Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

করোনা দুর্যোগে মহালুটপাট

কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের কেনাকাটা ১০ গুণ বেশি দামে কার্যাদেশ শ্যালক-ভাগ্নের প্রতিষ্ঠানকে

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৩০ আগস্ট, ২০২০, ১২:০০ এএম

করোনায় স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন সেক্টরের দায়িত্বশীলদের যেন পোয়াবারো। দায়িত্ব পেয়েই অনিয়মের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছেন বড় অঙ্কের অর্থ। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্রয়ে বড় অনিয়ম-দুর্নীতি হলেও তা আড়ালেই থাকছে। কারণ এই সময়ে সবার নজর দেশের স্বাস্থ্যখাতে। আর তাই করোনার মতো মহাদুর্যোগে বের হয়ে আসছে স্বাস্থ্যখাতের নানা অনিয়ম। এরই ধারাবাহিকতায় উঠে এসেছে করোনার চিকিৎসায় প্রথম নিয়োজিত হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে মহালুটপাটের তথ্য।
হাসপাতালের ক্রয় কমিটিকে পাশ কাটিয়ে নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ১০ গুণ বেশি দামে নিজের শ্যালক ও ভাগ্নেকে কাজ দিয়েছেন হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন। শুধু কাজ দেয়াই নয়; স্টোরে মালামাল জমা পড়ার আগেই পরিশোধ করে দিয়েছেন সমস্ত বিল। করোনার সময়ে ক্রয় করা এ ধরনের ৯৩টি বিলের কারসাজির তথ্য উঠে এসেছে ইনকিলাবের অনুসন্ধানে। এর মাধ্যমে ১২ কোটি ১০ লাখ ৬৫ হাজার ৯০০ টাকার কার্যাদেশ দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় পুরোটাই। আর অনিয়মের বিষয়টি ধরা পড়ার উপক্রম হলে নেন ভিন্ন পন্থা।

গত কয়েক মাসে নিজ ক্ষমতায় ক্রয়ের নামে লুটপাট করা তত্ত্বাবধায়ক সর্বশেষ গত ২৫ আগস্ট ক্রয় কমিটির দুই সদস্যকে জরুরি তলব করে পূর্বের বিভিন্ন তারিখের নামে প্রায় অর্ধ শতাধিক স্বাক্ষর নিয়েছেন। আর স্বাক্ষর দিয়ে বিপাকে ক্রয় কমিটির দুই সদস্য ডা. সোহেলী পারভিন ও ডা. মামুনুর রশীদ। এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালের পরিচালক না থাকায় ডা. সেহাব উদ্দিন হাসপাতালে করোনার চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা-খাওয়া নিয়ে বিতর্কিত সাহেদের সঙ্গে কয়েকগুণ বেশি দামে চুক্তি করেছেন। অভিযোগ রয়েছে নার্সদের নিম্নমানের খাবার দেয়ারও। যেখান থেকে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন ডা. সেহাব। আর ডা. সেহাবের এসব অপকর্মের প্রতিবাদ করায় ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামানকে বদলি করা হয়েছে বাগেরহাট সিভিল সার্জন অফিসে। অনুসন্ধানে গত ৩০ মার্চের এক কার্যপত্র অনুযায়ী দেখা যায়, মেসার্স আলী ট্রেডার্স নামের প্রতিষ্ঠানকে ডিপিএম পদ্ধতিতে ১২ ধরণের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৩ কোটি ১৮ লাখ ৪১ হাজার ৭৫০ টাকার কার্যপত্র দেয়া হয়েছে। মার্চ মাসেই এভাবে আরও ৩টি কার্যপত্র দেয়া হয়েছে একই নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে। ১২ মার্চের কার্যপত্রের মাধ্যমে ৭ ধরনের যন্ত্রাপতি ক্রয়ে ১ কোটি ৪২ লাখ ২৫ হাজার টাকা, ১৫ মার্চে ১১ ধরণের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ২ কোটি ৮৩ লাখ ৭ হাজার ৫শ’ টাকা এবং ২৫ মার্চে ৫ ধরণের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ১ কোটি ৪৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকার কার্যাদেশ দেয় ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন। এসব ভারী যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ব্যয় করা হয়েছে ৮ কোটি ৯০ লাখ ৪৯ হাজার ২৫০ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিটি যন্ত্রপাতিই প্রায় ১০ গুণ বেশি দামে ভুয়া এই প্রতিষ্ঠানকে ক্রয়ের জন্য দেয়া হয়। ৩০ মার্চে স্বাক্ষর করা কার্যপত্রের ৬ নম্বর তালিকায় পিসিআর মেশিনের দাম ধরা হয়েছে ১ কোটি ৬৫ লাখ। অথচ এ মানের একটি পিসিআর মেশিনের দাম ২৫ লাখ টাকা। যা প্রায় ১০ গুণ বেশি দামে ক্রয়ের জন্য বলা হয়েছে। একই কার্যপত্রের ৪ নম্বরে ডেফ্রিবেøটর নামে একটি যন্ত্রের দাম ধরা হয়েছে ৯ লাখ ৮১ হাজার অথচ এটির দাম সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা। ৫ নম্বরে সেন্ট্রাল মাল্টিপারপাস প্যাশেন্ট মনিটর নামে যন্ত্রটির দাম ধরা হয়েছে ৫২ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই মেশিনটির সর্বোচ্চ দাম ৮ লাখ টাকা। এদিকে কার্যপত্রে যেসব দেশ ও ব্রান্ডের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সে অনুযায়ী মালামাল সরবরাহ করা হয়নি। চীন থেকে যন্ত্রপাতি ক্রয় করে বিভিন্ন দেশের স্টিকার লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।

জিপিও নং-১৯, মহাখালী সি/এ, বনানী ঢাকা নামে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানায় সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, মেসার্স আলী ট্রেডার্স নামে কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেসার্স আলী ট্রেডার্সের প্যাড ব্যবহার করে ডা. সেহাব উদ্দিনের শ্যালক জাকারিয়া এই কার্যাদেশ নিয়েছেন। যে প্যাডে আলী ট্রেডার্সের মালিক আলমগীরের স্বাক্ষরও নেয়া হয়নি।

ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন এসব অনিয়ম শুধু হাসপাতালের ভারী যন্ত্রপাতি ক্রয়েই সীমাবদ্ধ রাখেননি। হাসপাতালের এমএসআর/চিকিৎসা ও শৈল্য চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ক্রয়েও একই চিত্র উঠে এসেছে। ফকিরাপুলের ১২০, হাবিবুল্লাহ ম্যানশনের জি এম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে আরেক নাম সর্বস্ব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ৩ কোটি ২০ লাখ ১৬ হাজার ৬৫০ টাকার কার্যাদেশ দিয়েছেন। এসব সরঞ্জামাদি সরবরাহ না করেই ডা. সেহাব উদ্দিনের ভাগ্নে মহিউদ্দিনের প্রতিষ্ঠান জি এম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এই টাকা উঠিয়ে নিয়েছে। জানা গেছে, ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স বানিয়ে ডা. সেহাব উদ্দিন নিজেই বিভিন্ন নামে ব্যবসা করছেন। এক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন শ্যালক জাকারিয়া ও ভাগ্নে মহিউদ্দিনকে।
এদিকে হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিনের পীড়াপিড়ীতে বাধ্য হয়ে পূর্বের বিভিন্ন তারিখের এবং তারিখ ছাড়া বিভিন্ন কাগজে প্রায় অর্ধশতাধিক স্বাক্ষর করে বিপাকে আছেন ক্রয় কমিটির দুই সদস্য ডা. সোহেলী পারভীন ও ডা. মামুনুর রশীদ।

ডা. সোহেলী পারভিন ইনকিলাবকে বলেন, গত মঙ্গলবার তত্ত্বাবধায়ক স্যার বিকাল ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার দিকে ফোন দিয়ে হাসপাতালে যেতে বলেন। কিন্তু ওইদিন যেতে পারিনি। পরের দিন সকালে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়ে যেতে বললে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে হাসপাতালে গেলে কতগুলো কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। তখন বলেন, প্রস্তাবনা আকারে আছে রেজুলেশান। পরে যাচাই-বাছাই করে অ্যাকশনে যাবে, কেনাকাটা হবে। কি কাগজ তাও পড়তেও দেননি, পড়ার সুযোগও দেননি। ৪০ থেকে ৫০টি কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া হয়। মার্চ থেকে এপ্রিল ও মে’র বিভিন্ন তারিখের ব্যাকডেটে এ স্বাক্ষর নিয়েছে। এমনকি অনেকগুলোতে তারিখ ছাড়াই স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক স্যার বলেছেন, তারিখ ওনি নিজেই বসিয়ে নিবেন। ডা. সোহেলী পারভিন বলেন, তার মতোই ক্রয় কমিটির আরেক সদস্য ডা. মামুনুর রশীদকে দিয়েও স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক।

আরেক সদস্য ডা. মামুনুর রশীদ বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক স্যার স্বাক্ষর দিতে বলেছে তাই স্বাক্ষর দিয়েছি। স্যার বলেছেন, ‘কয়েকমাসের যে কেনাকাটা হয়েছে তাতে আমরা স্বাক্ষর করেছি। তোমরা (ডা. সোহেলীসহ) কমিটির সদস্য স্বাক্ষর বাকি ছিলো, স্বাক্ষর করে দাও। তার আন্ডারে কাজ করি তাই স্বাক্ষর করে দিয়েছি। অনিয়মের বিষয়ে কিছুই জানিনা বলে উল্লেখ করেন ডা. মামুন।

যন্ত্রপাতি ক্রয়ে জালিয়াতি ও ক্রয় কমিটির দুই সদস্যের পূর্বের বিভিন্ন তারিখে স্বাক্ষর নেয়া প্রসঙ্গে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, গত বুধবার যে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে তা বর্তমান কাজের স্বাক্ষর। পূর্বের কাজের নয়।

পঞ্চাষটির মতো কাগজে স্বাক্ষর নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যা দরকার তাই নিয়েছি। কথা বলার এক পর্যায়ে ইনকিলাবকে ডা. সেহাব উদ্দিন বলেন, আপনার সঙ্গে আলমগীর দেখা করছে। আলমগীর কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি কোন পত্রিকায় আছেন। পরিচয় দিলে তিনি জানান, আমি মিটিংয়ে আছি। পরে কথা বলি। এরপর আর তিনি যোগাযোগ করেননি।



 

Show all comments
  • Mohammed Kowaj Ali khan ৩০ আগস্ট, ২০২০, ৫:৩২ এএম says : 0
    বাহ, বেশ মরার আগে লুটপাট করিয়া মরো। যাহাতে জাহান্নামে অতি সহজে যাইতে পারো। ইনশাআল্লাহ।
    Total Reply(0) Reply
  • Jack Ali ৩০ আগস্ট, ২০২০, ১:২৬ পিএম says : 0
    These people in Bangladesh will: Elsewhere in the Qur’an, Allah Almighty says: “You will surely taste of the tree of Zaqqum. Then you will fill your insides therewith, and drink boiling water on top of it. Indeed you will drink like diseased camels raging with thirst! Such will be their entertainment on the Day of Requital!” (Qur’an, 56:51-66)
    Total Reply(0) Reply
  • Jack Ali ৩০ আগস্ট, ২০২০, ১:২৭ পিএম says : 0
    The people of Hell will become so hungry that they will have no choice but to eat from it until they are full. When they have filled their bellies, this food will start to churn like boiling oil, which will cause a great deal of suffering to them. At that point they will rush to drink Al-Hameem, which is an extremely hot water, and they will drink it like camels that drink and drink but their thirst is never quenched because of some disease. Then it will tear their innards: “... will be given to drink, boiling water, so that it cuts up their bowels.” (Qur’an, 47:15)
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ