দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মুমিন জীবনের শ্রেষ্ঠতম ইবাদত ফরজ। এর কোনো তুলনা হয় না। ফরজ আদায়ের পর যারা নফল আদায় করে তাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর বিশেষ রহমত। নফলের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর অধিকতর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ করে। হাদিসে কুদসিতে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমার বান্দা নফলের মাধ্যমে আমার নিকটবর্তী হতে থাকে। একপর্যায়ে সে আমার মাহবুব ও ভালোবাসার পাত্র হয়ে যায়।’ (বুখারি : ২/৯৬৩)
নফল ইবাদতের মধ্যে নফল নামাজ আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়। পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত নামাজের বাইরেও কিছু নফল নামাজ রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো- আওয়াবিন নামাজ।
আওয়াবিন শব্দটি ফার্সি। এটি ‘আওয়াব’ শব্দ থেকে নির্গত। এর আভিধানিক অর্থ হলো খোদাভীরু। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় মাগরিবের ফরজ ও সুন্নত নামাজ আদায় করার পর যে নফল নামাজ পড়া হয় তাকে আওয়াবিন নামাজ বলে।
আওয়াবিনের ওয়াক্ত : আওয়াবিন একটি গুরুত্বপূর্ণ নফল নামাজ। হাদিস শরিফে ‘সালাতুল আওয়াবিন’ নামেই নামাজটির উল্লেখ রয়েছে। মাগরিবের নামাজের পর আওয়াবিনের ওয়াক্ত শুরু হয় এবং এশার আগ পর্যন্ত তার সময় বাকি থাকে। মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদির (রহ.) থেকে বর্ণিত একটি মুরসাল হাদিসে আছে, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে নামাজি ব্যক্তি যে নামাজ পড়ে একে সালাতুল আওয়াবিন (আওয়াবিনের নামাজ) বলে।’ (জামে সাগির : ২/৪২৭)। আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে (নিভৃতে) যে নামাজ পড়া হয় একে সালাতুল আওয়াবিন (আওয়াবিন নামাজ) বলে।’ (কিয়ামুল লাইল : ৮৮)। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, আওয়াবিনের ওয়াক্ত ঐ সময় থেকে শুরু হয়, যখন নামাজি মাগরিবের নামাজ পড়ে শেষ করে এবং এর ওয়াক্ত এশার ওয়াক্ত হওয়া পর্যন্ত থাকে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৫৯৭৩)
ফজিলত : হাদিস ভান্ডারে আওয়াবিন নামাজের অনেক ফজিলত, মাহাত্ম্য ও বরকতের কথা বর্ণিত হয়েছে। সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ গুনাহ মাফ হয় এ নামাজের মাধ্যমে। আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘মাগরিবের নামাজের পর যে ব্যক্তি ছয় রাকাত নফল নামাজ পড়বে তার গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়।’ (মাজমাউজ জাওয়াইদ : ৩৩৮০)। সালেম (রহ.) স্বীয় পিতা আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মাগরিবের পর ছয় রাকাত নামাজ পড়বে তার পঞ্চাশ বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।’ (নাইলুল আওতার : ৩/৫৫)। অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে, ‘এ নামাজে গুরুত্বারোপকারী বান্দা আওয়াবিন তথা আল্লাহমুখী, আনুগত্যকারী ও নেককার বান্দাদের মধ্যে গণ্য হবে।’ আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মাগরিবের পর ছয় রাকাত নামাজ পড়বে তাকে আওয়াবিন তথা নেককার, আনুগত্যকারী বান্দাদের মধ্যে লেখা হবে এবং কোরআনের এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন-নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদের জন্য ক্ষমাশীল।’ (বনি ইসরাইল : ২৫) [আল বাহরুর রায়েক : ২/৫০]। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মাগরিবের নামাজের পর এ নামাজ পড়বে তার মর্যাদা জান্নাতের উঁচু স্থানে হবে।’ (ইতহাফুস সাদাহ : ৩/৩৭১)।
১২ বছরের ইবাদতের সমান সওয়াবের সুসংবাদ রয়েছে আওয়াবিন নামাজে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মাগরিবের পরে ছয় রাকাত নফল আদায় করে, মাঝখানে কোনো দুনিয়াবি কথা না বলে, তাহলে সেটা ১২ বছরের ইবাদতের সমান গণ্য হবে।’ (তিরমিজি : ১/৫৫৯)
নিয়মিত আওয়াবিন পড়লে বেহেশতে ঘর তৈরি করা হয়। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মাগরিবের পর বিশ রাকাত নফল নামাজ পড়বে আল্লাহতায়ালা তার জন্য বেহেশতে একটি ঘর প্রতিষ্ঠিত করবেন (অর্থাৎ সে বেহেশতে যাবে)’ (তিরমিজি : ১/৯৮, হাদিস : ৪৩৭)। হাসান বসরি (রহ.) বলতেন, এশার মধ্যবর্তী সময়ের নামাজও রাতের নামাজ বা তাহাজ্জুদের নামাজ বলে গণ্য হবে।’ (আসসুনানুল কুবরা, বাইহাকি)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ফেরেশতারা ঐসকল লোকদের ঢেকে নেয়, যারা মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে নামাজ পড়ে। আর এ নামাজের নাম সালাতুল আওয়াবিন (আওয়াবিনের নামাজ)।’ (শরহুস সুন্নাহ, বাগাবি : ৮৯২)
আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধকারী হাদিসসমূহের পাশাপাশি এ নামাজের ব্যাপারে নবীজির নিজের (সা.) আমলও হাদিসগুলোতে বর্ণিত হয়েছে। আম্মার ইবনে ইয়াজিদের ছেলে মোহাম্মদ ইবনে আম্মার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি আমার পিতা আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে (রা.) দেখেছি, তিনি মাগরিবের পর দুই রাকাত পড়তেন এবং বলতেন, আমি আমার প্রিয় মোহাম্মাদ (সা.)-কে দেখেছি, তিনি মাগরিবের পর ছয় রাকাত নামাজ পড়তেন।’ (আল মুজামুল আওসাত লিত-তাবরানি : ২৭৪৫)। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)ও বলেছেন, নবীজি (সা.) এ নামাজ পড়েছেন।’ (কিয়ামুল লাইল : ৮৮)। হুজায়ফা (রা.) বলেন, ‘আমি নবীজির (সা.) কাছে এসে তার সঙ্গে মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। তিনি মাগরিবের পরে এশার নামাজ পর্যন্ত নফল নামাজে রত থাকলেন।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ২/১৫)। আনাস (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে নফল নামাজ পড়তেন।’ (নাইলুল আওতার : ৩/৫৪) আনাস (রা.) থেকেই অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, নবীজি (সা.) অনেক সময় মাগরিবের নামাজ পড়ে নফল নামাজ পড়তেন, এমনকি কখনো এশার নামাজের আজান হয়ে যেত।’ (কাসফুল গুম্মাহ : ১১২)।
আওয়াবিন নামাজ কয় রাকাত : এই নামাজ কমপক্ষে ছয় রাকাত এবং সর্বাপেক্ষা বিশ রাকাত নফল নামাজ। ছয় রাকাত পড়ারও সুযোগ না হলে মাগরিবের দুই রাকাত সুন্নত মিলিয়ে ছয় রাকাত পড়া যায়। নবীজি (সা.) কখনো ৬ রাকাত (তিরমিজি) কখনো ৪ রাকাত (নাইলুল আওতার) কখনো ১২ রাকাত (ইতহাফুস সাদাহ : ৩/৩৭১) আবার কখনো বা ২০ রাকাত (তিরমিজি : ৪৩৫) নফল নামাজ পড়তেন। তবে ৬ রাকাতই অধিকাংশ সময় পড়তেন।
সাহাবায়ে কেরামও এ নামাজের খুব গুরুত্ব দিতেন। আনাস (রা.) বলেন, সাহাবায়ে কেরামের একটি বড় জামাত মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে এ নামাজ আদায় করতেন।’ (নাইলুল আওতার : ৩/৫৪)। তাবেয়ি, তাবে তাবেয়ি ও পূর্বসূরী সবাই এর ওপর আমল করেছেন।
আওয়াবিন পড়ার পদ্ধতি : নিঃসন্দেহে এ নামাজ অনেক ফজিলত ও মর্যাদার অধিকারী। এ নামাজের প্রতি গুরুত্বদান উভয় জাহানে বরকত ও কল্যাণের কারণ। নামাজটি পড়ার পদ্ধতি হলো-দুই দুই রাকাত করে তিন সালামে নামাজটি পড়া। বিদগ্ধ ফকিহদের অভিমতও এটাই যে, এ নামাজ দু রাকাত করে তিন সালামে পড়া মোস্তাহাব। (আল বাহরুর রায়েক : ২/৫০)। দু রাকাত করে পড়া এজন্যও উত্তম যে, নবীজি (সা.) রাতের নামাজ দুই রাকাত করে পড়তেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে ফরজের পাশাপাশি নফল ইবাদত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।