Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আত্মশুদ্ধি ও অন্তরের উদাসীনতা

মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান | প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০২ এএম

আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সর্বোত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের চোখ, মুখ, হাত, পা ইত্যাদি অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো আল্লাহরই বিশেষ অনুগ্রহ। এই অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলির সমষ্টি হলো দেহ নামক কাঠামো। আর প্রত্যেক দেহের মধ্যেই অবস্থান করে একটি কালব বা আত্মা। এই কলব হলো সকল অঙ্গ প্রতঙ্গ গুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এই কালব বা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করাই হলো আত্মশুদ্ধি। ইবাদতের জন্য যেমন বাহ্যিক পবিত্রতা প্রয়োজন তেমনি অন্তরের জন্য পবিত্রতাও গুরুত্ব পূর্ণ। মানুষের অন্তর বা আত্মার পবিত্রতা অর্জন করার উপায় হলো আত্মাশুদ্ধি অর্জন। আত্মশুদ্ধি মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষে পরিনত করে। হযরত নুমান ইবনে বশির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেন, “জেনে রাখো! শরীরের মধ্যে একটি মাংসপিন্ড আছে, যা ঠিক থাকলে পুরো দেহ ঠিক থাকে। আর যদি তা কলুষিত হয়, তবে পুরো শরীরই কলুষিত হয়। মনে রেখো! তা হলো কলব বা অন্তর”। পৃথিবীতে যারা আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য ও বৈচিত্র দেখেও না দেখার ভান করে, আল্লাহকে অস্বীকার করে তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা নগদ একটি শাস্তি প্রদান করেন। তা হলো তাদের তিনটি অঙ্গপ্রতঙ্গ তথা চোখ, কান ও অন্তর থেকে সত্য গ্রহনের যোগ্যতা রহিত করে দেন। ফলে মানুষ হিসেবে তাদের অবস্থান সবার উর্ধ্বে হলেও সত্যকে উপলব্ধি করার মত বুদ্ধি, দেখার মত দৃষ্টিশক্তি, শোনার মতো শ্রবণশক্তি তাদের থাকেনা।

মন্দ প্রবৃত্তি মানুষকে ধ্বংস করে ঃ মন্দ প্রবৃত্তি মানুষকে অজ্ঞতা ও অন্যায়ের দিকে নিয়ে যায়। মনের স্বরূপ বা প্রাকৃতি যে চিনতে পারে সেই বুঝতে পারে যে আত্মা হলো যাবতীয় মন্দ কাজের উৎস। মন্দ প্রবৃত্তি মানুষকে চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। হযরত বাসুলে আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, তিনটি গুণ মুক্তিদাতা ও তিনটি গুণ ধ্বংসকারী। মুক্তিদাতা তিনটি গুণ হলো, ১। গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করা, ২। সস্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি উভয় অবস্থায় সত্য কথা বলা, ৩। সচ্ছলতা ও দরিদ্রতা উভয় অবস্থায় মিতব্যয়ী হওয়া।
আর ধ্বংসকারী তিনটি হলো ঃ ১। প্রবৃত্তি অনুসরণকরা, ২। লোভ লালসা করা, ৩। আত্মমগ্ন হয়ে নিজেকে নিজে সম্মানিত মনে করা। [বায়হাকী, শুআবুল ইমান- ৭২৫২]
অন্তর স্বচ্ছ আয়নার মতো ঃ মানুষের হৃদয়কে স্বচ্ছ আয়নার সাথে তুলনা করা হয়েছে। কখনো সেটি হয়ে যায় আলোর ফোয়ারা, আবার কখনো হয়ে যায় অন্ধকার গর্তের মতো। কখনো হয়ে যায় হেদায়াত অর্জনকারী আবার কখনো হয়ে যায় শয়তানের অনুসারী। ফলে হেদায়ত অর্জনকারীদেরকে নানা রকম মর্যাদা দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দানকরা হয়, আর ভ্রষ্ট প্রবৃত্তির অনুসরণকারীদের লাঞ্চনা দিয়ে শাস্তি প্রদান করা হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, নিশ্চয় পুণ্যময় আমল মানুষের চেহারায় ও অন্তরেআলো তৈরি করে। রিজিকে প্রশাস্ততা ও শরীরে সামথ্যা তৈরি করে। পুরো সৃষ্টি জগতের অন্তরে তার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে পাপ মানুষের চেহারাকে মলিন, অন্তর ও কবরকে আলোহীন, শরীরকে দূর্বল, রিজিকে সংকোচন এবং সৃষ্টি জগতের অন্তরে তার প্রতি ঘৃণা তৈরি করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- অতঃপর আল্লাহ যাকে পথ প্রদর্শন করতে চান, তার বক্ষকে ইসলামের জন্য উম্মুক্ত করে দেন এবং যাকে বিপদগামী করতে চান, তার বক্ষকে সংকীর্ণ- অত্যধিক সংকীর্ণ করে দেন। [সূরা আনআম - ১২৫]
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, আল্লাহ যার বক্ষ ইসলামের জন্য উম্মোক্ত করে দিয়েছেন, অতঃপর সে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে আলোর মাঝে রয়েছে। যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণের ব্যাপারে কঠোর, তাদের জন্য দূর্ভোগ তারা সুস্পষ্ট গোমরাহীতে রয়েছে। [সূরা যুমার - ২২]
মনের উদাসীন ব্যক্তি পশুর সমান ঃ মানুষের মন যখন মন্দ স্বভাবের হয়, ভালো কাজের প্রতি উদাসীন যাকে, তখন দুনিয়ার প্রতি তার আসক্তি বেড়ে যায়। তাকে পরিনত করে হিংস্র পশুতে। সত্য ও কল্যাণের আহবান সে শুনতে পায়না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- আর আমি সৃষ্টি করেছি দোযখের জন্য বহু জিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে, তা দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে না,তাদের চোখ রয়েছে তা দ্বারা দেখেনা, আর তাদের কান রয়েছে, তা দ্বারা শুনেনা। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই গাফেল (উদাসীন)। [সূরা আল-আরাফ: ১৭
প্রবৃত্তির অনুসরণ শিরকের মতো অপরাধ ঃ প্রবৃত্তির অনুসরণ করা শিরকের মতো অপরাধ। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
আপনি কী কখনো সে ব্যক্তির অবস্থা ভেবে দেখেছেন যে তার প্রবৃত্তির কামনা বাসনাকে খোদা বানিয়ে নিয়েছে আর জ্ঞান থাকার সত্তে¡ও আল্লাহ তাকে গোমরাহীর মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন। [সূরা যাসিয়া:-২৩]
হযরত শাদ্দাদ ইবনে আউস (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, আমার বড় ভয় হয় যে, আমার উম্মত খোদার সাথে শিরক না করেবসে। স্মরণ রাখবে যে, আমি এই বলিনা যে, আমার উম্মত চন্দ্র-সূর্য বা প্রতিমা পূজা করবে, কিন্তু ভয় এটি যে, তারা নফস বা প্রবৃত্তির বাসনার জন্য আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে আমল করবে। [সুনানে ইবনে মাজাহ- ৪২০৫]
মন্দ প্রবৃত্তি মানুষের চরম শত্রু ঃ মানুষ মাঝে মাঝে এমন পরীক্ষায় পতিত হয় যে তার মন তাকে উপকারী কাজ কারবার থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। মন্দ কাজে নিযুক্ত রেখে আল্লাহর আনুগত্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একদিন তার সহাবায়ে কেরামদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, এরূপ সাথী সম্পর্কে তোমাদের ধারনা কেমন? যাকে অন্ন দিলে, বস্ত্র দিলে, সম্মান করলে সে তোমাদেরকে বিপদে ফেলে দেয়। পক্ষান্তরে তাকে অবমাননা করলে, তাকে ক্ষুধার্থ ও বস্ত্রহীন রাখলে সে তোমাদের সাথে সদ্ব্যবহার করে। সাহাবায়ে কেরামগন বললেন, দুুনিয়াতে এর চাইতে মন্দ কিছু হতে পারেনা। নবিজী বললেন, ঐ সত্তার কসম! যার কব্জায় আমার প্রাণ, তোমাদের বুকের মধ্যে যে মনটি আছে সেই এধরনের সাথী।
মানুষের মনে পাপের মরিচা পড়ে ঃ উপমহাদেশের বিখ্যাত দার্শনিক শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহঃ) বলেন, সূর্য যখন ডুবে যায় তখন আধাঁর নেমে আসে পৃথিবীতে। পৃথিবী বুঝতে পারেনা কতটুকু আলো হারিয়েছে এবং কতটুকু অন্দকারে ডুবেছে, এবং সামনে আরো কতো আধাঁর অপেক্ষা করছে। তদ্রুপ পাপ কাজ ও মানুষের মনকে অন্ধকার করে দেয়। মরিচা যেভাবে লোহাকে খেয়ে ফেলে তেমনি পাপও মানুষের যাবতীয় যোগ্যতাকে ধ্বংস করে দেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, কখনো নয় বরং তারা যা করে, তাই তাদের হৃদয়ে মরিচা ধরিয়ে দিয়েছে। [সূরা মুতাফফিফিন - ১৪]
রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, মোমিন যখন কোনো পাপ করে তার অন্তরে তখন কালো দাগ পড়ে। সে যদি ক্ষমা প্রার্থণাকরে, পাপ পরিহার করে, তবে তার অন্তর পরিষ্কার হয়ে যায়। আর যদি সে বাড়িয়ে দেয় তবে দাগটি ও বাড়তে থাকে, এক সময় পুরো অন্তর ছেয়ে যায়।
বিশুদ্ধ অন্তর বিশিষ্ট ব্যক্তিরাই আল্লাহর প্রিয় পাত্র হন ঃ যে পূণ্যাত্মা আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে প্রশান্তি লাভ করে শয়তানকে ঘৃণা করে থাকে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে খুব পছন্দ করেন। আল্লাহ তায়ালা তাদের ব্যাপারে বলেন- হে প্রশান্ত মন। তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও। সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তভুর্ক্ত হয়ে যাও আর আমার জান্নাতে প্রবেশ কর। [সূরা আলফজর, ২৭-৩০]
তাই বলা হয় থাকে এধরনের প্রশান্ত চিত্তের অনুসারীগণ পরকালে সপ্ত আকাশে আরশের ছায়াতলে থাকবে।
মুমিন নিজের নফসকে তিরস্কার করে থাকেন ঃ মুমিন বান্দাহ যে কোন ভালো কাজ করলে আত্মতৃপ্তিতে ভোগেনা বরং তারা নিজের নফসকে সৎকাজের আত্মতৃপ্তি থেকে রক্ষা করতে সর্বদা নিজেকে তিরস্কাক করে। তারা বলেন নফস চাইলে আরো ভালো কাজ করা যেত। যা হয়েছে বেশিহলেও অল্প। হযরত হাসান বসরী (রাঃ) বলেন- আল্লাহর কসম মুমিনতো সর্বদা নিজেকে ধিক্কার দেয়। সৎকর্ম সমূহকে আল্লাহ তায়লার আজমত বা বড়ত্বের মোকাবেলার খুব কম মনে করে। কেননা আল্লাহের হক পুরোপুরি আদায় করা সাধ্যতীত ব্যাপার।
অন্তরের উদাসীন ব্যক্তিরা পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত ঃ অন্তরের দিক থেকে যারা উদাসীন আল্লাহ তাদের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে সীল মোহর মেরে দিয়েছেন। ফলে তারা ইহকালে চরম ক্ষতিগ্রস্ত। আল্লাহ তায়ালা বলেন- এটা এজন্য যে, তারা পার্থিব জীবনকে পরকালের চাইতে প্রিয় মনে করেছে। এবং আল্লাহ অবিশ্বাসীদের পথ প্রদর্শন করেন না। এরাই তারা আল্লাহ এদের অন্তর, কর্ণ ও চক্ষুর উপর মোহর মেরে দিয়েছেন এবং এরাই কান্ডজ্ঞানহীন। [সূরা হিজর, ১০৭-১০৮]
উদাসীনতা থেকে বাচাঁর জন্য দোয়া ঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, আদম সন্তানের অন্তর সমূহ মাত্র একটি অন্তরের ন্যায় আল্লাহ তায়ালার দুটি আঙ্গুলের মধ্যে অবস্থিত। তিনি যেইভাবে ইচ্ছা করেন তাকে ঘুরাইয়া থাকেন। অতঃপর নবিজী দোয়া করলেন- হে অন্তর সমূহের আবর্তনকারী মা’বুদ আমাদের অন্তর সমূহকে তোমার বন্দেগী ও আনুগত্যের দিকে আর্বতীত করে দাও। ( সহীহ মুসলিম)। হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, হে আল্লাহ আমার মনে তাকাওয়া দান করুন। তাকে পবিত্র করুন। আপনিই মনের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক। মনের নিয়ন্ত্রকও অভিভাবক। হে আল্লাহ, আমি আপনার আশ্রয় চাই এমন জ্ঞান থেকে যা উপকারী নয়। এমন হৃদয় থেকে যে বিনম্র হয়না। এমন মন থেকে যা তৃপ্ত হয়না। এমন প্রার্থনা থেকে যা গ্রাহ্য হয়না।[সহীহ মুসলিম]
হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) বর্ণনা করেন, অন্তরের দৃঢ়তার জন্য রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বেশি বেশি করে এই দোয়া পড়তেন। “ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুবি সাব্বিত কালবি আলা দ্বীনিকা”। অর্থ, হে মনের গতি পরিবর্তনকারী, আমার মনকে আপনার দ্বীনের উপর স্থির করুন। (তিরমিযী-৩৫২২)
লেখক : সহকারী শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা), চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ