দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মানবজীবন সময়ের সমষ্টি। সময়কে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারোপযোগী করে আল্লাহতায়ালা প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন রাত, দিন, মাস, বছর ইত্যাদি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যাতির্ময় করেছেন এবং উহাদের মনজিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার। আল্লাহ ইহা নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত : ৫)
হিজরি সন শুধুমাত্র আরবি বা কেবল আরবদের একটি সন নয়; বরং এটি মুসলমানদের সন এবং ইসলামি সন। এর গণনা ইসলামি সংস্কৃতির অনুসরণ। ইসলামি ঐতিহ্যের বাস্তব নমুনা। যা নিজ ঐতিহ্যকে অনুসরণ, অনুকরণ করতে শেখায়। এজন্য আরবি মাসগুলোর পরিচিতি ও নামকরণ তুলে ধরা হলো।
মহররম : চার সম্মানিত মাসের প্রথম মাস মহররম। আবার হিজরি সনের প্রথম মাসও মহররম। পূর্বকালে আরবে এ মাসকে পবিত্রতম মাস মনে করা হতো। এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ থাকত এবং একে তখন হারাম মনে করা হতো। এইজন্য এ মাসের নাম রাখা হয়েছে মহররম। মুসলমানদের এই মাস শোক ও চিন্তা-ভাবনা এবং ইবাদতের। কেননা, এই মাসের ৭ তারিখ থেকে ইয়াজিদের বাহিনী হজরত হোসাইন (রা.)-এর জন্য কারবালায় ফুরাত নদীর পানি বন্ধ করে দিয়েছিল। চারদিন পানি, খাবার-দাবার বন্ধ রেখে হজরত হোসাইন (রা.)সহ তাঁর সফরসঙ্গী, পরিবার-পরিজনকে শহিদ করে দেয়।
সফর : সফর ইসলামের দ্বিতীয় মাস। যুদ্ধ নিষিদ্ধ তিনটি মাস শেষ হবার পর প্রাক ইসলামি যুগে আরবের লোকেরা বাড়ি-ঘর খালি করেই যুদ্ধের জন্য বেরিয়ে পড়ত এ মাসে। আরবিতে ‘সাফিরাল মাকান’ ঐ সময় বলা হয় যখন কোনো জায়গা বসতি থেকে খালি থাকে। তাছাড়া ওই সময়টি ছিল আরবের প্রধান অর্থকড়িফসল খেজুর পাকার মৌসুম। তখন খেজুর পেকে হলুদ হতো। তাই সে মাসের নাম রাখা হয় সফর। অর্থাৎ শূণ্য (ঘর) বা হলুদ (শষ্য)-এর মাস।
রবিউল আওয়াল : রবিউল আওয়াল আরবি তৃতীয় মাস। রবি শব্দটি ‘ইরতিবাউন’ শব্দ থেকে নির্গত। অর্থ হলো, ঘরে থাকা। যেহেতু এ মাসে লোকেরা ঘরে বসে থাকত, এজন্য একে রবি নাম দেওয়া হয়েছে।
আমাদের প্রিয়নবী (সা.) এই পবিত্র মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন। এবং এই মাসেই নবীজি (সা.) এই মাসে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন।
রবিউস সানি : রবিউস সানি ইসলামি ক্যালেন্ডারের চতুর্থ মাস। কেউ কেউ নামকরণের কারণ বলতে গিয়ে বলেছেন, আরবে বসন্তকাল দুই মাস জুড়ে হয়ে থাকে; রবিউল আওয়াল এবং রবিউল আখের। অর্থাৎ বসন্তের প্রথম ও শেষ মাস। যে জিনিসের গণনায় তিন আছে সে ক্ষেত্রে ‘সানি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এ দুই মাসের পরে যেহেতু এ নামে আর কোনো মাস নেই তাই রবিউস সানি না বলে রবিউল আখের বলাই ভালো। অনেকের মতে তো ‘সানি’ শব্দ ব্যবহারের অবকাশই নেই।
জুমাদাল উলা : ইসলামি ক্যালেন্ডারের পঞ্চম মাস জুমাদাল উলা। আরবিতে জুমুদ অর্থ জমে যাওয়া। প্রচন্ড শীতে, কিংবা প্রবল শৈত্য প্রবাহে সবকিছু প্রায় জমে জমে যায়। তাই এ মাসের নাম এই নাম। এ মাসটা শীতের মৌসুম হওয়ার কারণে আরবে খুব বেশি ঠান্ডা নেমে আসত। পানি জমে যেত। প্রসিদ্ধ উষ্ট্রি যুদ্ধও এই মাসের ১৫ তারিখে সংঘটিত হয়।
জুমাদাল উখরা : জুমাদাল উখরা ইসলামি ষষ্ঠ মাস। যে সময় এ মাসের নাম রাখা হয় তখন পানি জমার শেষ মৌসুম ছিল। এই মাসের ১ তারিখ হজরত জিবরাইল (আ.) প্রথমবার রাসুলের (সা.) কাছে ওহী নিয়ে এসেছেন।
রজব : এটি ইসলামি ক্যালেন্ডারের সপ্তম মাস। রজব শব্দটি আরবিতে ‘তারজিব’ থেকে উদ্ভুত। অর্থ সম্মান করা। প্রাকইসলাম যুগ থেকেই যুদ্ধ নিষিদ্ধ মাস হওয়ার কারণে তা সকলের কাছে মহিমান্বিত বিবেচিত হতো। তাই এ মাসের নাম রজব রাখা হয়েছে। এ মাসে ওমরা আদায় করা হতো। এ মাসকে বরকতময় হওয়ার কারণ হলো, এ মাসের ২৭ তারিখ রাতে নবীজির (সা.) মেরাজ সংঘটিত হয়।
শাবান : হিজরি বর্ষের অষ্টম মাস এটি। শাবান শব্দটি ‘তাশায়য়াবা’ থেকে নির্গত। এর অর্থ হলো বিভক্ত হওয়া। যুদ্ধ নিষিদ্ধ মাস শেষ হওয়ার পর যুদ্ধের জন্য মানুষেরা বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ত। এইজন্য এ মাসকে শাবান নামে আখ্যায়িত করা হয়। এ মাসের ১৫ তারিখ মুসলমানগণ শবে বরাত পালন করেন। রাতের বেলায় আল্লাহর স্মরণে রত থাকেন। দিনের বেলা রোজা রাখেন। এ রাতে আগামী এক বছরের সবকিছু ফয়সালা হয়।
রমজান : চান্দ্র নবম মাস রমজান। রমজান শব্দটি ‘রামজায়ুন’ থেকে নির্গত। অর্থ হলো প্রখর তাপ, তীব্র গরম। যেহেতু এ মাসে অনেক গরম থাকত তাই তার এ নাম। রমজান মাসে গুনাহের গান্দেগি জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে বান্দা বন্দেগিতে উদ্ভাসিত হয়। এদিক বিচারেও নামটি বেশ যুৎসই।
এ মাসে পুরো এক মাস রোজা রাখা ফরজ। বছরের মধ্যে এ মাসটি সবচেয়ে বেশি বরকতময়। কেননা, দ্বিতীয় হিজরিতে এ মাসেই কোরআন নাজিল হয়। নবীজির জিন্দেগিতে এবং নবীজির পরে এমন কিছু ঘটনা সংঘটিত হয় যেগুলো এ মাসের গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ১৭ রমজান বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যাতে কাফেরদের মোকাবেলায় মুসলমানগণ প্রথমবারের মতো বিজয়ী হয়েছেন। এ মাসের ২৭ তারিখে লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এ মাসের ইবাদত অনেক বেশি কবুল হয়। তারাবির নামাজ এ মাসের বিশেষ ইবাদত। রমজান শেষে আসে সুমহান পবিত্র ঈদুল ফিতর।
শাওয়াল : হিজরি সনের দশম মাসের নাম শাওয়াল। ‘শাওলুন’ শব্দের অর্থ ক্ষিপ্রতা। এ মাসে আরবরা সফর ও শিকারের উদ্দেশ্যে নিজ নিজ এলাকা থেকে বের হতো। শিকারের সময় শিকারীরর ক্ষিপ্রতা না থাকলেই নয়। সে সুবাদে তখন প্রায় সকল আরবের মধ্যেই শিকারে ক্ষিপ্রতা বিরাজ করত। আরবদের সমকালীন অবস্থার দিকে লক্ষ করে এ মাসের নাম রাখা হয়, শাওয়াল। এর ১ তারিখ পবিত্র ঈদুল ফিতর। এ মাসের ফজিলত ঈদের কারণে। মুসলমানগণ বিশেষ করে ছোট ছোট বাচ্চারা এ দিনে খুবই খুশি-আনন্দে মেতে ওঠে। পরষ্পর কুলাকুলি করে। বাসা-বাড়িতে মিষ্টান্ন পাকানো হয়। হাদিসে ঈদুল ফিতরের পরে ছয়দিন রোজার অনেক ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে।
জিলকদ : জিলকদ ইসলামি ক্যালেন্ডারের এগারোতম মাস। আল্লাহতায়ালা এ পবিত্র মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ হারাম করেছেন। তাই লোকেরা এ মাসে ঘরে বসে দিন কাটাত। এইজন্য এই মাসকে জিলকদ নামে অভিহিত করা হয়। এ মাসে মুসলমানগণ হজের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
জিলহজ : ইসলামি ক্যালেন্ডারের বারোতম ও সর্বশেষ মাস জিলহজ। এটি ফরজ বিধান হজের মাস। এইজন্য এ মাসকে জিলহজ বলা হয়। এর ৯ তারিখ মুসলমাণগণ হজ আদায়ের জন্যে আরাফার ময়দানে একত্রিত হন। ১০ তারিখ ইবরাহিমি আদর্শ বাস্তবায়নকল্পে আল্লাহর দরবারে পশু কোরবানি করেন। (ইবনে কাসির ৪/১২৮-১২৯)
লেখক : মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।