বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত কুরআনুল কারীমে রাসূলে মুকাররাম নূরে মোজাচ্ছাম মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে ‘সিরাজাম মুনীরা’ (সমুজ্জ্বল প্রদীপ) রূপে বিশেষিত করেছেন। গভীর মনোযোগের সাথে কুরআনুল কারীম তিলাওয়াত করলে দেখা যায় যে, কুরআনুম মাজীদে ‘সিরাজুন’ (প্রদীপ) শব্দটি চারবার এসেছে। যথা- (ক) ইরশাদ হয়েছে : ‘সুমহান তিনি যিনি আকাশে রাশিসমূহ স্থাপন করেছেন এবং তাতে প্রদীপ্ত সূর্য ও উজ্জ্বল চন্দ্র স্থাপন করেছেন।’ (সূরা ফুরকান : আয়াত ৬১)। এই আয়াতে কারীমায় সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, আকাশমন্ডলে প্রদীপ্ত সূর্য এবং উজ্জ্বল চন্দ্রকে আল্লাহপাক স্থাপন করেছেন। যাতে করে এই পৃথিবীকে দিনে এবং রাতে আলোকোজ্জ্বল করা যায় এবং এই পৃথিবীরও তন্মধ্যস্থ বস্তুরাজির মধ্যে প্রাণ প্রবাহের ধারা অব্যাহত রাখা যায়।
(খ) ইরশাদ হয়েছে : ‘তোমরা কি দেখ না, সপ্তস্তরে বিন্যস্ত আকাশমন্ডলকে আল্লাহপাক কিভাবে সৃষ্টি করেছেন? সৌরমন্ডলে তিনি চন্দ্রকে আলোকবিশিষ্ট ও সূর্যকে প্রদীপ সদৃশ স্থাপন করেছেন।’ (সূরা নূহ : আয়াত ১৫-১৬)। এই আয়াতে কারীমায় সূর্যকে প্রদীপ সদৃশ এবং চন্দ্রকে আলোকবিশিষ্ট করে সৌরমন্ডলে স্থাপন করার কথা বলা হয়েছে।
(গ) ইরশাদ হয়েছে : ‘আমি তোমাদের ঊর্ধ্বে সুদৃঢ় সপ্ত আসমান স্থির করেছি। এবং উজ্জ্বল প্রদীপ সূর্যকে স্থাপন করেছি।’ (সূরা নাবা. আয়াত ১২-১৩)। এই আয়াতে আল্লাহপাক সূর্যকে সৌরমÐলে উজ্জ্বল প্রদীপরূপে স্থাপন করার কথা ব্যক্ত করেছেন।
বস্তুত, আলোর মাঝে দু’টি গুণের সমাবেশ পাওয়া যায়। প্রথমত, তাপযুক্ত আলো। সূর্যের আলোতে তাপ আছে, দহনশক্তি আছে। সূর্য কেবল আলোই প্রদান করে না, বরং কখনো কখনো তার দহন শক্তি বস্তু নিচয়কে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়। এ জন্যই সূর্যকে ‘সিরাজান্ওয়াহ্হাজান’ বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তাপহীন আলো চাঁদের আলোতে তাপ নেই, দাহিকা শক্তি নেই। চাঁদের আলো কোমল ও নরম। এ কারণেই চাঁদকে ‘কামারাম মুনীরা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে ‘সিরাজাম মুনীরা’ গুণে গুণান্বিত করা হয়েছে। কেননা, তাঁর হেদায়েতের আলো চাঁদের আলো অপেক্ষা কোটি কোটি গুণ বেশি। হৃদয়গ্রাহী ও প্রাণস্পর্শী।
আরো লক্ষ করা যায় যে, সূর্য ও চাঁদের উদয় এবং অস্ত আছে। সূর্য উদয় হতে অস্ত পর্যন্ত সময়ে আলো দান করে। অনুরূপভাবে চাঁদ উদয় হতে অস্ত যাওয়া পর্যন্ত সময়ে আলো বিতরণ করে। সূর্যের আলো দান সময়কে দিন (ইয়াউম) এবং চাঁদের আলোদান সময়কে রাত (লাইল) নামকরণ করা হয়েছে। আল কুরআনে দিন অর্থাৎ ‘ইয়াউম’ শব্দটি বিভিন্ন আঙ্গিকে তিনশত চুয়াত্তর (৩৭৪) বার ব্যবহৃত হয়েছে। আর রাত অর্থাৎ ‘লাইল’ শব্দটিও বিভিন্ন আঙ্গিকে বিরান্নব্বই (৯২) বার এসেছে। এতে স্পষ্টতই অনুমিত হয় যে, সূর্যের আলোদান এবং চাঁদের কিরণদানের মধ্যে যতি, বিরতি আছে।
(ঘ) ইরশাদ হয়েছে : ‘হে প্রিয় নবী! আমি আপনাকে সাক্ষ্যদানকারী সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি। এবং আল্লাহর আদেশে তাঁর পথে আহবানকারী ও প্রোজ্জ্বল প্রদীপরূপে। আপনি মুমিনদের সুসংবাদ দিন, তাদের জন্য আল্লাহর তরফ হতে বিরাট অনুগ্রহ রয়েছে।’ (সূরা আহযাব : আয়াত ৪৫-৪৭)। এখানে ৪৬ নং আয়াতে কারীমায় সাইয়্যেদুল মুরসালীন, রাহমাতুল্লিল আলামীন মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত ‘সিরাজাম্ মুনীরা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। লক্ষ করলে দেখা যায় যে, এই ৪৫ ও ৪৬ নং আয়াতে কারীমায় আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পাঁচটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন।
যথা- (১) সাক্ষ্যদানকারী, (২) সুসংবাদদাতা, (৩) সতর্ককারী, (৪) আল্লাহর পথে আহবানকারী এবং (৫) প্রোজ্জ্বাল প্রদীপ। এটি ৪৬ নং আয়াতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পঞ্চম গুণ। মোটকথা কুল মাখলুকাতের আদিতে ও তিনি সিরাজাম্ মুনীরারূপে ছিলেন। সৃষ্টি জগতের বিকাশ লাভের পরও তিনি ‘সিরাজাম মুনীরা’ রূপেই আছেন এবং সৃষ্টি জগতের বিলয় প্রাপ্তির পরও তিনি সিরাজাম্ মুনীরারূপেই থাকবেন। তাঁর এই জ্যোতির্ময় অবস্থার কোনো যতি নেই, বিরতি নেই, ছেদ নেই, অস্ত নেই। এই বিশেষত্বটির কথা উপলব্ধি করতে পেরেই হয়তো মরমী কবি প্রশস্তি গেয়েছেন ‘নূরের দরিয়ায়, সিনান কারিয়া, কে এলো মক্কায়, মা আমিনার কোলে’।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।