Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজউকে দালাল চক্রে সাধারণ মানুষ জিম্মি

ফাইল গায়েব, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী কোটিপতি

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২২ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০২ এএম

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ফাইল গায়েবের ঘটনা নতুন নয়। বিভিন্ন সময় অসংখ্য ফাইল গায়েবের ঘটনা ঘটেছে। যেসব ভবনের নকশায় ঝামেলা থাকে, সেসব ফাইল বেশি গায়েবের ঘটনা ঘটে। বনানীতে অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত এফআর টাওয়ারের ফাইলও গায়েব হয়েছিল। ফাইল গায়েবের একটি বড় চক্র গড়ে উঠেছে রাজউকে। এবার প্লটের ফাইল গায়েব করার মূলচক্রের হোতা রাজউকের বেঞ্চ সহকারী চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আবুল বাশার শরীফকে ধরতে চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান মো. সাঈদ নূর আলম ইনকিলাবকে বলেন, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে যে চিঠি পাঠিয়েছে তা পেয়েছি। সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। এখনো কোন কোন কর্মকর্তা সাধারণ মানুষের ফাইল ও প্লটের ফাইল গায়েব করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। একজন ফাইল গায়েবের ঘটনায় জেলে আছে। বাশার শরীফের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় মামলা দায়ের হয়েছে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৫ মে বর্তমান বিদ্যুৎ সচিব সুলতান আহমেদ রাজউকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তার কাছে একের পর এক ফাইল গায়েবের অভিযোগ জমা পড়তে থাকে। একপর্যায়ে গত বছরের ১৫ অক্টোবর চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ নিজে দু›জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে অভিযান চালান। রাজউকের পেছনের বর্ধিতাংশ ভবনের কয়েকটি কক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের গায়েব হওয়া মোট ৭২টি প্লটের ফাইল উদ্ধার করেন। এ সময় গায়েবি চক্রের সদস্য বাশার শরীফ, গোল্ডেন মনিরসহ অন্যরা পালিয়ে যান। পরে রাজউকের অফিস সহায়ক পারভেজকে আটক করে পুলিশ।

রাজউক বেঞ্চ সহকারী চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আবুল বাশার শরীফ পদে কাজ করেন। সাধারণত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন কোনো ফাইলে সই করেন, তখন তিনি ওই ফাইলগুলো এগিয়ে দিয়ে থাকেন। এ কাজ করার পাশাপাশি তিনি রাজউকে কিছু বড় ধরনের অকাজও করেন। এই ফাইলগুলো থাকে তার নখদর্পণে। ফলে বিভিন্ন প্লটের ফাইল গায়েব করে রাখেন্ ওই প্লটের মালিকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে ফাইলের সন্ধান দেন। ঘুষ না দিলে ওই ফাইলের হদিস মেলে না। কখনও কখনও সেসব প্লটের ভূয়া মালিক সাজিয়ে একজনের প্লট আরেকজনের কাছে বিক্রিও করে দেন। প্লটের অবস্থান পরিবর্তন এবং আকার বৃদ্ধি করার দালালি করেও ঘুষ নেন তিনি। এ রকম অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অবশ্য এ অকাজ তিনি একাই করেন না, সঙ্গে রয়েছে একটি চক্র। স¤প্রতি এই বেঞ্চ সহকারী বাশার শরীফের বিরুদ্ধে ফাইল গায়েবের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা করেছে রাজউক প্রশাসন। বিভাগীয় মামলা হলে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার নিয়ম থাকলেও তার ক্ষেত্রে সেটা অনুসরণ করা হয়নি। ফলে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন এ বাশার শরীফ। এসব করে তিনি বিত্তবৈভবের মালিকও হয়েছেন। বিপরীতে ফাইল গায়েবের কারণে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন রাজউকের প্লট মালিকরা।

রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফাইল গায়েবের সঙ্গে যুক্ত চক্রটি এমন কিছু প্লটকে টার্গেট করে, আবার যে কর্মকর্তা তাদের কথা না শোনে তাদের পদোন্নতির ফাইলও গায়েব করে। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, প্রবাসী কোনো ব্যক্তি দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরলেন। তার প্লটের খবর নিতে রাজউকে গেলেন। তখনই জানতে পারলেন, তার ফাইল গায়েব। তখন চোখে অন্ধকার দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। যত টাকা লাগুক, ফাইল পাওয়া তার কাছে তখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এদিকে গায়েবি চক্র ওত পেতে থাকে। তার আশপাশেই ঘুরতে থাকে। বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ফাইলেরও হদিস মেলে। চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার ইমামপুর গ্রামের ছমির উদ্দিন মোল্লার ছেলে আবুল বাশার লন্ডনের ২৩-এ হেনজি স্ট্রিটে বসবাস করেন। তিনি জানান, পূর্বাচলে তিনি পাঁচ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ পেয়েছিলেন। সব টাকা তিনি পরিশোধ করেন। তার নামে বরাদ্দ করা হয় ৩০ নম্বর সেক্টরের ৩০৩ নম্বর রোডের ২২ নম্বর কর্নার প্লট। খুবই ভালো স্থানে। প্লটটি বুঝে নিতে চাইলে ওই গায়েবি চক্র বলে, তাকে ওই প্লটটি দেওয়া যাবে না। পরে ৩০১ নম্বর রোডের ২২ নম্বর প্লটটি দেওয়ার কথা বলা হয়। এই প্লটটি অনেক ভেতরে। ভালো লোকেশনে না। ঝামেলা এড়াতে প্রবাসী ওই প্লটটিই বুঝে নিতে চান। এবার বলা হয়, এটিও দেওয়া যাবে না। কারণ, ওই সড়কের ৩২ নম্বর প্লটের বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তির নামে ওই ২২ নম্বর প্লটটি রেজিস্ট্রি বা নিবন্ধন হয়ে গেছে। আর ৩২ নম্বর প্লটটিও আরেকজনের নামে রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে। একপর্যায়ে ওই প্রবাসীকে একই সড়কের ১২ নম্বর প্লটটি দেওয়ার কথা বলা হয়। এ পর্যায়ে প্রবাসী এই ১২ নম্বর প্লটটিই রেজিস্ট্রি করে নিতে চাইলেন। রেজিস্ট্রির সময় স্বাভাবিকভাবে সব নথি প্রয়োজন হয়। শুরু হলো নথি তল্লাশি। এবার ওই প্রবাসীকে রাজউকের চক্র জানাল, তার প্লট পাওয়ার কোনো ফাইলই নেই রাজউকের কাছে। প্রকৃতপক্ষে ফাইল রাজউকেই আছে, কিন্তু মোটা অঙ্কের ঘুষ খাওয়ার জন্য তাকে হয়রানি করা হয়। এরপর ওই প্রবাসী বাশার শরীফের কাছে যান। ফের মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তিনি ফাইলটি ফেরত পান। এভাবে গত ১৭ বছরে কাজ বাদ দিয়ে তাকে প্রায় ২৫ বার দেশে আসতে হয়েছে। কিন্তু প্লটটি আজও বুঝে পাননি লন্ডন প্রবাসী আবুল বাশার। শুধু আবুল বাশারই নন, এরকম আরও অনেকেই বছরের পর বছর রাজউকের এই চক্রের হাতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন, কিন্তু কোনো সমাধান মিলছে না। এভাবে শত শত সাধারণ মানুষ এ চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ওয়াজেদ আলী খান তার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। তিনি পূর্বাচলে পাওয়া ১৪ নম্বর সেক্টরের ৩০৫ নম্বর রোডের ১০ নম্বর প্লটটি তার নিকটাত্মীয়কে দলিল করে দিতে পারছেন না। তার ফাইলও গায়েব হয়ে গেছে। পরে বেঞ্চ সহকারী বাশার শরীফকে ঘুষ দিয়ে সেই ফাইল উদ্ধার করেন। প্লট রেজিস্ট্রি করার সময় কৃত্রিমভাবে সমস্যা সৃষ্টি করা হয়। এ ছাড়া রাজউক শ্রমিক লীগের কক্ষ থেকে আরও কিছু ফাইল পাওয়া যায়। গোল্ডেন মনির নামের এক দালাল রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগসাজশ করে বিভিন্ন প্লটের ফাইল নিয়ে ওই কক্ষে রাখেন। পরে বাশার শরীফের কাছ থেকে আরও তিনটি ফাইল উদ্ধার হয়। দুটি ফাইলের ব্যাপারে তিনি নানা যুক্তি উপস্থাপন করেন। ফাইল তার কাছে রাখার কারণ ব্যাখ্যা করেন।

রাজউক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ১৮ নম্বর সেক্টরের ৪০২ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর প্লটের ফাইলটি ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি হারিয়ে যায়। ওই ফাইল নথি উপস্থাপনকারী সাইফুল্লাহ চৌধুরীর দপ্তর থেকে ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর পর্যন্ত বাশার শরীফ তার কাছে আটকে রাখেন। রাজউক কর্মকর্তা ও কর্মচারী চাকরি বিধিমালার ২০১৩-এর ৩৭(চ) অনুযায়ী বিষয়টি চুরি বা প্রতারণার শামিল। তবুও ফাইল গায়েব বন্ধ হচ্ছে না। গত ৩ সেপ্টেম্বর রাজউক বাশার শরীফের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। যার মামলা নং ১০/২০২০।

বেঞ্চ সহকারী বাশার শরীফ ইনকিলাবকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেটা বিভাগীয় মামলা হয়েছে, সেটা অন্য ধরনের বিভাগীয় মামলা। আমি কখনোই এসব কাজের সঙ্গে যুক্ত নাই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমি সব সময় সোচ্চার।



 

Show all comments
  • রুহান ২১ অক্টোবর, ২০২০, ৩:০৫ এএম says : 0
    সব জায়গার দুর্নীতি আর দুর্নীতি
    Total Reply(0) Reply
  • Md Apon ২১ অক্টোবর, ২০২০, ৩:০৬ এএম says : 0
    সব দোষ দেশের সরকারের সরকার যদি সঠিক আইন ব্যবস্থা থাকত তাহলে কোন ..................... এই ধরনের কাজ করার সাহস পেত না
    Total Reply(0) Reply
  • Yousuf Mohammed ২১ অক্টোবর, ২০২০, ৩:০৭ এএম says : 0
    হালাল হারামের গুরুত্ত যদি মানুষ বুঝত তাহলে কারু জীবনেই জালিয়াতি করতনা।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Ibrahim ২১ অক্টোবর, ২০২০, ৩:০৮ এএম says : 0
    বাংলাদেশের সব জায়গায় তেই দালাল এই দালালদের কারনে সাধারন মানুষ অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয় আমি মনে করি যারা দালালি করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত
    Total Reply(0) Reply
  • নুরজাহান ২১ অক্টোবর, ২০২০, ৩:০৮ এএম says : 0
    কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজউক

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ