Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ওসিয়্যাতের ভার অর্পণ ও নির্দেশ

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০৭ এএম


পূর্ব প্রকাশিতের পর
ওসিয়্যাত কয়েক ধরনের হতে পারে। যেমন- ওয়াজিব: যথা গচ্ছিত রাখা সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার ওসিয়্যাত, অজ্ঞাত ঋন পরিশোধের ওসিয়্যাত, ছুটে যাওয়া সিয়ামের ফিদয়া ও কাফ্ফারা আদায়ের ওসিয়্যাত।

মুবাহ: যেমন- আত্মীয় ও অপরিচিত বিত্তবান লোকদের জন্য ওসিয়্যাত। এ ধরনের ওসিয়্যাত বৈধ।

মাকরূহ: যেমন- এমন চরিত্রহীন ও অসৎ লোকদের জন্য ওসিয়্যাত করা যেখানে অধিক সম্ভাবনা থাকে যে, সে ব্যক্তি এ অর্থ খারাপ কাজে ব্যয় করবে। তাহলে সে ওসিয়্যাত মাকরূহ। ওসিয়্যাত যথার্থ ও বৈধ হওয়ার জন্য এর উদ্দেশ্য অবশ্যই শরীয়ত সম্মত হতে হবে। শরীয়ত বিরোধী কোন উদ্দেশ্যে ওসিয়্যাত করা বৈধ নয়। অবৈধ উদ্দেশ্যে ওসিয়্যাত করলে তা কার্যকর হবে না। বরং বাতিল বলে গণ্য হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “সৎকম ও তাকওয়ায় তোমারা পরস্পর সহযোগিতা করবে এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না।

মুস্তাহাব: উর্পযুক্ত তিন ধরনের ওসিয়্যাত ছাড়া যাবতীয় ওসিয়্যাত মুস্তাহাব। ফকীহগণ কুরআন, হাদীস ও উম্মাতের ইজমার ভিত্তিতে ওসিয়্যাতের কল্যাণের দিকটি বিবেচনা করে ওসিয়্যাতকারীর যাকাত, রোযা, হজ্জ ও অনুরূপ অত্যবশ্যকীয় কর্তব্য অপূর্ণ না থাকার শর্তে এই মুসতাহাব ওসিয়্যাতকে অনুমোদন দিয়েছেন। এখানে একটি বিষয় আলোচনা করা জরুরী, সেটি হলো আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে কারও মৃত্যুকাল উপস্থিত হলে সে যদি ধন সম্পত্তি রেখে যায় তবে ন্যায়ানুগ প্রথা মত তার পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনের জন্য ওসিয়্যাত করার বিধান তোমাদের দেয়া হল। এটা মুত্তাকীদের জন্য একটি কর্তব্য”।ইসলামের প্রাথমিক যুগে যতদিন পর্যন্ত ওয়াসিরগণের অংশ কুরআনের আয়াত দ্বারা নির্ধারিত হয়নি, ততদিন পর্যন্ত মৃত্যু পথযাত্রী তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ পরিমাণ পিতা-মাতা এবং আত্মীয়স্বজনের জন্য ওসিয়্যাত করে যেতেন। অবশিষ্ট সম্পত্তি সন্তানদের মধ্যে বন্টিত হতো। নির্দেশটির বিষয়েই এ আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। উক্ত এ আয়াতের দ্বারা ওসিয়্যাত ফরজ বুঝা যায়। অতঃপর ওসিয়্যাত সম্পর্কিত এ নির্দেশটি ‘মীরাস’ এর দ্বারা রহিত করে দেওয়া হয়েছে।

তাফসীরে মাযহারীতে উর্পযুক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এ আয়াত অবতীর্ণের পূর্বেই ইসলামের প্রথম যুগে আত্মীয়-স্বজনের জন্য ওসিয়্যাত করা ফরজ ছিল। পরে এ আয়াত রহিত হয়ে যায়। মীরাস সংক্রান্ত আয়াত এ আয়াতকে রহিত করেছে। মীরাস সম্পর্কিত আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, “পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছ, তা অল্প হোক অথবা বেশি হোক। এটা নির্ধারিত অংশ।” তবে আলিমগণের সর্বসম্মত অভিমত হচ্ছে, যেসব আত্মীয়ের জন্য মীরাসের আয়াতে কোন অংশ নির্ধারণ করা হয়নি, তাদের জন্য ওসিয়্যাত করা মৃত্যু পথযাত্রীর পক্ষে ফরজ বা জরুরী নয়। সে ফরজ রহিত হয়ে গেছে। এখন প্রয়োজন বিশেষে এটা মুস্তাহাবে পরিণত হয়েছে। ওসিয়্যাতের প্রতি গুরুত্বারোপ করে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘কোন মুসলিম ব্যক্তির ওসিয়্যাত করার মত সম্পদ থাকলে তার নিজের নিকট ওসিয়্যাতনামা না লিখে দুই রাতও অতিবাহিত করা উচিত নয়’।

যে সব কথায় ওসিয়্যাত সাব্যস্ত হয় ঃ ‘ওয়াকফ সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, কেউ যদি অপর কোন ব্যক্তিকে বলে, তুমি আমার মৃত্যুর পর আমার উকিল, তখন সে ব্যক্তি তার ওসী হয়ে যাবে। আর যদি বলে, তুমি আমার জীবদ্দশায় আমার ওসী, তবে সে উকিল পরিগণিত হবে। আর যদি বলে, তুমি একশ টাকা মজুরি হিসাবে পাবে, এই শর্তে যে তুমি আমার ওসী হবে। তবে শর্ত বাতিল হবে এবং ওসিয়্যাত স্বরূপ সে একশ টাকা পেতে পারে এবং নির্ভরযোগ্য মত অনুসারে সে ওসী হবে। কেউ যদি লোকজনকে ডেকে বলে তোমরা সাক্ষী থাক যে, “আমি অমুকের জন্য এক হাজার টাকা ওসিয়্যাত করছি”, তাহলে তা ওসিয়্যাত হিসেবে পরিগণিত হবে। আর যদি বলে-“আমি ওসিয়্যাত করছি, অমুকের জন্য আমার সম্পদে এক হাজার টাকা রয়েছে”, তাহলে এ টাকা ওসিয়্যাত নয় বরং স্বীকারোক্তি হিসেবে পরিগনিত হবে।

কেউ যদি ওসিয়্যাত স্বরূপ বলে- “আমার বাড়ির এক-তৃতীয়াংশ অমুকের, আমি তা অনুমোদন করছি”, তবে তা ওসিয়্যাত হবে। আর যদি বলে- “আমুক ব্যক্তির জন্য আমার বাড়ির মাঝে এক ষষ্ঠাংশ রয়েছে”, তবে তা স্বীকারোক্তি হবে। অনুরূপ যদি ওসিয়্যাতের কথা উল্লেখ করে বলে- “অমুক ব্যক্তি আমার সম্পদ থেকে এক হাজার টাকা পাবে”, তবে তা ওসিয়্যাত হবে। কিন্তু যদি বলে- “আমার সম্পদে অমুক ব্যক্তির এক হাজার টাকার রয়েছে”, তবে তা স্বীকারোক্তি হবে। আবার কেউ যদি বলে- “আমার এই বাড়িটি অমুকের’, এ ক্ষেত্রে যদি ওসিয়্যাত জ্ঞাপক কথার উল্লেখ না থাকে এবং আমার মৃত্যুর পর এ কথা না বলে, তবে তা দান হিসেবে ধর্তব্য হবে। যদি এ দানকারী ব্যক্তির জীবদ্দশায় ঐ ব্যক্তি তা দখল করে নেয়, তবে তা সহীহ হবে। কিন্তু দানকারী ব্যক্তির ওফাতের পর দানের এ কথা বাতিল হয়ে যাবে। কোন অসুস্থ ব্যক্তি যদি অপরকে বলে ‘তুমি আমার ঋণ-পরিশোধ কর’, তবে সে ব্যক্তি ওসী হবে। যদি কেউ সুস্থ অথবা অসুস্থ অবস্থায় বলে, ‘যদি আমার কোন কিছু হয় তবে অমুক ব্যক্তি এত পাবে’, তাহলে তা ওসিয়্যাত হিসেবে ধর্তব্য হবে।

ওসিয়্যাত প্রত্যাহার করণ: ওসিয়্যাতকারীর জন্য ওসিয়্যাত প্রত্যাহার করা ইসলামী আইনে বৈধ। কেননা এটা হলো স্বেচ্ছা দান। যা এখনো পূর্ণতা লাভ করেনি। সুতরাং তা থেকে ফিরে আসা জায়িয হবে। হিবার ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে। তা ছাড়া আরেকটি কারণ এই যে, ওসিয়্যাত প্রাপ্ত ব্যক্তির ওসিয়্যাত কবুল করার বিষয়টি ওসিয়্যাতকারীর মৃত্যুর উপর নির্ভর করে। আর ইজাব বা প্রস্তাব কবুল করার আগে তা বাতিল করা যায়। বিক্রয়ের ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে।

ওসিয়্যাতকারী সুস্পষ্ট কথা অথবা কার্যকলাপের মাধ্যমে ওসিয়্যাত প্রত্যাহার করতে পারে। কথার মাধ্যমে প্রত্যাহার হলো যেমন ওসিয়্যাতকারী বলল, ‘আমি অমুক জিনিস অমুক ব্যক্তির জন্য ওসিয়্যাত করে ছিলাম। এখন অমুক ব্যক্তির পরিবর্তে অমুক ব্যক্তির জন্য ওসিয়্যাত করলাম।” আর কাজের মাধ্যমে প্রত্যাহার হলো যেমন, কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির অনুকূলে একটি মূল্যবান গাছের ওসিয়্যাত করলো। পরবর্তীতে সে ঐ গাছ কেটে নিজের গৃহ নির্মাণের কাজে ব্যবহার করল, এমতাবস্থায় তার ওসিয়্যাত প্রত্যাহার হয়ে গেল।

ওসিয়্যাত প্রত্যাহারের ব্যাপারে তিনটি মূলনীতি রয়েছে। যথা- ১। অপরের মালিকানাধীন কোন বস্তুতে যে ধরনের পরিবর্তন-পরিবর্ধন করলে মালিকের মালিকানা নিঃশেষ হয়ে যায়, ওসিয়্যাতকারী ব্যক্তি সে ধরনের কোন পরিবর্তন করলে সে তার ওসয়্যিাত প্রত্যাহার করেছে বলে গণ্য হবে। ২। অনুরূপ ওসিয়্যাতকৃত বস্তুর মধ্যে কিছুর সংযোগন, যা দ্বারা মূলবস্তুর মাঝে পরিবর্তন সাধন হয় এবং এ অতিরিক্ত বস্তু ব্যতীত মূলবস্তুটি প্রদান করা সম্ভবপর না হয়, এরূপ সংযোজন করা প্রত্যাহার বলে গণ্য হবে। ৩। ওসিয়্যাতকৃত বস্তুর মাঝে এমন কোন পদক্ষেপ, যা দ্বারা মালিকানা নিঃশেষ হয়ে যায়, তাও প্রত্যাহার হিসেবে ধর্তব্য হবে।

ওসিয়্যাতের অনুকূলে সাক্ষ্য: মৃত ব্যক্তির ওয়ারিসগণ ওসিয়্যাত অস্বীকার করলে তা প্রমাণের জন্য দুই জন সাক্ষীর সাক্ষ্য পেশ করতে হবে। মত বিরোধের ক্ষেত্রে ওসিয়্যাত প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সাক্ষীর প্রয়োজন, দুইজন লোক যদি সাক্ষ্য দেয় যে, অমুক ব্যক্তি অমুক ব্যক্তির অনুকূলে এই জিনিসের ওসিয়্যাত করেছে, এবং মূসা লাহুও (যার জন্য ওসিয়্যাত করা হয়েছে) এর দাবী করে তবে ওসিয়্যাত প্রামাণিত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“হে মুমনিগণ! তোমাদের কারও যখন মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন ওসিয়্যাত করার সময় তোমাদের মধ্য হতে দুইজন ন্যায়পরায়ন লোককে সাক্ষী রাখবে, তোমরা সফরে থাকলে এবং তোমাদের মৃত্যুর বিপদ উপস্থিত হলে তোমাদের ছাড়া অন্য লোকদের (অমুসলিমদের) মধ্য হতে দুইজন সাক্ষী মনোনীত করবে। ওসিয়্যাতনামার সত্যতা সাব্যস্থ হলেই তা গ্রহণযোগ্য হবে এবং সাক্ষ্য হলো এর প্রমাণ স্বরূপ।

ওসী নিয়োগ ও ওসীর যোগ্যতা: ওসিয়্যাতকারী ব্যক্তি তার কৃত ওসিয়্যাত সম্পাদন করার দায়িত্ব যার উপর ন্যস্ত করে শরীয়তের পরিভাষায় তাকে ওসী বলা হয়। যে কোন বিশ্বস্ত, মুসলিম, বালিগ ও সুস্থবুদ্ধির অধিকারী নারী বা পুরুষকে ওসী নিয়োগ করা যায়। তারা ওসিয়্যাতকারীর আত্মীয় হোক বা না হোক, তবে কোন অমুসলিমকে ওসী নিয়োগ করা বৈধ নয়। নিম্নে ওসীর যোগ্যতা ও ওসী নিয়োগ সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় বর্ণনা করা হলো:

প্রথমত: কোন অমুসলিম ব্যক্তি ওসী হতে পারে না। কারণ, এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ হলো, “আল্লাহ কখনও মুমিনদের উপর কাফিরদের কর্তৃত্ব করার অধিকার দেননি।

দ্বিতীয়ত: ওসীর দায়িত্ব পালনে অপরাগ ব্যক্তিকে যদি ওসী নিযুক্ত করা হয়, তাহলে কাযী তার সাথে অন্য একজনকে নিয়োগ দিবেন। দ্বিতীয়জন প্রথমজনকে ত্রæটিবিচ্যুতি থেকে রক্ষা করবে এবং সহযোগিতা করবে।
তৃতীয়ত: যদি দু’জনকে ওসী নিয়োগ করা হয়, তাহলে একজন অপরজনকে বাদ দিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। এবং কোন পদক্ষেপও গ্রহণ করতে পারবে না।

চতুর্থত: মৃত ব্যক্তির ওসিয়্যাত কার্যকর করার এবং তার নিকট অপরের অথবা অপরের নিকট তার প্রাপ্য ঋণ আদায় করার মত কোন যোগ্য ওয়ারিস বা ওসী নিয়োজিত না থাকলে আদালত এর ব্যবস্থাপনার জন্য ওসী নিয়োগ করতে পারে।

পঞ্চমত: কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিকে ওসী নিয়োগ করা যাবে না। কারণ অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের যোগ্যতা নেই। বরং তার হাতে সম্পদ ন্যস্ত করলে, সে তা নষ্ট করে ফেলতে পারে। এ বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, “যখন তাদের মধ্যে বিচার-বুদ্ধির ক্ষমতা খুঁজে পাবে, তখন তাদের সম্পদ তাদের কাছে প্রত্যর্পণ কর।
লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ওসিয়াত
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ