Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, ২৫ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বালিকান্দি ঐতিয্যবাহি জামে মসজিদের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ : নতুন কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে না

মৌলভীবাজার জেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৪ অক্টোবর, ২০২০, ৩:৩৩ পিএম

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনিঘাট ইউনিয়নের বালিকান্দি গ্রামের ঐতিয্যবাহী বালিকান্দি জামে মসজিদ পরিচালনা নিয়ে তিন বছর ধরে টানাপোড়ান চলছে। নতুন কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর না করা ও আয়-ব্যায় হিসাবের স্বচ্ছতা না থাকার অভিযোগ উঠেছে। এনিয়ে জেলা প্রশাসক ও ওয়াক্ফ প্রশাসকের বরাবরে অভিযোগ দিয়েছেন বালিকান্দি জামে মসজিদের মোতাওয়াল্লী সৈয়দ জহির উদ্দিন।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, মসজিদের মোতাওয়াল্লীকে বাদ দিয়ে ২০১৫ সালের ২ নভেম্বর তারিখে একটি কমিটি অনুমোদন লাভ করে। এরপর ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ আরেকটি পত্রের মাধ্যমে মোতাওয়াল্লীকে বর্ণিত কমিটির সাথে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু কমিটির সদস্যরা দুর্নীতে জড়িয়ে গেছেন এমন অভিযোগ তুলে ৫জন সদস্য পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারী ২৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি পুরাতন ও নতুন সদস্যদের সমন্ধয়ে নতুন কমিটি অনুমোদন দেয় ওয়াক্ফ প্রশাসন। পরে গত ২২ সেপ্টেম্বর পুরাতন কমিটি নবগঠিত কমিটির নিকট দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। কিন্তু পুরাতন কমিটির কয়েকজন সদস্য নতুন কমিটিকে মসজিদ পরিচালনায় বিভিন্নভাবে কার্যক্রম পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করেন।
সরেজমিনে বালিকান্দি গ্রামে গেলে জানা যায়, মসজিদ নিয়ে দীর্ঘ কয়েকবছর ধরে গ্রামের মধ্যে উত্তপ্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। মসজিদের যুগ্ম মোতাওয়াল্লী ফজলুল করিম রেজা জানান, মসজিদের নামে ব্যাংকে একটা একাউন্ট ছিল যেটাতে মোতাওয়াল্লী/সভাপতি/সেক্রেটারীর মধ্যে যেকোন দুইজনের স্বাক্ষরে লেনদেন গৃহীত হতো। কিন্তু পরবর্তীতে কিছু সদস্যের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ব্যাংক একাউন্ট থেকে মোতাওয়াল্লী ও সভাপতির ক্ষমতা বাদ দেয়া হয়। এরপর মসজিদের যাবতীয় হিসেবে অনিয়ম শুরু হয়।
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ২লক্ষ ৯৯ হাজার ৭৭৮ টাকা ব্যাংকে জমা ছিল। মোতাওয়াল্লী ও কমিটির সদস্যদের বাদ দিয়ে কমিটির সদস্যরা ভবিষৎতে দুর্নীতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে এমন আশংখ্যা দেখা দেয়। এ কারণে কমিটির কার্যক্রম স্থগিতাদেশ চেয়ে মোতাওয়াল্লী বাদী হয়ে গত ২২/০২/২০১৭ সালে (মামলা নং-১২/২০১৭) মৌলভীবাজার সহকারি জেলা জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি বিজ্ঞ আদালতে দু’তরফা শুনানি শেষে ১৫/০৩/২০১৭ তারিখে মসজিদের মোতাওয়াল্লীর পক্ষে রায় চলে আসে। পরে উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে বিবাদী আপিল করেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে মসজিদের মোতাওয়াল্লী ও সভাপতিকে না জানিয়ে ২৮/০১/২০১৭ আইন অমান্য করে রাতের আধারে মসজিদ ভাঙ্গা হয়।
তিনি আরো বলেন, সাবেক কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার প্রায় দুই বছর পেরিয়ে যাওয়ায়, পুরাতন-নতুন সমন্নয়ে একটি কমিটি ওয়াক্ফ প্রশাসন অনুমোদন দেন। এতে গ্রামের কিছু সংখ্যক লোক নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য বিভিন্ন গুজব দিয়ে গ্রামে গোলাটে পরিবেশ তৈরী করে। পরে ইউএনও ও ওসির উপস্থিতিতে বিট পুলিশিং সভা বসে। সভায় নতুন কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরসহ কিছু সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সভার কোন সিদ্ধান্ত পুরাতন কমিটি মানছেন না।
ওয়াক্ফ প্রশাসনে তাদের দাখিল করা উন্নয়ন হিসাবে অন্তত ১৫ লক্ষাধিক টাকার গরমিল রয়েছে। মূলত আর্থিক হিসাব না দিতে পারার করণে পুরাতন কমিটি এই পায়াতারা করছে। ওয়াক্ফ প্রশাসন দফায় দফায় উন্নয়ন হিসাব চেয়েছে, কিন্তু কোন ব্যাংক স্টেইটমেন্টসহ হিসাবের স্বচ্ছতা দেখাতে পারেনি পুরাতন কমিটি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মোঃ শওকত বলেন, যখন পুরাতন মসজিদ ভেঙে নতুন মসজিদ নির্মাণ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়, তখন দাতা পক্ষ মোতাওয়াল্লীকে না জানিয়ে মসজিদ ভাঙা হয়। গ্রামের কিছু সংখ্যক মুসল্লিকে নিয়ে মসজিদের উন্নয়ন কাজ শুরু করেন।
তিনি আরো বলেন, পরবর্তীতে জানুয়ারী মাসে নতুন কমিটি ওয়াক্ফ প্রশাসক অনুমোদন দেয়। এতে তাদের কিছু আপত্তি রয়েছে। পুরাতন কমিটির উপর মামলা থাকায় নতুন কমিটির কাছে হস্তান্তর করতে পারছে না বলে জানান।
মসজিদের আয় ব্যয়ের বিষয়ে বালিকান্দি জামে মসজিদ কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক এর কাছে জানতে চাইলে সঠিক হিসাব উল্লেখ করতে পারেননি। মৌখিক ভাবে বলেন আর্থিক লেনদেনর মধ্যে আমাদের কাছে সব হিসাব আছে, সকল আয়-ব্যয় তা রশিদের মাধ্যমে হয়েছে।
আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে মসজিদের সাবেক কোষাধক্ষের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। তবে স্থানীয় ইউপি সদস্য মোঃ শওকত জানান, মসজিদের যা আর্থিক লেনদেন আছে তা কোষাধ্যক্ষের মাধ্যমে রশীদ দিয়ে আদায় করা হচ্ছে। ব্যাংক একাউন্ট না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, যেহেতু ব্যাংক একাউন্ট পরিচালনার জন্য মোতাওয়াল্লী প্রয়োজন। মোতাওয়াল্লীর আপত্তি থাকায় ব্যাংক একাউন্ট ব্যাংক একাউন্টে লেনদেন করা যাচ্ছেনা। কোষাধ্যক্ষের মাধ্যমে যাবতীয় লেনদেন জুম্মাবারে মসজিদে জানানো হচ্ছে।
গ্রামের বাসিন্ধা সৈয়দ মুজাহিদ আলী বলেন, সাবেক কমিটির কোষাধক্ষ্যই সব হর্তাকর্থা। হিসাবে দেখলাম উনার দোকান থেকে মসজিদের মালামাল কিনা হয়েছে। কোষাধাক্ষ কমিটির সাথে কোন যোগাযোগ না করে একক ভাবে ক্ষমতা খাটিয়ে আয়-ব্যয় করেছেন।
মসজিদের মোতাওয়াল্লি সৈয়দ জহির উদ্দিন বলেন, মসজিদের সাবেক কোষাধ্যক্ষ অলিউর রহমান কোন ব্যাংকে লেনদেন করেননি, নিজের ইচ্ছেমতো অসংখ্য রসিদ বই ছাপিয়ে লন্ডনে বসে কোটি কোটি টাকা আদায় করেছেন। যা আমি কিংবা আমার সাবেক সভাপতির জানা নেই। মসজিদের উন্নয়ন কাজে আমরা কখনো বাধা দেই নাই, বরং কিছু সদস্যের অনিয়মের কারণে কমিটির কার্যক্রম স্থগীতাদেশ চেয়েছি। আমি অনুমোদনের জন্য কমিটি পাঠিয়েছি, অথচ দুর্নীতিপরায়ন সদস্যরাই চক্রান্ত করে গোপনে মোতাওয়াল্লির নাম কর্তন করে কমিটি নিয়ে আসে। সেই কমিটিতে একই পরিবারের ৫ জন ছিল। মূলত আমার প্রস্তাবিত কমিটি পাঠানোর তিন মাস আগে, ২৬ সদস্য বিশিষ্ট আরেকটি কমিটি অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছিল। সেই কমিটি অনুমোদন না হওয়ার রেশ ধরেই কিছু সংখ্যক লোক অনিয়ম ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে নতুন কমিটির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এবিষয়ে ওয়াক্ফ প্রশাসনের জেলা পরিদর্শক মোঃ নাছির উল্ল্যাহ বলেন, গত ১৪/০১/২০২০ তারিখ ২৩ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কমিটি ওয়াক্ফ প্রশাসন অনুমোদন দিয়েছে। যেহেতু পূর্বের কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে তাই নতুন কমিটিই পরিচালনা করবে। আর্থিক হিসাবের মধ্যে মসজিদের নিয়মিত আয়-ব্যয়ের হিসাবে কোন সমস্যা নাই। তবে উন্নয়নমূলক হিসাবের স্বচ্ছতা নিয়ে অভিযোগ আছে। এব্যাপারে এখনও কোন তদন্ত হয়নি, ওয়াক্ফ প্রশাসন ঢাকায় বিষয়টি বিবেচনাধীন আছে।
এ বিষয়ে মসজিদ কমিটির বর্তমান সভাপতি ও গ্রামের পাঞ্চায়তের মুরব্বি হাফিজ জালাল উদ্দিন জানান, মসজিদ নিয়ে গ্রামে ২টি পক্ষ হয়ে গেছে। এটি কোন ভাবেই কাম্য নহে। মসজিদ আল্লাহর ঘর, মসজিদের মুসল্লি হিসেবে যারাই মসজিদে আসবেন সবাই সমান, অন্য কিছু ভাবা ঠিক হবেনা। আমি শুধু ইসলামের খেদমতের কাজ করছি ও বিষয়টি মিমাংসার জন্য গ্রামের মুসল্লিদের নিয়ে চেষ্ঠা করছি। তিনি একজন হার্টের রোগী উল্লেখ হরে বলেন, তাঁর শারিরিক অবস্থা খুব একটা ভালনা। তার পরও মসজিদ পরিচালনা করে যাচ্ছেন, বিরোধ মিমাংসা হয়ে গেলে মুসল্লিদের মতামতের ভিত্তিতে অন্য একজনকে দায়িত্ব দিয়ে তিনি অব্যাহতি নিবেন। মসজিদের আয়-ব্যয়ের বিষয়ে তাঁর কোন জানা নেই। তাকে আয়-ব্যয়ের হিসাবে স্বাক্ষরের কথা জানালে, আয়-ব্যয় জানা না থাকায় তিনি স্বাক্ষর করেননি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ