বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
আহমেদ জামিল
নানা প্রতিকূলতা ও সংশয় অতিক্রম করে কাউন্সিলের ৪ মাস ১৮ দিন পর দেশের মূল ধারার রাজনীতির অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি অবশেষে পূর্ণ কমিটি গঠনে সক্ষম হলো। এটি ৫০২ সদস্যের কমিটি। গত ৬ আগস্ট বিএনপির কমিটি গঠনের পর আওয়ামী ঘরানার বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নেতিবাচক ও নিরাশাব্যাঞ্জক রিপোর্ট ও প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। কমিটি গঠনের ঘোষণার পর কারো কারো মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ বিরাজকরণের পরও মূল সংগঠনসহ সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্য। এ কথাও সত্য যে বিএনপির মতো বড় দলের কমিটি গঠন নিয়ে পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশিত পদ না পাওয়াদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
বিএনপির নতুন কমিটি নিয়ে গত ৮ আগস্ট দৈনিক ইনকিলাবে ‘নেতৃত্ব বিকাশে সকল পেশার গুরুত্ব’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি দৃষ্টি কেড়েছে অনেকের। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, “পাহাড়সম বাধা ডিঙ্গিয়ে ৪ মাস ১৮ দিন পর বিএনপির ঘোষিত কমিটি নিয়ে নানামুখী বিচার-বিশ্লেষণ হচ্ছে। এ বিশ্লেষণ দলের গ-ি পেরিয়ে বিরাজ করছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিএনপির জন্য এখন সবচেয়ে প্রতিকূল পরিবেশ। বিপর্যস্ত এই দলটি তাদের কমিটি দিতে পেরেছে এটিই বড় সফলতা। নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য বিএনপির যে ভিশন সেটির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কমিটিতে।” কোনো কোনো মিডিয়া এই কমিটিকে তারুণ্যনির্ভরও বলেছে। কমিটিতে নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা বৃদ্ধিকে বিএনপির রাজনীতির একটা গুণগত পরিবর্তন হিসেবে দেখা হচ্ছে। উপদেষ্টা কমিটিতে দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপক হারে অন্তর্ভুক্তিকরণকে ইতিবাচক বলতে হবে।
কমিটি গঠন করা এই মুহূর্তে কোণঠাসা বিএনপির রাজনৈতিক সাফল্য এবং সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের বড় অংশের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসাকে ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখা হলেও আসন্ন দিনগুলোতে বিএনপিকে সম্মুখীন হতে হবে নানা চ্যালেঞ্জের। নতুন কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে দলের নেতাদের কারো কারো মধ্যে সৃষ্টি হওয়া অসন্তোষ-ক্ষোভ প্রশমিত করা এবং দলের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখাটা হবে বিএনপি হাইকমান্ডের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। এ কথাও সত্য যে, নতুন কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান পাননি বিএনপির অনেক ত্যাগী ও সক্রিয় নেতা। অপমানিত ও ক্ষুব্ধ এসব নেতার কেউ কেউ দল ত্যাগ এবং দলের মধ্যে নিষ্ক্রিয় হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। কোনো কোনো মিডিয়া খবর দিয়েছে ভাইস চেয়ারম্যানের পদ ছাড়ছেন বিএনপির অন্যতম প্রবীণ ও ত্যাগী নেতা হিসেবে পরিচিত আবদুল্লাহ আল নোমান। আরো ২৪ জন গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিএনপি ত্যাগের কথাও বলা হচ্ছে। এ ধরনের প্রবণতা বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এর নেতিবাচক প্রভাব তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। দলের চাইতে এদের আনুগত্য ওইসব নেতাকে ঘিরে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সেই বাণী চিরন্তনী “ব্যক্তির চেয়ে দল বড় এবং দলের চেয়ে দেশ বড়” বিএনপির কত শতাংশ নেতাকর্মী তা অনুসরণ করেন সে প্রশ্ন রাজনৈতিক সচেতন অনেকের মনে। তাই বিএনপিকে আগামী দিনগুলোতে রাজনৈতিক কর্মসূচি ও কৌশল বাস্তবায়ন করতে হলে যে কোনো মূল্যে দল ত্যাগ, দলের ভাঙন এবং নেতাকর্মীদের নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার প্রবণতা ঠেকাতে হবে। দলের ঐক্য ও সংহতি ধরে রাখতে হবে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শে দলকে পুনর্গঠিত করতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি ও কৌশল নির্ধারণে বিএনপিকে রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিচয় দিতে হবে।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিলেন তাতে তার দেশাত্মবোধ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশ পেলেও এতে রাজনৈতিক পরিপক্বতা কতটা আছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এক্ষেত্রে জনপ্রিয় একটি দল হিসেবে বিএনপির জঙ্গিবাদীদের দ্বারা কারা কারা ফায়দা লুটতে এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করে বাংলাদেশে দখলদারিত্ব কায়েম করতে চায় সে সম্পর্কে দলটির নেতৃত্বের অবস্থান ও বক্তব্য স্পষ্ট করা উচিত। বিএনপির জঙ্গিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের ডাক শুরুতেই ব্যর্থ হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাৎক্ষণিকভাবে বিএনপির জাতীয় ঐক্যের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত থাকেনি, বিএনপি ও তার মিত্র জামায়াতের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদীদের মদদাদনের অভিযোগও এনেছে।
আওয়ামী লীগের এক সময়ের রাজনৈতিক দোসর সিপিবি নেতৃত্বও বেগম জিয়ার জাতীয় ঐক্যের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বিএনপির কঠোর সমালোচনা করেছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, ড. কামাল হোসেনসহ অতিক্ষুদ্র দলের নেতারা প্রস্তাব দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামকে জোট থেকে বাদ দিলেই কেবল বিএনপির জঙ্গিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় শামিল হবেন। এসব নেতাদের কথায় প্রভাবিত হয়ে বিএনপির থিংকট্যাং বলে কথিতদের এবং বিএনপি নেতৃত্বের কেউ কেউ জামায়াতে ইসলামকে ২০-দলীয় জোট থেকে বাদ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মনে রাখতে হবে, এই সময়ে জামায়াতকে ২০-দলীয় জোট থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তবসম্মত হবে বিএনপিকে ভেবে দেখতে হবে।
২০-দলীয় জোটে জনপ্রিয়তা এবং সাংগঠনিক শক্তির দিক থেকে জামায়াতের অবস্থান বিএনপির পরেই। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে বিএনপি নেতাকর্মীদের মতো জামায়াতেরও অসংখ্য নেতাকর্মী শহীদ এবং কারাবরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাছাড়া জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনেও ফলাফলের দিক হতে জাতীয় পার্টিকে অতিক্রম করে জামায়াতে ইসলাম তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সুতরাং ভোটের রাজনীতি এবং রাজপথের আন্দোলন বেগবান করা সব বিবেচনাতেই জামায়াতকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত বিএনপির জন্য লাভের চাইতে ক্ষতির সম্ভাবনাই অনেক বেশি। বলা হচ্ছে, ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচন কিংবা মধ্যবর্তী নির্বাচনে বিএনপিকে অংশগ্রহণ করা থেকে দূরে রাখার জন্য তারেক রহমানকে ৭ বছরের কারাদ- দেয়া হয়েছে এবং বেগম জিয়াসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতাদেরও দীর্ঘ মেয়াদে কারাদ- দেয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়।
কারাদ- ভোগকারী নেতারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা হারাবেন। অন্যদিকে জামায়াতকে ২০-দলীয় জোট থেকে বের করে দেবার পরিকল্পনার খবর রটার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ গোপনে জামায়াতে ইসলামের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে চাচ্ছে বলেও শোনা যাচ্ছে। উদ্দেশ্যে বিএনপিকে ভবিষ্যৎ জাতীয় সংসদের নির্বাচন থেকে দূরে রেখে দেশের তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল জামায়াতকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় শামিল তথা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়ে সেই নির্বাচনকে কিছুটা হলেও বৈধতা দেয়া যাবে। তাই এ ধরনের সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বিএনপি নেতৃত্বকে এখনই প্রস্তুত থাকতে হবে। বাংলাদেশের জনগণ আজ গণতান্ত্রিক অধিকার হারাই নয়, সরকারের দ্বারা চরম দমন-পীড়ন ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশকে পুরোপুরিভাবে গ্রাস করার ভারতীয় অপ-পরিকল্পনা।
ডা. জাফর উল্লাহ চৌধুরী বর্তমান সরকারকে ভারত নিয়ন্ত্রিত সরকার বলে অভিহিত করেছেন। ভারতের ভূরাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের নির্মম শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। ভারতের স্বার্থেই বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারই শুধু কেড়ে নেয়া হচ্ছে না, সেই সাথে জাতীয় স্বার্থও বিসর্জন দেয়া হচ্ছে। নামমাত্র মূল্যে বাংলাদেশ ভারতকে সড়ক ও নৌপথে ট্রানজিট দিয়েছে। সুন্দরবন ধ্বংসকারী কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ভারতের সাথে এ সরকার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এসব কারণে জনগণ বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের পাশাপাশি, বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয় আধিপত্যবাদী নীতিরও ঘোর বিরোধী। হিন্দুস্তান টাইমসের ভাষায় বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ ভারতবিরোধী। বিএনপি নেতৃত্বকে জনগণের এই অনুভূতি ও মতামতকে আমলে নিতে হবে। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে হতে হবে আপসহীন।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জনগণকে সাথে করে ভারতের আগ্রাসন মোকাবেলা করে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নোত রেখেছিলেন। শহীদ জিয়ার এই কর্মকা- থেকে শিক্ষা নিয়ে বিএনপি হাইকমান্ডকে জনগণকে সংঘবদ্ধ করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের পাশাপাশি বাংলাদেশকে আরেকটি সিকিম বানানোর পরিকল্পনা রুখে দিতে হবে। বিএনপি নেতৃত্ব বুঝে গেছেন নরেন্দ্র মোদিকে তোষণ করে কোনো ফায়দা হাসিল হয়নি। ভারতে কংগ্রেস কিংবা বিজেপি যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা কেউই চাইবে না বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী কিংবা ইসলামী ভাবধারার কোনো দল ক্ষমতায় আসুক। তারা যে কোনো মূল্যে ভারতবান্ধব আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চাইবে- এ সত্য বিএনপি নেতৃত্ব এখন আশা করি উপলব্ধি করতে পারছেন। কোনো বিদেশী শক্তির আশীর্বাদ নিয়ে নয়, জনগণের সমর্থন ও শক্তির ওপর ভর করেই ক্ষমতায় আসা সম্ভব। তাই বিএনপির নতুন কমিটি দলকে ঐক্যবন্ধ রাখা, গণতন্ত্র পুরুদ্ধারে রাজপথের আন্দোলন গড়ে তোলা এবং ভারতীয় আধিপত্য ও কর্তৃত্বের শৃঙ্খল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে কতটা সফলকাম হবে সেটিই এখন দেখার বিষয়।
লেখক : কলামিস্ট
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।