Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধামতীর পীর সাহেব হুজুর মাওলানা আবদুল হালিম (রহ.)-এর জীবন ও কর্ম

মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী | প্রকাশের সময় : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

কুমিল্লা জেলার ঐতিহ্যবাহী ধামতী ইসলামিয়া কামিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ এবং ধামতী দরবারের পীর সাহেব হুজুর, উস্তাজুল ওলামা মাওলানা আবদুল হালিম (রহ.) আমাদেরকে ছেড়ে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন গত ০২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ বুধবার। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে ও নাতি-নাতনি ছাড়াও অসংখ্য শিষ্য ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তিনি দীর্ঘ দিন বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলাধীন ধামতী গ্রামে ০২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা উপমহাদেশের অন্যতম আধ্যাত্মিক রাহবার ফুরফুরা শরিফের পীর মুজাদ্দিদে জামান আবু বকর সিদ্দিকী আল-কুরাইশী (রহ.)-এর অন্যতম খলিফা পীরে কামেল মাওলানা আজিম উদ্দীন আহমদ (রহ.)। তিনি ফাজিল পর্যন্ত লেখাপড়া করেন পিতার প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী ধামতী ইসলামিয়া কামিল মাদরাসায়। ছাত্রজীবনের প্রতিটি স্তরে তিনি অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তারপর তিনি মাদরাসা-ই-আলিয়া ঢাকা থেকে হাদিসশাস্ত্রে কামিল ডিগ্রি অর্জন করেন। এ মাদরাসায় তিনি বরেণ্য মুহাদ্দিসদের কাছে ইলমে দীন হাসিল করেছিলেন। এসকল মুহাদ্দিসদের মধ্যে মাওলানা মুফতী সৈয়দ আমীমুল ইহসান মোজাদ্দেদী (রহ.), মাওলানা আবদুর রহমান কাশগড়ী (রহ.), মাওলানা যাফর আহমদ উসমানী (রহ.), মাওলানা খতিব উবায়দুল হক জালালাবাদী (রহ.) এবং মাওলানা আলাউদ্দীন আল-আজহারী (রহ.) অন্যতম। এছাড়া ধামতী ইসলামিয়া কামিল মাদরাসায় অধ্যয়নকালীন সময়ে তিনি দেশবরেণ্য হাদিস বিশারদ শায়খুল হাদিস মাওলানা ছফিউল্লাহ মুসাপুরী (রহ.) কে উস্তাদ হিসেবে পান।

স্বীয় পিতা ধামতী দরবারের প্রতিষ্ঠাতা পীরে কামেল মাওলানা আজিম উদ্দিন আহমদ (রহ.)-এর সান্নিধ্যে তিনি ইলমে তাসাউফের আধ্যাত্মিক দীক্ষা লাভ করেন। ১৯৭৪ সালের মে মাসে স্বীয় পিতা ও মুরশিদ মাওলানা আজিম উদ্দিন আহমদ (রহ.)-এর ইন্তিকালের পর আমৃত্যু হজরত মাওলানা আবদুল হালিম (রহ.) ধামতী দরবারের পীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৩ সালে তিনি দেশ সেরা দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী ধামতী ইসলামিয়া কামিল মাদরাসার উস্তাদ হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন এবং ১৯৭৫ সালে অত্র প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।২০০৪ সালে তিনি অত্র প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ইলমে দীনের প্রসারই ছিলো মাওলানা আবদুল হালিম (রহ.)-এর জীবনব্যাপী ব্রত। তাই তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর ধামতী ইসলামিয়া কামিল মাদরাসাকে এমন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছেন, যেখান থেকে বিশ্বব্যাপী বিচ্ছুরিত হয়েছে দীনি শিক্ষার আলো। তাঁর প্রচেষ্টায় অত্র মাদরাসা সমগ্র বাংলাদেশে অনন্য খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় এ মাদরাসার ফলাফল ছিলো অতীব প্রশংসনীয়। ১৯৮৮ সালে এ মাদরাসা শ্রেষ্ঠ মাদরাসার পুরস্কার লাভ করে। এ কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই অনুন্নত এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়া সত্তে¡ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছাত্ররা এ মাদরাসায় আগমন করতো। এ মাদরাসা থেকে বহু মুহাদ্দিস ও আলেম বেরিয়েছে, যাদের অনেকেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে ইসলামের সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। বাংলাদেশের অনেক মাদরাসারই অধ্যক্ষ ও মুহাদ্দিস এ মাদরাসারই কৃতি ছাত্র।

ধামতীর পীর সাহেব মাওলানা আবদুল হালিম (রহ.) ছিলেন বড় অন্তরের অধিকারী। উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও সহৃদয়তার মতো গুণের কারণে সর্বস্তরের মানুষের কাছে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। দলমত নির্বিশেষে সব মানুষকে আপন করে নেয়ার গুণ ছিল তার সহজাত। তিনি খুবই অনাড়ম্বর ও সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন। তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ, খাদ্য-খাবার ও বসবাসের উপায়-উপকরণ সবই ছিলো খুবই সাদাসিধে। বর্তমান যুগের আড়ম্বরপূর্ণ ও ভোগ বিলাসময় জীবনযাপন পদ্ধতি তার জীবনকে প্রভাবিত করতে পারেনি। তিনি রাসূলে কারিম (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের পূর্ণাঙ্গ অনুসারী ছিলেন। তিনি সম্পূর্ণ দুনিয়া বিমুখ একজন বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন।

তিনি ছিলেন সুন্নতের পরিপূর্ণ পাবন্দ, সর্বদা হাসিখুশি, প্রাণবন্ত ও দরাজদিলের অধিকারী। ইন্তিকালের পূর্ব মুহূর্তেও তাসবিহ হাতে জিকির করতে দেখা গেছে তাকে। প্রচারবিমুখ এই মনীষীর বিনয় ও সৌজন্যতা ছিলো তার মধুর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। স্বভাবগতভাবে তিনি বেশ গম্ভীর ও মিতভাষী ছিলেন। তবে তাঁর মাঝে কৌতুক ও রসবোধও ছিলো। মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের সাথে মাঝে মাঝে খোশগল্পে মশগুল হতেন। তাছাড়া প্রায় সময় তিনি ছাত্র, আলেম-ওলামাদের টাকা হাদিয়া দিতেন। মানুষকে সম্মান জানিয়ে তিনি আনন্দ পেতেন। অন্তর্গত বিশ্বাস, বোধ ও শুদ্ধাচারে তিনি ছিলেন অটল। বহু মানুষ তাঁর পবিত্র পরশে পাপাচারমুক্ত জীবনের সন্ধান পেয়েছে।

মাওলানা শাহ আহমদ হাসান সিদ্দিকী ও শাহ মুহাম্মদ বাহাউদ্দীন আহমদকে দরবারের নতুন পরিচালক হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। তারা উভয়েই উদার আচরণ, নিরহঙ্কার জীবনধারা ও মার্জিত ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষকে মোহিত করে থাকেন। তাদের মাধ্যমে ধামতী দরবার ও মাদরাসার ঐতিহ্য সংরক্ষণ, আধ্যাত্ম সাধনা, শিক্ষা ও মানবসেবার ধারা আগামী দিনগুলোতে আরো বেগবান হবে, এটাই সকলের প্রত্যাশা।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মরহুম পীর সাহেব হুজুরকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন এবং নব নিযুক্ত পরিচালকদ্বয়কে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন!
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পীর-সাহেব
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ