Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিপর্যয়ে প্রকাশনা শিল্প

করোনায় বই বিক্রি কমেছে ৯০ শতাংশ ২৬ হাজার লাইব্রেরির ২০ লাখ কর্মচারীর দুর্বিষহ জীবন

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

বিজ্ঞানের বদৌলতে গুগলে সার্চ দিলেই পাওয়া যায় সব ধরনের বই ও তথ্য। এ ছাড়াও ইদানীং ই-পেপার বের হওয়ায় মুদ্রিত বইয়ের চাহিদা কমে গেছে। পাঠকদের বড় অংশ এখন গুগলে পড়াশোনা করেন এবং ই-পেপারের বই পড়ে থাকেন। সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পের এই অশনি সঙ্কেতের মধ্যেই সাড়ে ৮ মাস ধরে করোনাভাইরাসের পাদুর্ভাব। ফলে সাধারণ গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধসহ সব ধরনের বই বিক্রি কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সৃজনশীল বইয়ের ব্যবসায়ীদের পথে বসার উপক্রম হচ্ছে। বিপর্যয়ের মুখে পড়ে গেছে বইয়ের ব্যবসা। 

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির তথ্যে দেখা গেছে, সারাদেশের লাইব্রেরিতে বই বিক্রির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ২০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছিল। প্রায় ৮০ শতাংশই আর্থিক সঙ্কটে দুরবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করছেন। পুস্তক শিল্পের সঙ্গে জড়িত কাগজ, কালি, প্রেস, প্লেট, বাইন্ডিংসহ সংশ্লিষ্ট সব খাত বন্ধ। ফলে ৮০ শতাংশ লোক বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, মাঝে মধ্যে ফেসবুকের মাধ্যমে অর্ডার আসে; তাই ব্যবসা করেন।
বাংলাবাজার ঘুরে দেখা যায় অধিকাংশ বইয়ের দোকান বন্ধ। যেগুলো খোলা হয়েছে সেগুলোতে বেচাবিক্রি কম। সংশ্লিষ্টরা জানালেন, করোনার ৯ মাসে হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া প্রায় সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানেই বই ছাপার কাজ বন্ধ রয়েছে। যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তারাও অনেকটা বিনামূল্যে বই ছাপাচ্ছে। তাছাড়া করোনার কারণে দেশের মোট ৩০ হাজার লাইব্রেরিতে বই বিক্রি ব্যাপকভাবে কমেছে। ব্যবসায়ীদের দাবি করোনার পাদুর্ভাব না হলে এই ৯ মাসে বই বিক্রি হতো প্রায় ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার। সেখানে করোনার ৯ মাসে মাত্র ৭২০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। সেই হিসাবে ৯ মাসে ৬ হাজার ৪৮০ কোটি টাকার বই বিক্রি কমে গেছে। এই পরিস্থিতিতে প্রকাশনা সংস্থা টিকিয়ে রাখতে ৮০ শতাংশ জনবলকে বিনা বেতনে ছুটি দেয়া হয়েছে। প্রকাশনা সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরো জানা গেছে এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনে সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পে ধস নামবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পরিচালক কাজী শাহ আলম বলেন, সৃজনশীল বই ব্যবসায়ীদের আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। ৬০ থেকে ৭০ জন লোক কাজ করত আমার প্রতিষ্ঠানে। এখন তিনজন দিয়ে সংস্থা চলছে। আমি প্রতিষ্ঠানে গেলে খোলা হয়, না গেলে বন্ধ থাকে। এমন অবস্থা সবগুলো প্রকাশনী সংস্থার।
রাজধানীর বাংলাবাজার ছাড়াও শাহবাগ ও নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, অর্ধেকের বেশি বইয়ের দোকান খোলা থাকলেও ক্রেতা নেই দিনের বেশিরভাগ সময়। দুই-একটি দোকানে হঠাৎ ক্রেতা দেখা যায়, বেশির ভাগ সময় দোকানদাররা অবসর কাটান। নীলক্ষেত এলাকার ফুটপাথের বইয়ের দোকানিদেরও মোবাইল ফোনে সময় কাটাতে দেখা গেছে। পল্টনের সিপিবি অফিসের সামনের বইয়ের দোকানগুলোতে বেচাকেনা নেই বললেই চলে। দীর্ঘদিন থেকে বই ব্যবসা করা উত্তম কুমার বই বিক্রি বাদ দিয়ে এখন চাইনিজ আকুপাংচারের সরঞ্জাম বিক্রি করছেন। বললেন, ই-বইয়ের কারণে অনেক আগেই ছাপানো বই বিক্রি কমে গেছে। করোনা আসায় আগে যেটুকু ছিল তা নেই। বাধ্য হয়েই চাইনিজ সরঞ্জামাদি বিক্রি করছি।
লাইব্রেরি ও মুদ্রণ সংস্থার মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার সময় লকডাউনে বইয়ের দোকানও বন্ধ ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সব ধরনের বই বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। তবে লকডাউন উঠে যাওয়ার পর সামান্য হলেও বেচাকেনা শুরু হয়েছে। শীতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় সেই সামান্য বিক্রিও বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি শ্যামল পাল বলেন, করোনার আগে স্বাভাবিক সময়ে দেশের ৩০ হাজার লাইব্রেরিতে প্রতিদিন গড়ে বই বিক্রি হতো ৩০ কোটি টাকার। এই হিসাবে স্বাভাবিক পরিস্থিতি থাকলে এই সময়ে বই বিক্রি হতো ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার। কিন্তু এই সময়ে বিক্রি হয়েছে ৭২০ কোটি টাকার বই। অর্থাৎ স্বাভাবিকের তুলনায় মাত্র ১০ শতাংশ বই বিক্রি হয়েছে।
ইউনিভার্সেল পাবলিকেশনসের স্বত্বাধিকারী এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পরিচালক কাজী শাহ আলম বলেন, সমিতির নিবন্ধিত দেশের ২৬ হাজার লাইব্রেরির একজন মালিকও করোনাকালে কোনো ব্যাংক থেকে লোন পাননি। কারণ ব্যাংক জেনে গেছে, লোন দিলে বই ব্যবসায়ীরা কিস্তি দিতে পারবে না। বাকি চার হাজারের অবস্থা আরো খারাপ। বড় প্রকাশনী সঞ্চিত অর্থ দিয়ে বা এ বছরের বিনোয়োগের টাকা দিয়ে কয়েক মাস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিয়েছেন। তিন-চার মাস পর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ জনবলকে ছুটি দেয়া হয়েছে বিনা বেতনে। তারা অনেকেই গ্রামে ফিরে গিয়ে কৃষি কাজ করছেন, মাছ চাষ করছেন। অনেকেই শহরে অন্য কোনোভাবে আয় করে সংসার চালানোর চেষ্টা করছেন।
বাংলাবাজারে ফুটপাথের বই বিক্রেতা মো. ওমর ফারুক বলেন, আগে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার বই বিক্রি করতাম। এখন কোনো দিন কয়েকশ’ টাকার বিক্রি হয়, কোনো দিন হয় না। বসে থাকি যদি একটা বইও বিক্রি হয়।
ফুটপাথের বই ব্যবসায়ী মো. আব্দুল খালেক বলেন, আগে প্রতিদিন বিক্রি হতো দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার বই। এখন প্রতিদিন বিক্রি হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকার। শুনেছি সরকার সাহায্য দেবে, কিন্তু দেয়নি। ঋণ করেছি তাও পরিশোধ করতে পারিনি। এখন সংসার চলছে না। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট, নিউ মার্কেট, বাংলাবাজার ও নীলক্ষেতের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বিক্রি তেমন নেই। তারপরও দোকান খোলেন। কারণ দোকান না খুললে যে বইগুলো রয়েছে তাও নষ্ট হবে, তাই মাঝে মধ্যে খুলে বসে থাকি। ফেসবুক গ্রæপে অর্ডার পাওয়ার অপেক্ষায় থাকি। ঋণ করে সংসার চালাচ্ছি ব্যবসা বলে কিছু নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ