Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

কারণে-অকারণেই বিএসএফ ব্যবহার করছে মারণাস্ত্র

সীমান্তে হত্যা বন্ধ হবে কবে সীমান্ত হত্যা কোনোভাবেই মেনে নেয়ার সুযোগ নেই : মানবাধিকার কর্মী নূর খান

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

দুই দশকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের হাতে ১২০০ বাংলাদেশি নাগরিক নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি কখনও গুলি না করলেও সাধারণ ঘটনায় বিএসএফ সদস্যরা গুলি করে। দুদেশের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর মাঝখানে কয়েক বছর হত্যাকান্ডের সংখ্যা কিছুটা কমলেও গত বছর থেকে এই নৃশংসতা আবারও বেড়ে গেছে। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসেই বিএসএসফের হাতে ২৫ বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছে। এ ছাড়া জুলাই থেকে এ পর্যন্ত আরও ১২ বাংলাদেশি সীমান্ত হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে গত ১২ দিনে হত্যার শিকার হয়েছে ৩ জন। ভারত নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে একের পর এক ঘটছে নৃশংস হত্যাকান্ড। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) সীমান্তে কারণে-অকারণেই ব্যবহার করছে মরণাস্ত্র। গুলি করে বা ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় নিরীহ বাংলাদেশিদের। এমন পরিস্থিতিতে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, দুটি দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্তে¡ও সীমান্তে এভাবে নিরীহ বাংলাদেশিদের নৃশংসভাবে হত্যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ জন্য প্রয়োজন জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধের কোন সম্ভাবনা দেখছি না। সরকারের পক্ষ থেকে নানা কথা বলা হলেও বিএসএফ নির্ধিদ্বায় নিরীহ বাংলাদেশিদের হত্যা করছে। বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই সীমান্ত হত্যা বন্ধে জাতিসংষের মাধ্যমে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এক সময় বিএসএফয়ের পক্ষ থেকে বলা হতো বাংলাদেশি নিঃঅস্ত্র নাগরিকরা গরু আনতে গিয়ে সীমান্ত আইন লঙ্গন করছেন এবং বিএসএফয়ের গুলিতে মারা যাচ্ছেন। এখন কিন্তু গরু চোরাচালান নেই, আর বলা হচ্ছে মাদক ব্যবসাসহ অন্যান্য অপরাধে সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা করা হচ্ছে। এগুলো ভারতের মনগড়া কথা। কোন বাংলাদেশি আইনভঙ্গ করে ভারতের সীমান্তে প্রবেশ করলে বা সীমান্তের কাছাকাছি গেলেই তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করে গুলি করে কিংবা নির্যাতন করে হত্যা করার হচ্ছে। সীমান্ত হত্যা কোনভাবেই মেনে নেয়ার সুযোগ নেই।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য মতে, ২০১০ সালের আগে সীমান্তে ব্যাপকহারে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যাকান্ডের শিকার হতো। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এক দশক ধরে সম্পর্ক ভালো হলেও অবস্থার তেমন উন্নতি ঘটেনি। গত ১৮ আগস্ট দুদিনের সফরে ঢাকায় এলে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্ত হত্যা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ঢাকা। বৈঠক শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানান, অমীমাংসিত বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে সীমান্ত হত্যা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। সীমান্তে অনাকাক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য তারা বিএসএফকে নির্দেশনা দেবেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। শ্রিংলার আশ্বাসের পরও সীমান্তে গত সপ্তাহে একাধিক হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ সামস মোরসালিন গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সীমান্ত হত্যা দুই দেশের সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া বাংলাদেশের জন্যও এটা অস্বস্তিজনক বিষয়। তিনি বলেন, যদি বাংলাদেশের নাগরিক হয়; তা হলে অবশ্যই তাকে নিরাপত্তা দেয়া উচিৎ রাষ্ট্রের। আর দেখা মাত্র গুলি করা নীতি থেকেও ভারতকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটা বাংলাদেশ অনেক দিন থেকে বলে আসছে। কোন বিষয় থাকলে গুলি না করে দু’পক্ষের মিটিং বা আরো উচ্চ পর্যায়ে বসে বিষয়টি সমাধান করা উচিৎ। চোরাচালন সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা একটা দেশের পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব নয়। অপরাধী যেই থাকুক বিচার করে এভাবে মারা ঠিক নয়। সে ক্ষেত্রে দুই দেশকেই এগিয়ে আসতে হবে।
বিজিবির মুখপাত্র লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, সীমান্ত হত্যা সংঘটিত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো সীমান্তবর্তী মানুষের অসচেতনতা। ইতোমধ্যে মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ বাড়ায় সীমান্ত হত্যা কমে আসছে। এ বিষয়ে বিজিবি সর্বদা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

গণমাধ্যমের তথ্যে দেখা গেছে, গত ১০ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বেওরঝাড়ি সীমান্তে শরিফুল ইসলাম ওরফে খুটা মোহাম্মদ (৩০) নামে এক বাংলাদেশি জেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ। ৫ সেপ্টেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার তেলকুপি সীমান্তে মো. বাদশাহ (২৭) নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনার পর ৬ দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত তার লাশ ফেরত দেয়া হয়নি। ৩ সেপ্টেম্বর ভোরে কুড়িগ্রামের নাগেশ^রী উপজেলার নারাছুপুর ইউনিয়নের পাখিউড়া সীমান্তে ছবিল উদ্দিন (৩৬) নামে এক বাংলাদেশি যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে ৩১ আগস্ট যশোরের শার্শা সীমান্তে অজ্ঞাতনামা এক যুবককে গুলি করে বিএসএফ সদস্যরা লাশ নিয়ে যায় বলে জানায় স্থানীয়রা। ১৪ আগস্ট কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে আবুল কাশেম (৩৫) নামে এক যুবককে হত্যার ১৪ দিন পর ২৮ আগস্ট লাশ ফেরত দেয় বিএসএফ।

মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্রের’ (আসক) প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত প্রথম ৬ মাসে বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে ২৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছে। যাদের মধ্যে ২১ জনেরই মৃত্যু হয়েছে গুলিতে আর চারজন নির্যাতনে মারা গেছেন। সংস্থাটির মতে, গত বছরের (২০১৯) প্রথম ৬ মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে হত্যাকান্ডের সংখ্যা বেশি। গত বছর একই সময়ে বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে ২০ বাংলাদেশি নিহত হয়। এর মধ্যে গুলিতে ১৮ জন আর নির্যাতনে মারা যায় দুজন বাংলাদেশি।

নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি ঘটলেও দুদেশের সীমান্তে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। সীমান্ত হত্যা বন্ধে দুদেশের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা হলেও কার্যত বাস্তব অবস্থা একই রয়ে গেছে। ২০১৬ সাল থেকে মাঝখানে তিন বছর হত্যাকান্ডের সংখ্যা কিছুটা কমলেও গত বছর থেকে তা আবার বেড়ে যায়। এর কারণ হিসেবে আগে গরু পাচারের কথা বলা হলেও সেটি এখন অনেক কমেছে। এ ছাড়া মরণঘাতী নয় এমন অস্ত্র ব্যবহার করার কথা থাকলেও উল্টো সেগুলোই বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। যার কারণে সীমান্ত হত্যা বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদসহ এখনও নানা কর্মসূচি পালন করছে বাংলাদেশিরা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ