দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
পূর্ব প্রকাশিতের পর
এ পর্যায়ে আমার মনে একটা প্রশ্ন বার বার উঁকি দিচ্ছে, যার সমাধান না টেনে আমি এগুতে পারছি না। প্রশ্নটা হচ্ছে, হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম কি সত্যিই নবী-রাসুলগণের শিক্ষক? এক কথায় এর উত্তর হলো না। পবিত্র কুরআনুল কারীমের তথ্য আমাদের তাই বলে। অর্থাৎ হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম, যখন আপন স্রষ্টার সন্ধানে উর্দ্ধ জগতের বড় বড় সৃষ্টি সমূহকে স্রষ্টা হিসেবে নির্ধারণ করে চলেছেন তখন হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের ভূমিকা কি ছিল? আমি ফেরেশতাদের সর্দার হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম এর প্রতি পূর্ণ ভক্তি ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে, জানাতে চাই, মহান আল্লাহ্পাকের নির্দেশ ব্যতীত হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম এক চুলও নড়ার ক্ষমতা রাখেন না। সংগত কারণে তিঁনি সম্মানিত কোন নবী-রাসুলগণের শিক্ষক হতে পারেন না। বরং হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে সম্মানিত প্রত্যেক নবী-রাসুলগণ সম্মানিত সকল ফেরেশতাগণের শিক্ষক এ ব্যাপারে কুরআন-হাদিসের পর্যাপ্ত দলিল আমার হাতে রয়েছে। যেমন- হযরত আদম আলাইহিস সালাম শিক্ষক হিসেবে যেই জ্ঞান ফেরেশতাদের বিতরণ করেছেন জান্নাতে বসে, সেই জ্ঞান শুধু ফেরেশতারা নয় তাঁদের শিক্ষক আজাজিলের কাছেও ছিলো না! যাই হোক, ফিরে আসি হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এর ঐতিহাসিক উক্তি প্রসংগে।
হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম একটি বিষয়ে স্পষ্ট ছিলেন, দুনিয়ার জমিনের কোন বড় সৃষ্টি যেমন হিমালয় পাহাড়, প্রশান্ত মহাসাগর অথবা হাজার বছরের পুরোনো বৃক্ষ ইত্যাদি ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থানকারী যত প্রকার সৃষ্টি আছে তারা কেউ স্রষ্টা হতে পারে না। স্রষ্টার অবস্থান অবশ্যই উর্দ্ধ জগতে। তাই শুরুতেই তিঁনি উর্দ্ধ জগতের বড় বড় সৃষ্টি সমূহকে স্রষ্টা হিসেবে নির্ধারণ করেন কিন্তু তাঁর অনুসন্ধানি তৎপরতায় যখন কোন সৃষ্টিই স্রষ্টা হিসেবে বিবেচিত হয় না, তখন তিঁনি যেই ঐতিহাসিক উক্তিটি করেন তা যেমন জান্নাতিদের জন্য আনন্দের বিষয় তেমন জাহান্নামিদের জন্য অনুতাপের বিষয়। প্রশ্ন আসতে পারে কীভাবে? প্রথমত আমরা যদি চিন্তা করি হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের ঐতিহাসিক উক্তির মধ্যে কি উল্লেখ রয়েছে? তাহলে আমরা দেখতে পাবো সেখানে “আল্লাহ্” বা “রব” নামে কোন শব্দের উল্লেখ নেই। প্রশ্ন আসতে পারে কেন? এর সহজ উত্তর হচ্ছে তখনও তিনি “আল্লাহ্” বা “রবকে” আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি। তাই তিনি কৌশল অবলম্বন করে, বলেছিলেন, আমি তাঁর প্রতি নিজেকে সমর্পণ করছি, যাঁর প্রতি জমিন আসমানের সমস্ত সৃষ্টি পূর্ব থেকেই সমর্পিত আছে এবং আমি স্রষ্টা হিসেবে একজনকে স্বীকার করে নিয়ে ঘোষণা করছি, আমি কোন মুশরিকদের দলভুক্ত নই। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের এই উক্তিটি মহান আল্লাহপাকের কাছে এতটাই গ্রহনীয় হয়েছিলো যে, তিনি পবিত্র কুরআনুল কারীমে তা হুবহু উল্লেখ করেন। আর আমাদের মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য “রহমত” স্বরূপ, তাই তিনিও এই সুযোগটি শতভাগ কাজে লাগিয়ে দেন। অর্থাৎ তিনি ঘোষণা করেন, আমি নতুন কোন দ্বিন বা ধর্ম নিয়ে আসিনি, বরং ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম- এর ধর্মই আমার ধর্ম। এই ঘোষণা করার মাধ্যমে মহানবী হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেন। মেরাজের ঐতিহাসিক ঘটনার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম সপ্তম আসমানে অবস্থান করছেন। দুনিয়ার যে সকল শিশু না বালক অবস্থায় ইন্তেকাল করে, তাঁর পরিচয় যাই হোক অর্থাৎ মুসলিম হউক অথবা অমুসলিমের সন্তান হউক তাদের প্রত্যেকের দেখা শোনা এবং তা’লিম তরবিয়ত স্বয়ং ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম নিজে করেন। সুবহানল্লাহ। এতিম শিশুদের প্রতি ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের এই মহানুভবতা আমাদের এতিম মহানবীকে দারুন ভাবে উজ্জ্বিবিত করে, তাইতো মহানবী ঘোষণা করেন, যে ব্যক্তি একজন এতিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে সে ততপরিমাণ নেকির অধিকারী হবে যত সংখ্যক চুল তার হাত স্পর্শ করেছে!! মহানবীর উপাধি হাবিবুল্লাহ্ আর ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের উপাধি খলিলুল্লাহ্। এছাড়া হযরত মুসা আলাইহিস সালামের উপাধি কালিমুল্লাহ্। হাবিবুল্লাহ্ আর খালিলুল্লাহ এই দুইটি উপাধির একটি অর্থ আর তা হচ্ছে আল্লাহ্র বন্ধু। কিন্তু বন্ধুত্বের বিবেচনায় হাবিবুল্লাহ্ আর খালিলুল্লাহ্র ব্যবধান আকাশ-পাতাল, শুধু আকাশ-পাতাল বললে ভূল হবে, বরং আরো বহু যোজন-যোজন ব্যবধান। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম জন্ম থেকে নিয়ে ইন্তেকাল পর্যন্ত বহু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খালিলুল্লাহ্ উপাধি লাভ করে সপ্তম আসমান পর্যন্ত নিজেকে উন্নিত করেছেন আর মহানবী দুনিয়াতে আসার বহু আগে থেকেই উর্দ্ধ জগতে আহ্মদ নামে পরিচিত ছিলেন। মেরাজের ঘটনা এমন একটি ঘটনা যা শুধুমাত্র মহানবীর ক্ষেত্রে ঘটেছে!! প্রশ্ন হলো কেন? এর এক কথায় উত্তর দেওয়ার সুযোগ নেই। সংক্ষেপে বলছি, মহানবী হলেন, মহান আল্লাহ্পাকের প্রথম সৃষ্টি, কত কোটি বছর পূর্বে মহান আল্লাহ্পাক মহানবীর নুরকে সৃষ্টি করেছেন তার সুনিদৃষ্ট হিসেব একমাত্র মহান আল্লাহ্পাকের এলমেই সংরক্ষিত। মহানবী হচ্ছেন মহান আল্লাহ্পাকের দীর্ঘ সময়ের সাথি। মাত্র উনপঞ্চাশ বছর মহানবী আল্লাহ্পাকের নিজস্ব পরিমন্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পরে মহান আল্লাহ্পাক তাঁর যাবতীয় নিয়ম-কানুনকে পাশ কাটিয়ে দুনিয়ার মানুষকে অন্ধকারে রেখে তাঁর হাবীবকে তাঁর সম্মুখে দাঁড় করিয়ে তাঁর কুদরতি চোখে মহানবীকে অবলোকন করেন এবং দীর্ঘ সাক্ষাৎ শেষে মহানবীকে যথা স্থানে পৌঁছে দেন। মহান আল্লাহ্পাক এই ঘটনাটিকে অতি আশ্চর্য জনক ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন!!! প্রশ্ন হলো কেন? এর উত্তর হলো হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত সকল নবী-রাসুলগণই আল্লাহ্পাকের সাক্ষাৎ চেয়েছেন কিন্তু আল্লাহ্পাক সম্মানিত সকল নবী-রাসুলগণের ইচ্ছাকে নাকচ করে দেন!!!
এ বিষয়কে পবিত্র কুরআনুল কারীমে হযরত মুসা আলাইহিস সালামের কথা স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ রয়েছে। হযরত মুসা আলাইহিস সালাম তুর পর্বতে মহান আল্লাহ্পাকের সাথে সরাসরি কথা বলতেন, এ জন্য তাঁর উপাধি কালিমুল্লাহ্। দীর্ঘ দিন যাবৎ আল্লাহ্পাকের সাথে কথা বলার ফলে, তাঁর মনে আল্লাহ্পাককে দেখার ইচ্ছা জাগ্রত হয়। তিনি বলেন, “ইন্নি আরণি” অর্থাৎ আমি আপনাকে দেখতে চাই। মহান আল্লাহ্পাক বলেন, “লান্তারানি” তুমি আমাকে কখনই দেখতে পারবে না। অথচ আল্লাহ্র হাবীব তাঁর উনপঞ্চাশ বছর হায়াতি জিন্দেগিতে একবারও বলেন নি, ‘ইন্নি আরনি’ তবুও আল্লাহ্পাক তাঁকে, তাঁর কাছে নিয়ে গিয়ে মহানবীকে বিরল সম্মানে ভূষিত করেন। প্রশ্ন আসতে পারে মহানবী কেন একবারও মহান আল্লাহ্পাকের সাক্ষাতের ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন না? এক কথায় উত্তর, মহানবী সৃষ্টির শুরু থেকে নিয়ে আজ অবধি এক মূহূর্তের জন্য মহান আল্লাহ্পাকের সাক্ষাৎ থেকে বিছিন্ন হননি এবং ভবিষ্যতেও হবেন না। তাই তিঁনি যদি মহান আল্লাহ্পাকের সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা ব্যক্ত করতেন, তাহলে তা সত্যের বিপরীত হতো, যা হওয়া অসম্ভব। অত:পর হযরত মুসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলতে চাই, তিঁনি যেহেতু মহান আল্লাহ্পাকের সাথে সরাসরি কথোপকোথনের সুযোগ পেয়েছেন! তাই তাঁর মর্যাদা হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের পরেই নির্ধারিত। মহান আল্লাহ্পাক তাঁকে ষষ্ঠ আসমানে স্থান দান করেছেন। উম্মতে মোহাম্মাদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লামের জন্য নির্ধারিত পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নির্ধারণের ক্ষেত্রে হযরত মুসা আলাইহিস সালামের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। উম্মতে মোহাম্মাদীকে সালাম দেওয়ার ক্ষেত্রে মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের অবদান, আমাদেরকে করেছে অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। আমরা যদি একটু চিন্তা করি, তাহলে সহজেই বুঝতে পারবো যে, হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম জান্নাতি পরিবেশে থেকে সুনির্দৃষ্টভাবে শুধুমাত্র উম্মতে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামকে সালাম দিয়েছেন! তাঁর সালাম মহানবীর সকল উম্মতের জন্য আম অর্থাৎ গুনাহ্গার হোকা আর নেককার হোক প্রত্যেকটি উম্মত হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের দোয়ার হকদার। আমার লেখা এই পর্যন্ত যারা পড়েছেন বা শুনেছেন তারা অবশ্যই বলুন ওয়া লাইকুমুস সালাম ওয়া রাহ্মাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। আমার বিশ্বাস হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এর সালাম যার উপর বর্ষিত হয়েছে সে যদি যথাযথ ভক্তি, শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তার উত্তর দেয়, তাহলে নমরুদের আগুন থেকে মহান আল্লাহ্পাক যেভাবে হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে হেফাজত করেছেন, সেভাবে জাহান্নামের আগুন থেকে মহান আল্লাহ্পাক তাঁকেও হেফাজত করবেন। আমিন। পরিশেষে রবের সাথে কৃত ওয়াদার বিষয়ে বলতে চাই, রবের সাথে কৃত ওয়াদা কেন ভূলে গেলাম? এক কথায় উত্তর রবের ইচ্ছায়। প্রশ্ন আসতে পারে রব কেন ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাদের ভূলিয়ে দিলেন উত্তরে বলবো, মহানবীর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য বা গোলামি নিশ্চিত করার জন্য। (চলবে)
লেখক : গবেষক ইসলামী চিন্তাবিদ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।