মদিনা মুনাওয়ারায় প্রাচীনকাল থেকে বসতি ছিল তা ইতিহাস সাক্ষী দেয়। বিশেষ করে হযরত নূহ (আ.)’র আমলে মহাপ্লাবনের পর এই জাহাজেরই যাত্রীর পরবর্তী বংশধরেরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। তখনকার সময়ে বিশ্বে ক্রমান্বয়ে ৭২ প্রকারের ভাষার সৃষ্টি হয়। তাদেরই একদল হযরত নূহ (আ.)’র বংশধর ছিলেন। তারাই মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আরবি ভাষার আবিষ্কারক এবং তারাই পবিত্র মদিনায় বসতি স্থাপন করেন। এখানে তারা চাষাবাদ শুরু করে। লাগান খেজুর গাছ। এদেরকে আমালেকা বা আমালিক বলা হত। দীর্ঘদিন পর তারা সম্পদশালী হয়ে ওঠে। অনেক দেশ তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে।
ইতিহাস থেকে আরও জানা যায় হেজাজ, শাম, বাহরাইন, মিশরে তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়। তাদের আর্থিক অবস্থা খুবই স্বচ্ছল হওয়ায় আরামে আয়েশে জীবনযাপন করছিলেন।
পবিত্র মদিনা সমুদ্রপৃষ্ট হতে ৬ শত মিটার উপরে। এখানকার পানি হালকা শীতল ও সুমিষ্ট। শহরের আবহাওয়া গ্রীষ্মকালে অত্যন্ত গরম, শীতকালে অত্যন্ত ঠান্ডা। ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে আসরিব ইবনে কানিযাহ পবিত্র মদিনার গোড়াপত্তন করে ছিলেন বলে তাহার নাম অনুসারে এ শহরের নাম হয়ে আসছিল ইয়াসরিব। তিনি ছিলেন হযরত নূহ (আ.)’র বংশধরদের মধ্যে সপ্তম অধস্তন পুরুষ।
আমালেকা বংশের পর এ পবিত্র ভূমিতে ইহুদিরা এসে বসতি স্থাপন করে। বসতি স্থাপনের ব্যাপারে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে মত পার্থক্য দেখা যায়। এক বর্ণনায় জানা যায়, হযরত মূসা (আ.) হজ্ব আদায় উপলক্ষে পবিত্র মক্কা মুকাররমায় এসে ছিলেন, তাঁর সাথে বনী ঈসরাইলের অনেক লোকজন এখানে আসেন। পবিত্র হজ্বের পর যখন তারা স্বদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হন তখন তারা পবিত্র মদিনা শরীফের পথে গমন করেন। বনী ঈসরাইলীগণ আখেরী জমানার পয়গাম্বর (স.)’র দেশ পবিত্র মদিনা মুনাওয়ারা হওয়া সম্পর্কে তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ তাওরাতের মধ্যে পড়েছিলেন, এ কারণে তাদের একটি গ্রুপ হযরত মূসা (আ.)’র সঙ্গ ত্যাগ করে এখানে অবস্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা হেজাজের বেদুঈনদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করে তাদের রীতি-নীতি ও ধর্মের অনুসরণ করেন।
ইতিহাসের গ্রহণযোগ্য বর্ণনা মতে, পবিত্র মদিনায় প্রথমে আমালেকা বংশীয় লোকজন এসেছে, অতঃপর ইহুদীদের আগমন। ইহুদীরা জানত পবিত্র মদিনায় শেষ জমানার পয়গাম্বরের আগমন হবে। এতে তারা তাদের পরবর্তী বংশধরদের নিকট নির্দেশনা দিয়ে যেতে থাকেন, শেষ যুগের পয়গাম্বরের আবির্ভাব ঘটলে তারা যাতে আনুগত্য স্বীকার করে এবং পয়গাম্বরের নিকট বায়াত থেকে বিরত না থাকে। ইহুদীরা ব্যতীত পবিত্র মদিনায় খ্রিস্টানও বাস করত। একটি বাঁধ ধ্বংসের পর প্লাবনে ইয়ামেন হতে পবিত্র মদিনায় আগমন করেছিলেন আওস ও খাযরাজ বংশের অধিবাসীগণ। তাদেরকেও পবিত্র মদিনার প্রাচীন অধিবাসী হিসেবে গণ্য করা হয়।
বস্তুতঃ ইহুদীরা ছিলেন জ্ঞানী, পন্ডিত, তাদের থেকেই আওস ও খায়রাজ বংশের জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিগণ জানতে পারেন আখেরী নবীর আগমনের সময় হয়ে গেছে। ইহুদীরা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ পর্যালোচনা করে উপলব্ধি করতে পারতেন তেমনি আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোকজনকে খোলা মনে অবগত করাতেন।
ইহুদীদের মাতৃভাষা ছিল ইবরানী বা হিব্রু। কিন্তু হেজাজে এসে ক্রমে ক্রমে তাদের ভাষা আরবি হয়ে গিয়েছিল। এ আরবি ভাষাতেই তারা দৈনন্দিন কাজ সম্পন্ন করত। হিব্রু ছিল তাদের ধর্মীয় ও শিক্ষা দীক্ষার ভাষা মাত্র।
বস্তুত: মহান আল্লাহ পাকের মহিমা পবিত্র মক্কায় নব্যুওয়াতের সূর্য উদিত হবার পর আওস ও খাযরাজ আনছারগণ ইসলামের দিকে অগ্রগামী হলেন। অপরদিকে, অদূরদর্শী ইহুদীগণ হিংসায় জ্বলে উঠে। যখন আনছারগণের সাথে ইহুদীদের ঝগড়া হত তখন ইহুদীরা বলত, কাল শেষ জমানার পয়গাম্বরের আবির্ভাব হবে আমরা তাঁর অনুগত হয়ে তোমাদের বিরুদ্ধাচারণ করব। কিন্তু মহান আল্লাহ পাকের মহিমা, বাস্তবে একদম বিপরীত হয়ে গেল, ইহুদীরা আল্লাহর রাসূল (স.) অনুগত হওয়ার যে আশাবাদী ছিল, তা আনছারগণেরই ভাগ্যে জুটে গেল। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক বলেন, “ইহা আল্লাহরই মহিমা, তিনিই জানেন, এ দৌলত কার ভাগ্যে জুটবে?” মহান আল্লাহ পাক আরও বলেন, “সৌভাগ্য আল্লাহরই দান, কোন শক্তিধরের শক্তি দ্বারা ইহা লাভ করা যায় না।”
ইসলামের প্রাথমিক যুগে নবী পাক (স.) হজ্বের মৌসুমে বহিরাগতদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। এতে একবার আওস ও খাযরাজের কয়েকজন লোক গোপনে নবী পাক (স.)’র সাথে মিলিত হন। নবী পাক (স.) পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াত করে শোনান। এতে পবিত্র মদিনায় ইহুদীদের ভাষ্য মিলে যাওয়ায় অর্থাৎ ইহুদী পন্ডিতরা বলত অল্প দিনের মধ্যে আখেরী নবীর আবির্ভাব ঘটবে। এতে এরা নবী পাক (স.)’র হাতে ঈমান আনেন। এরা সংখ্যায় ছিল ৬ জন। তারা পবিত্র মদিনায় প্রত্যাবর্তন করে ইসলামের জোর প্রচারণা চালালেন। ফলে ২য় বছর হজ্বের সময় এই আওস ও খাযরাজ বংশের ১২ ব্যক্তি নবী পাক (স.)’র সাথে গোপনে সাক্ষাৎ করে ঈমান আনেন। তাদের অনুরোধে নবী পাক (স.) হযরত মুস আব (র.)-কে তাদের সাথে দেন। ফলে পবিত্র মদিনায় ইসলামের জোয়ার বইতে শুরু করে। এতে তৎপরবর্তী বছর দু’জন মহিলাসহ ৭৩ জন হজ্ব উপলক্ষ্যে পবিত্র মক্কায় আসলে নবী পাক (স.)’র সাথে গোপনে সাক্ষাৎ করেন। তাদের অতি আগ্রহ ও প্রতিশ্রুতিতে পবিত্র মক্কা থেকে সাহাবীগণকে পবিত্র মদিনায় হিজরত করার জন্য নবী পাক (স.) অনুমতি দেন। যেহেতু তখনও পবিত্র মক্কায় মুসলমানদের জন্য চরম প্রতিক‚ল অবস্থা বিরাজ করছিল। অপরদিকে, পবিত্র মদিনায় মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল (স.) ও দ্বীনের সাহায্যে জানমাল দিয়ে সাহায্য সহযোগিতায় আওস ও খাযরাজকে দাঁড় করিয়ে দেয়। এ দু’টি পবিত্র মদিনার প্রধান গোত্র ছিল। এরাই পবিত্র মদিনার আনছারের গৌরবজনক উপাধিতে ভূষিত হয়েছিল। আওস ও খাযরাজের এ গোত্রদ্বয় পবিত্র মক্কার কুরাইশদের বিপরীত নম্র স্বভাব ও কোমল প্রকৃতির ছিলেন। কঠোরতা, অহংকার, সর্বোপরি সত্য প্রত্যাখ্যানের মত নিচু স্বভাব হতে তাঁরা ছিলেন পুত পবিত্র।
ইহুদীদের সাথে সহাবস্থানের দ্বারা তাঁরা দ্বীনের তাৎপর্য পরিভাষা সমূহ তথা নব্যুওয়াত, রিসালাত, হাশর নশর, আখিরাত, শেষ নবীর আগমনসহ অনেক কিছু সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলেন। শুধু তাই নয় পবিত্র মদিনা যে ইসলামী দাওয়াতের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে মনোনীত ইহাও তারা অনুধাবন করতে পারেন।
মহান আল্লাহ পাকের মহিমা কুরাইশদের শত বাধা পেরিয়ে নবী পাক (স.) পবিত্র মক্কা থেকে পবিত্র মদিনায় হিজরত করতে সক্ষম হন। মদিনাবাসী নিজের জানমাল দিয়ে নবী পাক (স.) এবং সাথে সাথে পবিত্র মক্কা থেকে আগত সাহাবীগণকে গ্রহণ করে নেন। সে এক ইতিহাস। পবিত্র মদিনার নাম ছিল ইয়াছবির। নবী পাক (স.) নামকরণ করেন পবিত্র মদিনা। তবে পবিত্র মদিনার ২৯টি নাম সমধিক প্রসিদ্ধ। এ ছাড়া ৯২, ৯৯ সহ বিভিন্ন সংখ্যার নামও উল্লেখ রয়েছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।