বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মুহাম্মদ আবদুল কাহহার
গত ৭ আগস্ট গ্যাসের দাম বাড়াতে সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি শুরু হয়েছে। তুমুল হইচই, বাকবিত-া ও হট্টগোলের মধ্য দিয়েই গণশুনানি চলছে। আগামী ১৮ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) এ শুনানি চলবে। শুনানির প্রথম দিনে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি এবং ১০ আগস্ট পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির প্রস্তাবের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর ১১ তারিখ বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি., ১৪ আগস্ট কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি., ১৬ আগস্ট জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লি., ১৭ আগস্ট সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি এবং ১৮ তারিখ গ্যাসের বাল্ক মূল্যহার নিয়ে পেট্রোবাংলা, বিজিএফসিএল, এসজিএফএল ও বাপেক্সের আবদেনের ওপর শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। গণশুনানি কী প্রভাব ফেলবে কতটা গুরুত্ব পাবে তা বলা যায় না। ৬টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি গড়ে ৮৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করছে। বছর না ঘুরতে আবারও দাম বৃদ্ধি খুবই দুঃখজনক। গত বছরের ১ সেপ্টেম্বরে গ্যাসের দাম গড়ে ২৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। বিইআরসি আইন-২০০৩ অনুযায়ী এক বছরের মধ্যে দুইবার দাম বাড়ানোর নিয়ম না থাকলেও ৮ মাসের মাথায় আবারও দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করছে কোম্পানিগুলো এটা দেখভাল করার কি কেউ নেই সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি তিতাসের প্রস্তাব পর্যালোচনা করে তাদের প্রতিবেদনে জানায়, তিতাস লাভ করছে। আগামী অর্থবছর কোম্পানি পরিচালনা করতে কোনো বাড়তি অর্থের প্রয়োজন নেই; বরং ২০১৬-১৭ অর্থবছর খরচ বাদ দিয়ে তাদের ৩৫৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বাড়তি থাকবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, তিতাসের প্রতি ঘনমিটার গ্যাস পরিচালনায় খরচ ২১ পয়সা করে। কিন্তু এখন গ্রাহকের কাছ থেকে নিচ্ছে ৬২ পয়সা। প্রতি ঘনমিটারে ২৩ পয়সা করে লাভ হচ্ছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক খবরে বলা হয়েছে, ভারতে গ্যাসের দাম কয়েক দফা কমলেও বাংলাদেশে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগারো মাসের মাথায় ফের গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া কোনো শুভ লক্ষণ নয়।
গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে শিল্প বিনিয়োগ মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন হবে। শিল্প মালিকরা কোন মতে তাদের ব্যবসাকে টিকিয়ে রেখেছেন, ঠিক এই মুহূর্তে আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো যদি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় তাহলে সেই মুহূর্তে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। শ্রমিক ও কর্মচারীর বৃহৎ একটি অংশ বেকার হয়ে যেতে পারে। যার ফলে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা। শুধু শিল্প বাণিজ্যই নয়, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পরিবহন ও নিত্যপণ্যের বাজারে বিরাজমান নৈরাজ্য স্থায়ীভাবে আইনি বৈধতা পাবে। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে অনেক টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে যাবে। কর্মসংস্থান হারাবে অনেক শ্রমিক। একই সঙ্গে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে পণ্যের দামও বাড়বে। কার স্বার্থে আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় কোম্পানি বা সরকার নাকি জনগণ?
জনগণ কি রাষ্ট্রীয় সব সুবিধা ভোগ করতে পারছেন নাকি জুলুমের জাতাকলে পিষে যাচ্ছেন সে খবর হয়তো কেউ রাখেন না। বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবগুলো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলেই মনে হয়। এটি শিল্পের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র কিনা সেটিও অনুসন্ধান করা উচিত। তাছাড়া গৃহস্থালি খাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কোনো যুক্তি তিতাস গ্যাসের কাছে নেই। গণশুনানিতে অংশ নেয়া সাধরণ মানুষেরা বলেছেন, ‘বর্তমানে ২৩ লাখ গৃহস্থালি গ্রাহক মাসে যে পরিমাণ গ্যাস খরচ করছে, তার চেয়ে বেশি দাম দিচ্ছে। তারপরও আবার গ্যাসের দাম বাড়ানো এক ধরনের প্রতারণা’। গ্যাসের মূল্য আবাসিক এলাকায় দুই চুলার জন্য মাসিক বিল ১ হাজার ২০০ টাকা, এক চুলার জন্য এক হাজার টাকা এবং যানবাহনে ব্যবহৃত সিএনজির দাম ৬৬ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া বাণিজ্যিক, শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দামও ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। এর আগে গত বছরের এক সেপ্টেম্বর দুই চুলার বিল ৪৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা এবং এক চুলার বিল ৪০০ থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করা হয়। সিএনজি গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিট ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করা হয়। মূল্য বৃদ্ধির আগে সাধারণ মানুষের কথা ভেবে দেখা উচিত।
গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি প্রস্তাবের প্রতিবাদে বিভিন্ন বেসরকারি সামাজিক ও ব্যবসায়ী সংগঠন এবং নাগরিক প্রতিনিধিরা নানা কর্মসূচি পালন করেছে। সেই সাথে বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং অ্যান্ড কনভারশন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে সিএনজি স্টেশন বন্ধ করে দেয়া হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমাদের দেশে অনিয়ম যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। সর্বমহল যখন আপত্তি তুলছে তখন এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে।
একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, বিভিন্ন এলাকায় মেস ও গণপরিবারভুক্ত বাড়ি বা বস্তি এলাকায় অধিকহারে গ্যাসের অপচয় হয়। অপ্রয়োজনে গ্যাসের চুলা জালিয়ে রাখা হয়। এতে করে প্রচুর গ্যাস অপচয় হয়। প্রায় এলাকাতেই অসংখ্য অবৈধ গ্যাসের লাইন রয়েছে। যার বিল সরকারের তহবিলে জমা হয় না। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলের অসৎ নেতাদের যোগসাজশে এসব টাকা ভাগবাটোয়ারা করা হয়। রাষ্ট্র তার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। তাই যেসব কর্তাব্যক্তি গ্যাস সংযোগের সাথে জড়িত তাদের একটি শ্রেণি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে থাকে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে ক্রমশ তাদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাবে। অবৈধ সংযোগ বাড়তেই থাকবে। যে কোন মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে যে বড় কোনো দুর্ঘটনা। অবৈধ সংযোগগুলো বন্ধ করে দেয়া হলে অসংখ্য ফ্ল্যাট বাড়িতে গ্যাস সংযোগ দেয়া যাবে। আবাসিক এলাকায় নতুন করে গ্যাস সংযোগ বন্ধের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে তা বাতিল করে নতুন সংযোগ দিতে হবে। আর গ্যাসের অপচয় রোধ করতে দেশের সর্বত্র প্রতিটি গ্যাস সংযোগে মিটার বসানো হলে গ্যাসের অপচয় কমে আসবে।
সর্বোপরি বলতে চাই, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হচ্ছে তা বাতিল করতে হবে। যারা মাসিক ভিত্তিতে ৬০০ বা ৬৫০ টাকার বিনিময়ে পর্যাপ্ত গ্যাসের সুবিধা ভোগ করেন তাদের দ্বারা গ্যাসের অপচয় হয়। যথাযথভাবে গ্যাস ব্যবহারের বিষয়ে উদাসীন থাকেন। তাই সবার জন্য বলছি, আমরা যারা গ্যাসের সুবিধা ভোগ করছি, আমরা কি পারি না দেশের সম্পদ রক্ষায় এগিয়ে আসতে। গ্যাসের নির্ধারিত চার্জ দেই বলে গ্যাসের অপচয় করবো তা ঠিক নয়। মিতব্যয়ী হতে শিখবো। গ্যাস অপচয় করবো না। আল্লাহর দেয়া এই সম্পদের আমানতদার হিসেবে নিজেকে বিবেচনায় রাখবো। যারা গ্যাস চুরি করছে তাদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করবো, প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করবো। এর মাধ্যমে নিজেরা লাভবান হবো। একই সাথে দেশের মানুষ উপকৃত হবে। ইনশাআল্লাহ।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট
সধনফঁষশধযযধৎ@মসধরষ.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।