দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুনশী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বাহ্যিক রেওয়াজের অপ্রয়োজনীয়তা :
আল্লাহর ইবাদত এবং বন্দেগীর সময় দেহ ও প্রাণের বাইরের কোনো জিনিসের প্রয়োজন নেই। না সূর্য উদয় ও এর প্রতি তাকানো প্রয়োজন আছে। না দেবতা, দেবী, বুজুর্গ এবং অলীদের চিত্রগুলোকে সামনে রাখার দরকার আছে, না দরিয়ায় গমন করে পানি ছিটানোর প্রয়োজন আছে, না সামনে অগ্নিকু- জ্বালানোর দরকার আছে, না সামনে মোমবাতি জ্বালানোর হুকুম আছে, না ঘণ্টা ও সিঙ্গা ফুঁকার প্রয়োজন আছে, না লোবান ও বিভিন্ন প্রকার সুগন্ধি দ্রব্য জ্বালানোর প্রয়োজন আছে, না স্বর্ণ এবং রৌপ্যের সুনির্দিষ্ট বরতন রাখার দরকার আছে, না নির্দিষ্ট প্রকার কাপড়ের প্রয়োজন আছে, বরং এসকল বাহ্যিক রেওয়াজ ও শর্তাবলী থেকে ইসলামী ইবাদত সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। এর জন্য শুধু কেবল একপ্রস্থ পবিত্র দেহাবরণ এবং পবিত্র মনের প্রয়োজন। কিন্তু যদি দেহ ও লেবাসের পবিত্রতা অর্জনে কখনো অক্ষম হয়ে যায়, তাহলে অপারগতার ক্ষেত্রে তাও মাফ করা হয়েছে।
ইসলামে ইবাদতের জন্য আল্লাহ এবং বান্দাহর মাঝে কোনো নির্দিষ্ট বংশ, কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিত্বের সাহায্য ও সংশ্লিষ্টতা এবং মধ্যস্থতার প্রয়োজনীয়তা নেই। মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রবর্তিত ধর্মে না হিন্দুদের মতো ব্রাহ্মণ আছে, না পুরোহিত আছে, না পূজারী আছে। না ইহুদিদের মতো গল্পকার আছে, না পাদ্রী আছে, না সংসার বিবর্জিত ব্যক্তিত্ব আছে। না হযরত হারুন (আ.)-এর বংশোদ্ভূত হওয়ার শর্ত আছে, না খৃস্টানদের মতো ইবাদত আদায় করার লক্ষ্যে পাদ্রী ও বিভিন্ন ধর্মীয় পদাধিকারীর স্থান আছে, না পার্সিয়ানদের মতো দস্তুর ও নিয়মনীতি এবং উপাসনা পদ্ধতির প্রয়োজন আছে। মোটকথা, ইসলামের ক্ষেত্রে প্রত্যেক বান্দাহ তার পরওয়ারদিগারের প্রতি স্বয়ং নিজেই আরজি পেশ করে এবং মনের কথা নিজেই বলে, এমনকি নিজেই প্রার্থনার বস্তু উপস্থাপিত করে। এ কারণে প্রত্যেক মুসলমান নিজে নিজেই ধর্মগুরু, নিজে নিজেই গল্পকার, নিজে নিজেই ধর্মীয় নেতা, আইন প্রয়োগকারী এবং কর্তব্য সম্পাদনকারী। ইসলামের বিধান হচ্ছে এই যে, “তোমরা আমাকে আহ্বান কর, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। আল কোরআনে ইরশাদ হচ্ছেÑ “উদউনী আসতাজ্জিব লাকুম” অর্থাৎ “তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের প্রার্থনা কবুল করব।” (সূরা মু’মিন)
বাইরের আকর্ষণ ভিত্তিহীন : অধিকাংশ মাযহাব নিজেদের ইবাদত বন্দেগীকে আকর্ষণীয় ও প্রভাবশালী এবং চিত্তাকর্ষক করার জন্য বাইরের আকর্ষণ ধার করে থাকে। এ জন্য কোথায়ও সিঙ্গার ফুৎকার, কোথাও নৃত্যগীত, কোথাও বাদ্যযন্ত্রের ঝংকার, কোথাও শঙ্খ ও ঘণ্টাধ্বনি, আবার কোথাও হৈ-হুল্লোড়, শোরগোলের সমারোহ দেখা যায়। কিন্তু দ্বীনে মুহাম্মদীর সহজ, সরল ও পবিত্রতার মাঝে এগুলোর কোনো অবকাশ নেই। বরং মানুষের অন্তঃকরণকে আকর্ষণীয় করার জন্য মনের নিবিষ্টতা রূহের সক্রিয় গুঞ্জরণ ছাড়া অন্য কোনো বাইরের আকর্ষণ ও চিন্তা-ভাবনার সুযোগ ইসলামে নেই। যাতে করে আল্লাহ ও বান্দাহর মাঝে ভাবের আদান-প্রদান সঠিক শুদ্ধভাবে বাইরের ছোঁয়াহীন পূর্ণ আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার সাথে পরিসাধিত হতে পারে এবং পবিত্র ও নির্মল পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে।
স্থানবিশেষের কড়াকড়ি : একমাত্র ইসলাম ছাড়া অন্যান্য মাযহাব ইট এবং চুনা পাথরের চার দেয়ালে বন্দি হয়ে আছে। সেখানে পূজাম-প ছাড়া পূজা হয় না, আগুনশালার বাইরে প্রণিপাত হয় না, গির্জা ছাড়া প্রার্থনা হয় না, মূর্তি ছাড়া অর্চনা চলে না। কিন্তু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রবর্তিত ধর্ম ব্যবস্থায় না কোনো দেয়ালের প্রয়োজন আছে, না মেহরাব ও মিম্বারের আবশ্যকতা আছে। এই দ্বীন মনোজ্ঞ প্রাসাদ, ম-প, বেদী, গির্জা ও হর্ম্য হতে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। এই জমিনে প্রতিটি অংশেই ইসলামী ইবাদত প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, সবখানেই ইবাদত করার সুযোগ আছে। এমনকি দুনিয়া জোড়াই মুসলমানদের ইবাদতখানা সুবিস্তৃত। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.)-ইরশাদ করেছেন, “আমাকে আল্লাহপাক এমন কিছু বৈশিষ্ট্য এনায়েত করেছেন যে, যা আমার পূর্বে অন্য কোনো পয়গাম্বরকে দেয়া হয়নি। এর মাঝে একটি হচ্ছে এই যে, আমার জন্য সারা ভূম-লকে সিজদার স্থল করে দেয়া হয়েছে। (বুখারি : কিতাবুস সালাত) সুতরাং তুমি আরোহী হও, চাই পদব্রজে চল, শান্তিময় ফুল বাগানেই থাক, কিংবা হাঙ্গামামুখর কর্মক্ষেত্রে, স্থলভাগে হও অথবা পানিরাশিতে, জমিনেই থাক, চাই আকাশে জাহাজেই থাক, চাই রেলযানে সবখানেই তুমি আল্লাহর ইবাদত করতে পার। সর্বত্রই তুমি বিনয়াবনত সেজদা আদায় করতে পার। এমনকি তুমি যদি ভিন্ন ধর্মের এমন ইবাদতখানায়ও পৌঁছে যাও, যেখানে মূর্তি বিগ্রহ সাজানো রয়েছে, তা যদি তোমার সামনে না থাকে, তাহলে সেখানেও তুমি তোমার ওপর অপরিহার্য ইবাদত আদায় করতে পার। (বুখারি : কিতাবুস সালাত)
বিভিন্ন ধর্মে নির্দিষ্ট ইবাদত পালন করার জন্য বিভিন্ন দিক ও বিভিন্ন বস্তুর প্রতি মুখ করে দাঁড়ানোর আবশ্যকতা লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং মুসলমানদেরকে একটিমাত্র দিকে সংঘবদ্ধ করার লক্ষ্যে যেন তারা একত্ববাদের মূল চেতনা নিজেদের মাঝে প্রতিফলিত করতে পারে তজ্জন্য মুসলমানদের কোনো একটি দিককে নির্দিষ্ট করার আবশ্যকতা নেই। এর জন্য শুধুমাত্র মসজিদে ইব্রাহিমকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। যাতে করে বিভিন্নতার আবিরতা অপসারিত হয় এবং একই কেন্দ্রবিন্দুতে উপনীত হওয়া সহজতর হয়। তাছাড়া মসজিদে ইব্রাহিমী এক আল্লাহর ইবাদতের প্রথম স্থান বা মাকাম। কিন্তু তাই বলে অন্যান্য ধর্মের কেবলার যে গুরুত্ব দেখতে পাওয়া যায়, ইসলামের কেবলা তা হতে মুক্ত ও পবিত্র। কেননা ইসলামের কেবলা উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম দিকের সীমারেখা হতেও পবিত্র। ইসলাম চাঁদ, সুরুজ ও গ্রহ-নক্ষত্রের দিকে মুখ করারও অনুমোদন করে না। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানগণ প্রত্যেক দিক ও প্রত্যেক অঞ্চল হতেই কা’বা শরীফের দিকে থ করে দাঁড়াতে পারে। এর জন্য প্রাচ্য, পাশ্চাত্য, উত্তর ও দক্ষিণ দিকের কোনো বাধ্য-বাধকতা নেই। এমনকি স্বয়ং কা’বা শরীফে উপস্থিত লোকজনও একই সাথে বিভিন্ন দিক থেকে কা’বা ঘরকে সামনে রেখে দাঁড়াতে পারে। যেখানে দিক মাত্রের কোনো জড়তাই নেই। যে যেখানে যেভাবেই থাকুক না কেন, কা’বাকে সামনে রেখে দাঁড়ালেই হলো।
আর কোনো কারণে যদি কা’বা কোন দিকে তা নির্ণয় করা না যায়, তাহলে যেদিকেই মুখ করে দাঁড়াবে, সেখানেই আল্লাহপাক হাজির আছেন। সুতরাং কোনো চলমান যানবাহনে আরোহণ করে ভ্রমণ করার সময় এবং সাধারণ নফল নামাজ সহিহ শুদ্ধ করার লক্ষ্যে কেবলারও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যানবাহন যেদিকে যাবে সেদিকেই সিজদা করা যাবে। যুদ্ধের ময়দানে বরাবর সবদিকেই নামাজ আদায় করা যাবে। যদি খেদা নাখাস্তা কা’বা শরীফের ইমারতও বাকি না থাকে তবুও সেই দিকে মুখ করাই যথেষ্ট। এমনকি কেউ যদি কা’বা শরীফের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, তাহলে যেদিকে ইচ্ছা, সেদিকেই নামাজ আদায় করতে পারে।
মানুষ কোরবানি নিষিদ্ধ : কোনো কোনো ধর্মে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ইবাদত হিসেবে নিজের প্রাণ, কিংবা সন্তানের জান কোরবানি করাকে গণ্য করা হয়। কিংবা দরিয়ায় ফেলে দেয়া বা আগুনে জ্বালিয়ে দেয়ার প্রচলনও দেখা যায়। কিন্তু ইসলাম এই শ্রেণীর ইবাদতকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে এবং সাথে সাথে এ কথাও বলে দিয়েছে যে, আল্লাহর পথে জান কোরবানের অর্থ হচ্ছে কোনো সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অথবা দুর্বলকে সাহায্যদানের নিমিত্তে নিজের জানেরও পরোয়া করতে নেই। যদিও এ পথে মৃত্যুও হয়। এর অর্থ এই নয় যে, নিজের হাতে, নিজের গলা কাটতে হবে।
কিংবা দরিয়াতে ফেলে দিতে হবে অথবা নিজেকে আগুনে ফেলে দিতে হবে অথবা পানিতে ডুবে মরে যেতে হবে।
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোনো বস্তু দ্বারা নিজেকে নিজে হত্যা করবে, তাকে জাহান্নামে ওই বস্তু দ্বারাই শাস্তি দেয়া হবে।” (বুখারি : কিতাবুল আদব)
পশু কোরবানির সংস্কার : কোনো পশুকে কোরবানি করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশা কোনো কোনো ধর্মে প্রচলিত ছিল। আর আরব দেশে এর তরিকা ছিল এই যে, মানুষ জানোয়ার জবেহ করে দেবতার নামে উৎসর্গ করত, আবার কখনো কখনো মৃতের কবরের ওপর কোনো পশুকে বেঁধে রেখে দানা-পানি ছাড়া ফেলে রাখত, এভাবেই পশুটি ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর হয়ে কাঁতরাতে কাঁতরাতে মরে যেত। আরববাসীরা এ কথাও মনে করত যে, আল্লাহ রক্তের নজরানা খুবই পছন্দ করেন। সুতরাং তারা পশু জবেহ করে এর রক্ত মন্দিরের গায়ে ছাপ লাগিয়ে রাখত। ইহুদিদের মাঝে এই দস্তুর ছিল যে, তারা কোনো পশু কোরবানি করে এর গোশত আগুনে জ্বালিয়ে দিত। এ সম্পর্কে তারা যেসব আচার পালন করত তা উপস্থাপিত করলে বৃহৎ আকারের বই হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়।
ইহুদিরা বিশ্বাস করত যে, কোরবানি আল্লাহর খাদ্য। কোনো কোনো ধর্মে কোরবানির গোশত চিল এবং কাককে বিলিয়ে দেয়া হতো। পয়গামে মোহাম্মদী (সা.) এসব ভ্রান্ত মতবাদকে নির্মূল করে দিল। তিনিই সর্বপ্রথম ঘোষণা করেন, কোরবানির দ্বারা গোশত এবং রক্ত মাকসুদ নয় বরং কোরবানি হচ্ছে অন্তরের প্রশান্তি। আল-কোরআনে ইরশাদ হচ্ছেÑ “আল্লাহর কাছে কোরবানির গোশত ও রক্ত কিছুই পৌঁছে না, বরং তোমাদের অন্তরের পরহেজগারিই পৌঁছে।” (সূরা হজ্জ : ৪-৫)
ইসলাম সকল ইবাদতের মাঝে শুধু কেবল হজের মৌসুমেই কোরবানিকে ওয়াজিব করেছে এবং সামর্থ্যবানদের জন্য যারা হজে গমন করেনি, তারা হজের স্মরণে কোরবানি করবে এটাই হচ্ছে মাসনুন তরিকা। যাতে করে হজের সাথে সম্পৃক্ত কোরবানির ঘটনা সকলের স্মৃতিপটে জাগরুক থাকে। যখন মিল্লাতে হানিফীর সর্বপ্রথম আহ্বানকারী স্বপ্নের ব্যাখ্যা অদৃশ্য নিজের একমাত্র পুত্রকে আল্লাহর সামনে কোরবানি করতে চেয়েছিলেন। আল্লাহপাক তার পরীক্ষায় পূর্ণ উত্তীর্ণ হতে দেখে ছুরির নিচে ছেলের বদলে দুম্বার গর্দান রেখে দিলেন। এতে করেই এই মহান ঘটনা মুসলমানদের নিকট বাৎসরিক স্মরণীয় ক্ষণ হিসেবে অম্লান রয়েছে।
একই সাথে পয়গামে মোহাম্মদী (সা.) এই শিক্ষাও প্রদান করলেন যে, কোরবানির উদ্দেশ্য শুধুমাত্র আত্মাসমূহকে খুশি করা, বালা-মুসিবত দূর করা, প্রাণের ফেদিয়া দেয়া কিংবা কেবলমাত্র রক্ত প্রবাহিত করা বা গর্দান কাটাই নয়, বরং এর দ্বারা মকসুদ হচ্ছে দুটি। প্রথমত, আল্লাহপাকের এহসানের শোকর আদায় করা যে, তিনি জীবজন্তুসমূহকে আমাদের প্রয়োজনে লাগিয়েছেন এবং এগুলোকে আমাদের আহার্য সামগ্রী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
দ্বিতীয়ত, এগুলোর গোশত গরিব-মিসকিনদের এবং ফকিরদের আহার করায়ে আল্লাহপাকের খোশনুদী হাসিল করার সুযোগ প্রদান করেছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “আমি প্রত্যেক কওমের জন্যই কোরবানি নির্দিষ্ট করেছি। যাতে করে তারা ওই সকল পশুর ওপর আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে, যা আমি তাদেরকে রিজিকস্বরূপ দান করেছি। বস্তুত তোমাদের উপাস্য কেবলমাত্র একক সত্তা। তার সামনেই মস্তক অবনত কর। আর বিনয় প্রকাশকারী বান্দাহদের খোশ-খবরী শুনিয়ে দিন।” (সূরা হজ্জ : ৫)
আল্লাহপাক আরো ইরশাদ করেছেন, “এবং উটকে আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম করেছি, তোমাদের জন্য এতে মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দ-ায়মান অবস্থায় এদের ওপর তোমরা আল্লাহর নাম নাও। যখন তারা কাতর হয়ে পড়ে যায় তখন তোমরা এদের হতে আহার কর এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকে, যাঞ্চাকারী অভাবগ্রস্তকে আহার করাও, এভাবে আমি এদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছি যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।” (সূরা হজ : ৫)
সুতরাং এটাই হচ্ছে একমাত্র কারণ যে, আল্লাহর নাম ছাড়া অন্য কারো নামে যদি পশু কোরবানি করা হয় তাহলে মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শরিয়তে এ কাজকে শিরক হিসেবে গণ্য করা হবে এবং এর গোশত খাওয়াও হারাম হবে। আল-কোরআনে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে, “যা আল্লাহর নাম ছাড়া অন্যের নামে জবেহ করা হয়েছে তা হারাম।”
আরব দেশে এই প্রথা চালু ছিল যে, তারা খাস করে রজব মাসে কোরবানি করত। ইসলাম আগমনের পর, লোকজন এ সম্পর্কে প্রশ্ন রাখলে রাসূলে পাক (সা.) উত্তর করলেন, “আল্লাহর নামে যে কোনো মাসে ইচ্ছা জবেহ কর, নেক কাজ আল্লাহর উদ্দেশ্য সম্পাদক কন এবং গরিবদেরকে আহার করাও।” (আবু দাউদ : ২য় খ-, আতিরাহ অধ্যায়)
মোটকথা কোরবানির এই দুটি হাকিকতই মূলত মুখ্য। শুধু কেবল রক্ত প্রবাহিত করাই কোরবানির হাকিকত নয়। আর এই রক্ত প্রবাহিত করা মোশরেকদের দেবীসমূহ এবং দেবতাসমূহের খুশি করার মতো আল্লাহকে খুশি করার জন্যও নয়।
অংশীবাদী কোরবানির নিষিদ্ধতা : এ কারণে সকল মুশরেকানা কোরবানি-যা আরবে প্রচলিত ছিল তার মূলোৎপাটন করা হলো। আরবে পশু কোরবানি করা এবং এগুলো দেবতাদের নামে উৎসর্গ করার বিভিন্ন পন্থা প্রচলিত ছিল। উটনীর প্রথম বাচ্চা হলে তা দেবতার নামে কোরবানি করা হতো এবং এর চামড়া গাছে লটকিয়ে রাখা হতো। এই শ্রেণীর বাচ্চাকে বলা হতো ‘ফারা’ আর রজব মাসের প্রথম দশ তারিখে একশ্রেণীর কোরবানি করা হতো-এর নাম ছিল আতিরাহ। ইসলাম এই উভয় কোরবানিকেই নাজায়েজ সাব্যস্ত করেছে। রাসূল পাক (সা.) এ প্রসঙ্গে ইরশাদ করেছেনÑ লা ফারায়া ওয়ালা আতিরাতা অর্থাৎ ফারা এবং আতিরাহ জায়েজ নয়। (আবু দাউদ : কিতাবুল জানায়েজ, ২য় খ. ৫ পৃ.)
কখনো কখনো দেবতার নামে জীবিত পশুকে ছেড়ে দেয়া হতো এবং এগুলোকে কোনো লোক অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারত না। সুতরাং আল-কোরআনে এ সম্পর্কে খাস করে এই আয়াত নাজিল হয়। ইরশাদ হচ্ছে, “বাহীরা, সাইবা, ওয়াসীলা ও হাম” আল্লাহ স্থির করেননি।
যে জন্তুর দুধ প্রতিমার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হতো তাকে বলা হতো বাহীরা আর যে জন্তু প্রতিমার নামে ছেড়ে দেয়া হতো তাকে সাইবা বলা হতো এবং যে উটনী পর পর মাদী প্রসব করত, একেও প্রতিমার নামে ছেড়ে দেয়া হতো, এর নাম ওয়াসীলা। আর যে নর উটকে বিশেষ সংখ্যক প্রজননের কাজে ব্যবহার করা হতো, একেও প্রতিমার নামে ছেড়ে দেয়া হতো, এর নাম ছিল হাম। এ সকল জন্তু কোনো কাজে লাগানো তাদের কাছে নিষিদ্ধ ছিল।
আবার কখনো কখনো মৃতদের কবরের পাশে, গাভী অথবা বকরি জবেহ করা হতো। কিন্তু ইসলাম মাতম জারির সংস্কার করে এর প্রতিও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং এগুলোকে নাজায়েজ সাব্যস্ত করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “লা আকরা ফিল ইসলামী” অর্থাৎ ইসলামে কবরের সন্নিকটে পশু জবেহ করা জায়েজ নয়। (আবু দাউদ : কিতাবুল জানায়েজ, ২য় খ-, ১৪৪ পৃ.)
জাহেলিআতের যুগে আরবে এই দস্তুরও ছিল, মানুষ স্বীয় বদান্যতা ও দানশীলতা এভাবে প্রকাশ করত যে, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পশু কোরবানির বাজি রেখে কাজ শুরু করত। এদের একজন একটি উট জবেহ করত, এর জবাবে প্রতিপক্ষও একটি উট জবেহ করত। এভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে আসত। তাদের মাঝে যার উট শেষ হয়ে যেত কিংবা কেউ পুনর্বার জবেহ করতে অস্বীকার করত, সে পরাজয়বরণ করত। পবিত্র ইসলাম এ সকল কোরবানি ও জান এবং মাল ধ্বংস করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। (আবু দাউদ : কিতাবুল আদাহী, ২য় খ. পৃ. ৫) প্রকৃতপক্ষে সুস্বাদু খাদ্য ও পানীয় পরিহার করে রিয়াজত করা এবং কঠিন কষ্ট সহ্য করে ইবাদত করাও ইসলাম অনুমোদন করে না। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।