দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, “আমি একে নাযিল করেছি কদরের রাত্রে। কদরের রাত সমন্ধে আপনি কি জানেন? কাদরের রাত হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফিরিশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।” (সূরাতুল কাদর, ৯৭:১-৫)। হযরত ইবন ‘আব্বাস (র.) প্রমুখ সাহাবী হতে বর্ণিত আছে যে, লাইলাতুল কাদরে সমগ্র কুরআন লাওহি মাহফ‚য হতে প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়েছে। তারপর ঘটনা অনুযায়ী দীর্ঘ তেইশ বছরে ধীরে ধীরে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। (তাফসীরে ’ইবন কাছীর, খ.৪, পৃ.৫৩৪, কায়রো, ১ম সং, ২০০১খ্রি) হযরত কাতাদাহ্ (র.) বলেন, নাবী কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, “ইবরাহীম (আ.)-এর সহীফাসমূহ ১ম রামাদানে, তাওরাত ৬ই রামাদানে, যাবূর ১২ই রামাদানে, ইনজীল ১৮ই রামাদানে এবং পবিত্র কুরআন ২৪ই রামাদানে অবতীর্ণ হয়েছে।”(তাফ্সীরুল কুরতুবী, খ. ১৬, পৃ. ১২৬, কায়রো, ২য় সং, ১৩৮৪হি./১৯৬৪খ্রী)। অর্থাৎ পৃথিবীতে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণের সূচনা হয় ২৪ই রামাদান।
লাইলাতুল কাদরের অর্থ: হযরত মুজাহিদ বলেন, লাইলাতুল কাদর অর্থ, তাকদীর এবং আদেশ। এ রাত্রিতে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফিরিশতাগণের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিযিক, বৃষ্টি ইত্যাদির পরিমাণ নির্দিষ্ট ফিরিশতাগণক লিখে দেওয়া হয়, এমনকি, এ বছরে কে হজ্জ করবে, তাও লিখে দেওয়া হয়। হযরত ইবন আব্বাস (র.)-এর উক্তি অনুযায়ী চারজন ফিরিশতাকে এসব কাজে সোপর্দ করা হয়। তারা হলেন, ইস্রাফীল, মীকাঈল, ‘আয্রাঈল ও জিব্রাঈল (আ.)। কেউ কেউ বলেন, কাদর অর্থ মাহাত্ম্য ও সম্মান। এর মাহাত্ম্য ও সম্মানের কারণে একে লাইলাতুল কাদর তথা মহিমান্বিত রাত বলা হয়। কেউ কেউ বলেন, “লাইলাতুল কাদর” করে নামকরণের কারণ হলো, কেননা এই রাত্রিতে ইবাদতের সম্মান অনেক বৃদ্ধি পায়। আবূ বকর ওয়ারাক বলেন, এ রাত্রিকে “লাইলাতুল কাদর” বলার কারণ এই যে, কর্মহীনতার কারণে এর পূর্বে যার কোন সম্মান ও মূল্য থাকে না, সে এ রাত্রিতে তাওবা ও ইস্তিগফার ও ‘ইবাদতের মাধ্যমে সম্মানিত ও মহিমান্বিত হয়ে যায়। হযরত ইবন আব্বাস (র.) বলেন, “আল্লাহ্ তা‘আলা পূর্ণ এক বছরের পুরা বাজেট প্রণয়নের কাজ শা‘বানের ১৫ তারিখের রজনীতে শুরু করেন। আর এটার বিবরণ ফিরিশতাদের কাছে পূর্ণাঙ্গভাবে জানিয়ে দেন লাইলাতুল কাদরে। তিনি আরও বলেন, এই রাত্রিতে আগামী এক বছরে যা ঘটবে, রিযিক, জীবন, মৃত্যু, কতজন হজ্জ করবে ইত্যাদি লাওহে মাহফ‚য থেকে নকল করে ফিরিশতাদের কাছে সোপর্দ করা হয়। নতুবা আসল বিধিলিপি আদিকালেই লিখিত হয়ে যায়। (আত-তাফ্সীরুল মাজহারী, খ. ৮, পৃ. ৩৬৮, পাকিস্তান, মাকতাবাতুর রাশীদিয়্যাহ্, ১৪১২হি) হযরত ইকরামা (রা.) বলেন, লাইলাতুল কাদরে আগামী বছর কারা হজ্জ করবে তাদেন নাম, পিতার নাম সহ লিপিবদ্ধ করা হয়। এর মধ্যে কম-বেশি করা হয় না। (তাফ্সীরুল কুরতুবী, খ. ২০, পৃ. ১৩০-১৩১)।
সূরাতুল কাদরের শানে নুযূল: ১. ইবন মাস‘উদ (র.) বলেন, নাবী কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার বনী ইসরা’ঈলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। সে এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জিহাদে মশগুল থাকে এবং কখনও অস্ত্র সংবরণ করেনি। মুসলমানগণ এ কথা শুনে বিস্মিত হলে সূরাতুল কাদর অবতীর্ণ হয়। (তাফ্সীরুল কুরতুবী, খ. ২০, পৃ. ১৩০-১৩২)। এতে এ উম্মতের জন্য শুধু এক রাত্রির ইবাদতই সে মুজাহিদের এক হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করা হয়েছে।
২. হযরত মুজাহিদ (রা.) বলেন, বনী ইসরাঈলের জনৈক ইবাদতকারী ব্যক্তি সমস্ত রাত্রি ইবাদতে মশগুল থাকত ও সকাল হতেই জিহাদের জন্য বের হয়ে যেত এবং সারাদিন জিহাদে লিপ্ত থাকত। সে এক হাজার মাস এভাবে কাটিয়ে দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতেই আল্লাহ্ তা‘আলা সূরাতুল কাদর অবতীর্ণ করে এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। ইবন কাছীর বলেন, এই সূরা অবতীর্ণ করে তাঁর প্রিয় নবী (স.)-এর উম্মতকে সুসংবাদ দেন যে, এই উম্মতের কোন ব্যক্তি যদি লাইলাতুল কাদরে ইবাদাত করে তবে সে বনী ইসরা’ঈলের ঐ ইবাদাতকারীর চেয়ে অধিক পুর্ণ লাভ করবে। (তাফসীরে ’ইবন কাছীর, খ. ৪, পৃ. ৫৩৫) এ থেকে আরও প্রতীয়মান হয় যে, লাইলাতুল কাদর উম্মতে মুহাম্মদীরই বৈশিষ্ট্য। (আত-তাফ্সীরুল মাজহারী, খ. ১০, পৃ. ৩১০)।
৩. হযরত আলী (র.) এবং উরওয়া (র.) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ্ (স.) বনী ইসরা’ঈলের চারজন ‘আবেদের কথা উল্লেখ করেন। তাঁরা আশি বছর পর্যন্ত আল্লাহ্ তা‘আলার ইবাদত করেছিলেন। এই সময়ের মধ্যে ক্ষণিকের জন্যে তাঁরা আল্লাহর নাফরমানী করেননি। তাঁরা হলেন, হযরত আইউব (আ.), হযরত যাকারিয়া (আ.) হযরত হিযকীল ইবন আজূয (আ.) এবং হযরত ইউশা ইবন নূন (আ.)। সাহাবীগণ (র.) এ ঘটনা শুনে খুবই অবাক হলেন। তখন হযরত জিবরাঈল (আ.) রাসূলুল্লাহ্ (স.)-এর নিকট এসে বললেন, হে মুহাম্মদ (স.)! আপনার উম্মত এই ঘটনায় বিস্ময়বোধ করেছেন, জেনে রাখুন যে, আল্লাহ্ তা‘আলা আপনার উপর এর চেয়েও উত্তম জিনিস দান করেছেন। আপনার উম্মত যে ব্যাপারে বিস্মিত হয়েছে এটা তার চেয়েও উত্তম। তারপর তিনি তাঁর কাছে এই সূরাটি পাঠ করলেন। এতে রাসূলুল্লাহ্ (স.) ও সাহাবায়ে কিরাম অত্যন্ত খশী হলেন। (তাফ্সীরুল কুরতুবী, খ. ২০, পৃ. ১৩২; তাফসীরে ’ইবন কাছীর, খ. ৪, পৃ. ৫৩৫)।
৪. হযরত কা‘বুল আহবার (র.) বলেন, বনী ইসরা’ঈলের মধ্যে একজন বাদশাহ ছিলেন, সে একটি ভাল কাজ করেছেন। তখন আল্লাহ্ তা‘আলা সেই যুগের নবীর নিকট ওহী পাঠালেন, অমুক ব্যক্তিকে বলুন, যেন সে কিছু আকাঙ্খা পেশ করে দু‘আ করে। তখন সে বলল, হে আমার প্রতিপালক আমার আশা হলো, আমি যেন আমার সম্পদ, সন্তান এবং আমার আত্মা দিয়ে তোমার রাস্তায় জিহাদ করি। আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে এক হাজার সন্তান দান করলেন। অতঃপর সে একজনকে তার সম্পদ দিয়ে সরঞ্জামসহ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার জন্য প্রেরণ করেন এবং সে সন্তান একমাস জিহাদ করে শহীদ হয়ে যায়। অতঃপর সে অন্য এক সন্তানকে তার সম্পদ দিয়ে সরঞ্জামসহ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার জন্য প্রেরণ করেন। এভাবে প্রত্যেক সন্তান একমাস জিহাদ করে করে শহীদ হয়ে যায়। এতদসত্বেও বাদশাহ রাত্রিতে ইবাদত করেন এবং দিনে রোযা পালন করেন। এভাবে এক হাজার মাসে এক হাজার সন্তান আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়ে যায়। অতঃপর বাদশাহ নিজেই আল্লাহ্র রাস্তায় বের হয়ে জিহাদ করতে করতে নিজেই শহীদ হয়ে যায়। তখন লোকজন বলতে লাগলো, এই বাদশাহর সমপরিমাণ কেউ মর্যাদাবান হতে পারবে না। তখনই আল্লাহ্ তা‘আলা এই সূরাটি অবতীর্ণ করেন। আর সকলকে জানিয়ে দিলেন যে, কাদরের রাত্রিতে ইবাদত করা এই বাদশাহর মত রাতে ইবাদত, দিনে রোযা এবং নিজের জান-মাল ও এক হাজার সন্তানসহ আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হওয়া এরকম হাজার মাস থেকেও উত্তম। (তাফ্সীরুল কুরতুবী, খ. ২০, পৃ. ১৩২)।
লাইলাতুল কাদরি খাইরুন মিন আলফি শাহ্র “কদরের রাত হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।”-এর ব্যাখ্যায় হযরত মুজাহিদ (রা.) ও জামহুরে ওলামায়ে কেরাম বলেন, লাইলাতুল কাদরের ইবাদত, নামায, রোযা ইত্যাদি পুণ্যকর্ম এক হাজার মাসের লাইলাতুল কাদর বিহীন সময়কালের ইবাদতের চেয়ে উত্তম। (চলবে)
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক: ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।