অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে পাকিস্তান আন্দোলনে আমার ভূমিকা
শেখ মুজিবুর রহমানঅখন্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মন প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস
হোসেন মাহমুদ
বাংলাদেশের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কেউ কেউ মনে করেন সময়ের প্রয়োজনে ইতিহাস তাকে সৃষ্টি করেছিল আবার কেউ কেউ মনে করেন তিনিই ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। কারো কারো কাছে এ দুটিই সত্যি মনে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তার প্রয়োজন ছিল, তাই ইতিহাস তাকে সেভাবেই তৈরি করেছিল। আর তিনি পরিস্থিতির সাথে পাঞ্জা লড়ে বাংলাদেশ সৃষ্টির পথ রচনা করেন। তিনি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন নিঃসন্দেহে। তার বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম নিয়ে গুণীজনেরা বিভিন্ন সময়ে বহু লেখা লিখেছেন। তাকে নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক গ্রন্থ। এসব লেখালেখি ও গ্রন্থসমূহ হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জীবনের আয়না যেখানে তিনি নানাভাবে প্রতিবিম্বিত। বঙ্গবন্ধুকে জানা ও বোঝার জন্য এগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ঢাকার বাইরের একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুর গভীর ¯েœহলাভ করেছিলেন। স্বার্থের প্রয়োজন নয়, নিখাদ ¯েœহ ছিল তা। এ সৌভাগ্যবান মুক্তিযোদ্ধা হলেন সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান আবু মোহাম্মদ খান (বাবলু)। বঙ্গবন্ধুর সাথে তার পরিচয় হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের আগে, ১৯৬৯ সালে। তিনি ‘১৯৭১ ও অনেক অজানা কথা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। ২০১০ সালে এ গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বিরাটাকারের গ্রন্থটিতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন। এ গ্রন্থে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঃ তাকে যেমন দেখেছি’ নামে একটি অধ্যায়ে তিনি শেখ মুজিবের সাথে তার পরিচয় ও কিছু ঘটনার কথা বর্ণনা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের অনন্য চরিত্রের কিছু দিক ও গুণের পরিচয় ফুটে উঠেছে যা আর কারো লেখায় বিধৃত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। মনে হয়, জাতির ত্রাতা হিসেবে আর ক’দিন পর যার নাম লেখা হতে চলেছে তার জন্য মানুষের মনে সেই অদৃশ্য শক্তি এভাবেই তখন তার জন্য স্থান তৈরি করে দিয়েছিল। তিনি দূর গ্রামের বাবলুর মত এক স্কুল ছাত্রসহ দেশের অগণিত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন।
মুক্তিযোদ্ধা বাবলু লিখেছেন যে ,‘১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন জেল থেকে ছাড়া পান তখন আমি ১৫ বছর বয়সের কিশোর। রক্তের তেজ অনেক বেশি...ছাত্রলীগের একজন সমর্থক ও কর্মী হয়ে পড়েছি।’ এরপর তিনি বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য আকুল হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাঁর সাথে দেখা হওয়াতো সহজ কথা নয়। ঢাকায় আসার জন্য মনস্থির করলে তিনি। আগের দিন বিকেলে জামতৈল স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে সিরাজগঞ্জ ঘাট পার হয়ে জগন্নাথগঞ্জে আবার ট্রেন ধরে পরদিন সকালে তিনি ফুলবাড়িয়া আসেন। ওঠেন হোটেলে। তারপর দিন ভোরে রিকশা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসায় পৌঁছেন। অত ভোরে কেউ ওঠেনি। তাই বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। ঘন্টাখানেক পর আকরাম হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে পেলেন সেখানে। তাঁকে ধরলেন বাবলু, নেতার সাথে দেখা করিয়ে দিতে হবে। তিনি আশ্বাস দিলেন, অপেক্ষা কর, দেখা পাবে। এরপর সব বড় বড় নেতারা এলেন। বাবলুর আর অপেক্ষা সহ্য হয় না। আকরামকে তাগাদা দিলেন, গিয়ে আমার নাম বলেন। যাহোক, সাড়ে আটটার সময় শেখ মুজিব সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে জোরে ডাকতে লাগলেন, সিরাজগঞ্জের বাবলু কে? সিরাজগঞ্জের বাবলু কে? এরপর বাবলুর নিজের ভাষাঃ ‘আমি এগিয়ে গিয়ে বললামÑ আমি। তিনি আমার সাথে খুব জোরে হ্যান্ডশেক করলেন, দুই গালে আস্তে আস্তে কয়েকটি আদরের থাপ্পড় মারলেন, মাথায় হাত বুলালেন। বাবার নাম জিজ্ঞাসা করলেন, কি করেন, কয় ভাইবোন। এক পর্যায়ে বললেন, আবার দেখা হবে।’
এরপর ১৯৭০ সালে বাবলু বেশ কয়েকবার ঢাকা আসেন। বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সভায় যান। দেখা হয়, সালাম দেন, তাঁর সাথে কথা হয় না। এরমধ্যে একবার বাসায় গেলে তিনি তাকে কাছে ডেকে নেন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলিকে বাবলু চেনেন কিনা জিজ্ঞেস করেন। হ্যাঁ বললে জানতে চান, মনসুর আলি কেমন লোক। বাবলু বলেন, তিনি ভালো লোক। কেমন করে বুঝলি সে ভালো? বাবলু বলেন, তার বিরুদ্ধে কেউ খারাপ বলেনা, তাই। বঙ্গবন্ধু শুনে খুশি হয়ে বলেন, মনসুর আলিকে আমি এবার নির্বাচনে নমিনেশন দেব। তুই তাকে নিয়ে সব জায়গায় সভা করবি। বাবলু তাই করেন। মনসুর আলী জয়লাভ করেন।
শেখ মুজিব ১৯৭০ সালের আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে বেলকুচি ও চৌহালি থানার বন্যা দেখতে যান। সকাল ১০টার দিকে তার যাওয়ার কথা ছিল। বঙ্গবন্ধু আসছেন, বাবলুসহ বহু কর্মীর আনন্দ-উৎসাহে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষ এসেছে তাকে দেখতে। তিনি সিরাজগঞ্জ থেকে জিপে করে এলেন বেলা ডোবার অল্প আগে। এরপর বাবলুর বর্ণনা ঃ ‘আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, লিডার! আপনার আসার কথা বেলা দশটায়। ...এত দেরি করে এলেন। অনেক লোক খুব রাগ করেছে। জবাবে বঙ্গবন্ধু বললেন, তুই থাম। আমি দেখছি। বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে তোলা হল। ...বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা শুরু করলেন এই বলে যে ভাইসব! বাবলুর কাছে শুনলাম আপনারা আমার উপর রাগ করেছেন। আমার আসবার কথা সকাল দশটায়, এলাম বিকাল ৫টায়। স্বাভাবিকভাবেই আপনাদের রাগ হবার কথা। কিন্তু এই দেরির জন্য আমি দায়ী নই। এখানে সকাল দশটার মধ্যে আসব বলে কাল সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছি। কিন্তু রাস্তার মধ্যে লোকজন আমার আসা-যাবার খবর পেলে আমাকে থামায়, আমাকে দেখতে চায়, আমার কথা শুনতে চায়, তারা আমাকে ভালোবাসে। তাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে, তাদের সাথে দেখা না করে, দু’চারটি কথা না বলে চলে আসা কি ভালো? আপনারা কি বলেন? হাজার হাজার মানুষ উত্তরে বলেÑ না, না। তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, এরপরও কি আমার উপর আপনাদের রাগ আছে? জনতা উত্তর দেয়Ñ না, না। হাজার হাজার মানুষ মুহূর্তের মধ্যে আবার বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হয়ে গেল।’
বঙ্গবন্ধু বেলকুচির সভা শেষ করে দীঘলকান্দির দিকে যান। সেখান থেকে রাতে তার সিরাজগঞ্জ ফেরার কথা। এদিকে অত মানুষের ভিড়ে বঙ্গবন্ধুকে ভালো করে দেখতে না পেয়ে বাবলুর কিছু বন্ধুর খুব আফসোস হয়। তারা তাকে ফেরার পথে দেখার জন্য ওয়াপদার বাঁধে অপেক্ষা করতে থাকেন। রাত ২টার দিকে দূরে জিপের আলো দেখা যাচ্ছিল। এ সময় আঃ হাই নামে বাবলুর এক বন্ধু সেখানে একটি খড়ের গাদায় হাত দিতেই সাপ তাকে ছোবল দেয়। বাবলু দ্রুত তার গায়ের দামি শার্ট ছিঁড়ে তার হাতে বাঁধন দেন। এদিকে জিপ এসে পড়ে। গাড়ি থামলে বঙ্গবন্ধু বলেন, ওরে পাগলের দল! কি সর্বনাশ, তোরা এখনো রয়েছিস? তখন বাবলু তাকে বলেন, লিডার! আপনাকে তখন ভালো করে দেখতে পারি নাই। তাই আবার দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। তারপর তিনি তাকে দুর্ঘটনার কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে গাড়ি থেকে নেমে আঃ হাইর কাছে যান। তিনি বলেন, ওকে জিপে ওঠা, আমি নিয়ে যাব। এ সময় জিপে থাকা নেতা কোরবান আলি বলেনঃ লিডার, এত রাতে এই ভেজাল গাড়িতে উঠায়েন না, ওকে এখানেই রেখে যান, কোনো লোকাল ট্রিটমেন্ট ওরা করাবে। সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু খুব রেগে যান। ড্রাইভারকে বলেনঃ ভাই, তুমি আমার সিটে এই ছেলেকে নিয়ে যাও। একে সিরাজগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করে দিবে। আমি এদের সাথে যাব না, আমি এখানেই ওদের সাথে থাকব, যদি সম্ভব হয় কাল সকালে আটটার মধ্যে এসে আমারে নিয়ে যাবা।... এ বলে তিনি বাঁধ থেকে নিচে নেমে দাঁড়ান। পরে বাবলুর অনুরোধে তিনি জিপে ওঠেন এবং নিজে থেকে হাইকে তার কোলে শুইয়ে নেন। ২০ মাইল পথ এভাবে তাকে বয়ে নিয়ে রাত সাড়ে তিনটায় পৌঁছেন সিরাজগঞ্জ হাসপাতালে। দেখেন, হাসপাতালে কোনো ডাক্তার নেই। তখন জিপ নিয়ে ছোটেন প্রধান ডাক্তারের বাসায়। তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে অনুরোধ করে হাসপাতালে আনার পর দেখা যায় সাপে কাটার চিকিৎসার ওষুধ হাসপাতালে নেই। ওষুধের দোকান থেকে কিনে আনতে হবে। তখন সব দোকান বন্ধ। বঙ্গবন্ধু বের হলেন ওষুধের সন্ধানে। ওষুধের দোকানে গিয়ে দেখেন বাইরে থেকে তালা দেয়া। পাশের দোকানিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তার কাছ থেকে ওষুধের দোকানির বাড়ির ঠিকানা নেন। তাদের একজনকে সাথে নিয়ে যান সে ওষুধের দোকানদারের বাড়ি। তারপর তাকে দোকানে এনে দুশ’ পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দু’টি ইঞ্জেকশন কিনে নিয়ে ফেরেন হাসপাতালে। ডাক্তার ইঞ্জেকশন দেয়ার পর হাইয়ের জ্ঞান ফেরে। তখন বঙ্গবন্ধু একজনের বাসায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে সকাল নয়টার ট্রেন ধরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। বাবলু জানান, সকালে বঙ্গবন্ধুর সাথে ট্রেনে দেখা হলে তিনি এসব কথা তাকে জানান।
১৯৭৪ সালে বাবলু তার মাকে চিকিৎসার জন্য পিজি হাসপাতালে ভর্তি করেন। তার মা ছিলেন ২৪১ নং কেবিনে। সে সময় প্রখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা চট্টগ্রামের জহুর হোসেন চৌধুরী ২৪২ নং কেবিনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাকে দেখার জন্য বঙ্গবন্ধু বেশ কয়েকবার পিজি হাসপাতালে যান। এরপর বাবলুর বর্ণনা ঃ ‘বঙ্গবন্ধু জহুর হোসেন চৌধুরী সাহেবকে দেখে একদিন ফিরে আসছেন পিজির তিন তলার পশ্চিম দিক থেকে, আমি পূর্বদিক থেকে পশ্চিমে যাচ্ছি। আমার হাতে একটি টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি, তাতে আমার মায়ের জন্য স্যুপ কিনে নিয়ে আসছি। বঙ্গবন্ধু আমার হাতে টিফিন ক্যারিয়ার দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার! তোমার হাতে টিফিন ক্যারিয়ার? আমি জবাবে বললাম, আমার মা ২৪১ নম্বরে ভর্তি হয়েছে। এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমার মাথার ঐ সময়ে লম্বা চুল ধরে খুব জোরে দুই গালে ৪/৫ থাপ্পড় মারলেন এবং বললেন, হারামজাদা! তোমার মা সিরাজগঞ্জ থেকে এসে পিজি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, আর তুমি আমাকে জানাও নাই। এরপর ডা. নুরুল ইসলামকে বললেন, নুরুল ইসলাম, খুব ভালোভাবে খেয়াল রেখে চিকিৎসা করবা। খরচপাতির জন্য চিন্তা করবা না। তখন নুরুল ইসলাম সাহেব বললেন, স্যার! ঐ মহিলার গায়ে রক্ত নাই, না খাওয়া মানুষ। তখন বঙ্গবন্ধু আবার আমার গালে দুই থাপ্পড় মারলেন জোরে জোরেÑ মাকে ভাত দাও না কেন?... বঙ্গবন্ধু আবার আমার সাথে উল্টা পথে পশ্চিম দিকে ২৪১ নং কেবিনে গেলেন। ২/১ মিনিট থেকে চলে গেলেন। আমার মা প্রায় ১ মাস পিজিতে ছিলেন। এর মধ্যে চারবার বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে ভাত এসেছে খাবারের জন্য। শেখ কামাল ভাই বেশ কয়েকবার দেখতে এসেছিলেন।’
আমরা রাজনীতিক বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কম-বেশি জানি। তার দেশ পরিচালনার কথাও অনেকটাই জানি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা আবু মোহাম্মদ খান (বাবলু) স্বল্প পরিসরে হলেও তাকে যেভাবে দেখেছেন, জেনেছেন সেভাবে অনেকেই হয়ত তাকে দেখেননি, জানেননি। তাই , তার চরিত্রের এ দিক সম্পর্কে অনেক মানুষেরই সম্ভবত তেমন জানা নেই। এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনন্য, অতুলনীয়ও বটে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।