Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চেতনায় জীবন্ত বঙ্গবন্ধু

প্রকাশের সময় : ১৫ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক

বিশেষ কারণে আজকের এই দিনটি একটি শোকাবহ দিন। আমরা এমন একজন ব্যক্তিকে এই দিনটিতে হারিয়েছি যার অনেক বড় অবদানের কারণে আমরা নিজকে বাংলাদেশী বলে গর্ব করে পরিচয় দিয়ে থাকি। সে ব্যক্তিটির নাম বঙ্গবন্ধু। প্রতি বছরই এই ১৫ আগস্ট আসে, প্রতি বছরই এই দিনটিকে ঘিরে থাকে মানুষের মনে নানা কৌতূহল। রাষ্ট্রীয়ভাবে দিনটিকে বিশেষভাবে পালন করা হয় বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে। অনেক লেখালেখি হয়, অনেক সেমিনার হয়, অনেক বক্তা ভাষণ দেন।
নন্দিত হয়েই কেউ জন্মগ্রহণ করে না। জন্মগহণ করে নিজ কর্মের মাধ্যমেই নন্দিত হতে হয়। বঙ্গবন্ধুও কিন্তু শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন না। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করা এই ব্যক্তি ধীরে ধীরে তার মেধা ও মননের বিকাশ ঘটিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন এক সাহসী সন্তান হিসেবে। খোকা নামের এই ছেলেটার পুরো নাম ছিল শেখ মুজিবুর রহমান। পিতা লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুন। বড় হয়েছিলেন অজপাড়াগাঁয়ে। তখন কেউ জানতেন না যে এই ছেলেটা একদিন বাঙালির মুক্তি সনদ রচনা করে ফেলবেন। বাঙালি জাতিকে নিয়ে যাবেন তাদের স্বাধীন বন্দরে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে অবিস্মরণীয় নাম হয়ে থাকবেন চিরদিন। হয়তো সেদিন এ ছেলেটিও ভাবেনি তার স্মৃতিকে বুকে লালন করবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির কোটি কোটি মানুষ এবং কেউ এও ভাবেনি সুচিন্তিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় অধিকার করা যে সম্ভব সেটা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করে দেবেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জীবন ও রাজনীতি, বাঙালির ঐতিহাসিক বিবর্তন ধারায়, একটি ভৌগোলিক সীমারেখায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালির হাজার বছরের আশা-আকাক্সক্ষা, বেদনা-বিক্ষোভ ও আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে তিনি নিজের চেতনায় আত্মস্থ করেছেন। তার কণ্ঠে বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তির আকাক্সক্ষা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক। জাতির মুক্তি সংগ্রামের নিবেদিতপ্রাণ উৎসর্গীকৃত সন্তানদের একজন। তিনি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আমাদের বিস্মৃত জাতিসত্তাকে জাগ্রত করে দিয়েছেন। যুগ যুগ ধরে পরিচালিত মুক্তি-সংগ্রাম, রাজনৈতিক কর্মকা- ও বিভিন্ন নেতার দর্শন শেখ মুজিবুরের রাজনৈতিক জীবন ও চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করেছে। একজন মানুষ হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের মহত্ত্ব এখানে যে, বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য তিনি লড়াই করেছেন। তিনি তার সমস্ত জীবন, চিন্তাভাবনা ও শ্রম উৎসর্গ করেছিলেন এই জন্য যে এদেশের মানুষ যেন খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে বাঁচতে পারে, আত্মমর্যাদা নিয়ে বিশ্বের দরবারে নিজেদের ন্যায্য স্থান পেতে পারে। মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারে তাদের অধিকার নিয়ে।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন আদর্শবাদী ও নীতিবান মানুষ হিসেবে এদেশের সাধারণ মানুষের একান্ত কাছাকাছি মিশেছিলেন। এজন্য তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন ‘আমি তোমাদেরই লোক।’ কোনো উচ্ছ্বাস বা অতিশয়োক্তির স্থান ছিল না এই উচ্চারণে। দেশবাসীর ওপর তার প্রভাব ছিল অমোচনীয়। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ একদিন তার কথায় অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে। কারণ তারা জানতো এই মানুষটি দেশের মানুষের ভালোবাসা ছাড়া কিছুই চান না। তিনি পাকিস্তানের মন্ত্রিত্ব চাননি, তিনি চেয়েছিলেন বাঙালিকে বিশ্বের দরবারে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে পরিচয় করে দিতে। এ ছাড়া তার আর অন্য কোনো স্বপ্ন ছিল না। বিংশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আমাদের বঙ্গবন্ধুর কথা মনে রাখতে হবে। তিনি একটি অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। সামরিক জান্তার উস্কানি, হত্যা, রক্তপাত এবং অবাঙালিদের দিয়ে বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি সত্ত্বেও তিনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকে সরে আসেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেই সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র অবস্থানের মধ্যে বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনা করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশের ভূখ- থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুরই ঐকান্তিক আগ্রহে। এ থেকে ও তার ব্যক্তিত্বেও অসাধারণত্ব প্রকাশ পায়। কারণ এখানে মনে রাখার মতো বিষয় হলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পঞ্চাশ বছর পরও জার্মানির মাটিতে মার্কিন, সোভিয়েট, ব্রিটিশ ও ফরাসী সেনাবাহিনীর অবস্থান ছিল। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু অনেকটাই দূরদর্শী/বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। কোরিয়ার যুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পরও দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন সৈন্য অবস্থান করে। সুতরাং এই কৃতিত্বের মূল্য বঙ্গবন্ধুকে দিতেই হবে।
তার ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের কারণেই ১৯৬৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ছাত্র সমাজের কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ তৎকালীন পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি সংবর্ধনা প্রদান করে। লাখ লাখ মানুষের গগনবিদারী শ্লোগান এবং করতালির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের তৎকালীন সভাপতি তোফায়েল আহমেদ সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে সমগ্র বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। যিনি দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক কার্যক্রম ত্যাগ, আন্দোলন এবং চূড়ান্ত পর্বে মুক্তি সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দিয়ে একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য একটা মুক্ত স্বাধীন স্বদেশ এনে দিতে পারেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠের শিরোপা তারই প্রাপ্য। বিশ্বের মানচিত্রে আরেকটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্রষ্টা হওয়ার কৃতিত্বের পাশে অন্য যে কোনো মহৎ মানুষের মহান কৃতিত্ব মøান হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু তেমন কাজটিই করেছেন এবং এর মধ্য দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তার অসামান্য ব্যক্তিত্ব দ্বারা তিনি ঊনসত্তর ও সত্তরের গণআন্দোলনকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। দুর্বার জাতীয় ঐক্য অর্জনের সংকল্পকে তুঙ্গে নিয়ে যান। বজ্রকঠোর করে তোলেন ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দু’টি রাজনৈতিক পরিচয়। প্রথম পরিচয় মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উৎসাহ ও প্রেরণাদাতা এবং নেপথ্যে বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি। এই পরিচয়ের আরেকটি অংশ হলো ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত পরিচালিত ছয় দফাভিত্তিক স্বাধিকার বা প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্মদাতা। তিনি বাঙালি জাতিকে প্রস্তুত করেছিলেন স্বাধীনতার লক্ষ্যে মুক্তি সংগ্রামের জন্য। যদি পাকিস্তানের ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার তৎকালীন আওয়ামী লীগের ছয় দফা প্রস্তাব মেনে নিত অথবা ছয় দফার ভিত্তিতে পরিচালিত ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিত তাহলে আজকের বাংলাদেশ স্বাধীন থাকত নাকি পাকিস্তান নামক প্রদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ থাকত নাকি বিশাল ক্ষমতাসীন একটি প্রদেশ থাকত সেটা আমাদের কারো পক্ষে বলা সম্ভবপর ছিল না। যা হোক চার-পাঁচ বছরের কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে প্রস্তুত করেছিলেন যে কোন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির জন্য। বিশেষভাবে ৭ মার্চ ১৯৭১ সালের তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে তার মূল্যবান ভাষণের মাধ্যমে তিনি বাঙালি জাতিকে প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। জাতি বলতে আমি মূলত জাতিগোষ্ঠীকে বা জনগোষ্ঠীকে বুঝাচ্ছি। তৎকালীন সামরিক বাহিনীর সদস্য বাঙালির গর্বিত বীর সেনা ও পুলিশ সদস্যগণকে বুঝায় এবং অবশ্যই এর মধ্যে তরুণ ও যুবকরাতো আছেই।
বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পরিচয় ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখের পর থেকে। তিনি প্রথমে এসে রাষ্ট্রপতি হন, মাঝখানে বছর দুয়েকের মতো তিনি প্রধানমন্ত্রী হন আবার কিছুদিন যেতে না যেতেই তিনি রাষ্ট্রপতি হয়ে যান। এটা ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সবে জন্ম নেয়া নতুন রাষ্ট্রটির নতুন রাজনৈতিক অঙ্গনে তার নতুন রাজনৈতিক পরিচয়কে স্থিতিশীল করার প্রাণান্তকর চেষ্টা। আমার বিনীত মূল্যায়ন, ১৯৭১ সালে মার্চ মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের জানুয়ারির পরের বঙ্গবন্ধু এক নন। দুই বঙ্গবন্ধুর মধ্যে একটি গুণগত পার্থক্য ও তাৎপর্যগত তফাত পরিলক্ষিত হয়েছে যেটা স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ স্বচক্ষে দেখতে পেরেছিল। কিন্তু আজকের এই মহান দিনে কোন নেতিবাচক কথা বলে তাকে খাটো করা সমীচীন বলে আমি মনে করি না। আমি তার বিদেহী আত্মার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। আশা করি বাংলাদেশের ইতিহাসে ও গণমানুষের হৃদয়ে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম স্বাধীনতার চিন্তা-চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে দেশের তরে নিবেদিত প্রাণ হয়ে নিজেদের উৎসর্গ করবে। যতোদিন মুক্তিযোদ্ধাদের নাম লেখা থাকবে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা যতো দিন বাংলার আকাশে উড়বে ততোদিন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু ও বাংলার বীর সন্তানদের নামও আমরা মনের অন্তস্থল থেকে স্মরণ করবো। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সেদিন বঙ্গবন্ধুর ডাকেই পরিচালিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ছিলেন কর্নেল এম এ জি ওসমানী। তার নিচে ছিলেন অন্য সম্মানিত সেক্টর কমান্ডারগণ। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি তাদের প্রত্যক্ষ কমান্ডার ছিলেন সেক্টর কমান্ডারগণ আর এমনি একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় অর্ধেকে ছিলেন ফোর্স কমান্ডার, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যিনি তার স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে পাকিস্তানি পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পাশাপাশি, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় অকুতোভয় সফল রাষ্ট্রনায়ক। আমরা এই দিনে একইসাথে দুই রাষ্ট্রনায়কের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছি এবং তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চেতনায় জীবন্ত বঙ্গবন্ধু
আরও পড়ুন