Inqilab Logo

মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দুই মিনিটেই সিনহা হত্যাকান্ড

প্রদীপ, লিয়াকত নন্দ দুলালকে নেয়া হয় ঘটনাস্থলে

কক্সবাজার ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ২১ আগস্ট, ২০২০, ১১:৫৯ পিএম

ঘটনাস্থল রেকি করেই খুনের বিবরণ তুলে ধরল র‌্যাব

হাতকড়া পরা প্রদীপকে এক নজর দেখার জন্য গতকাল টেকনাফের বাহারছড়ায় পুলিশ চেকপয়েন্টে জড়ো হয়েছিল অসংখ্য মানুষ। উদ্দেশ্য এক সময়ের মহাপরাক্রমশালী ওসি প্রদীপ কিভাবে সিনহা হত্যাকান্ডের বর্ণনা দেন তা শোনা-দেখার জন্য। এক সময়ের বেপরোয়া ওসি প্রদীপকে বড়ই বিমর্ষ দেখা যায়। ঘটনাস্থলে র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে ওসি প্রদীপকে দেখা গেছে খুবই বিমর্ষ। এ সময় সিনহাকে গুলি করার ঘটনা দুই মিনিটের মধ্যেই ঘটেছে বলে জানান র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল তোফায়েল মোস্তাফা সরওয়ার। তিনি বলেন, সেই দুই মিনিটের মধ্যে কি এমন ঘটেছিল যে, গুলি চালিয়েছিল পরিদর্শক লিয়াকত, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে। গুলির ঘটনা তাৎক্ষণিক না পরিকল্পিত ছিল সে প্রশ্নের উত্তরও খোঁজা হচ্ছে।
প্রতক্ষ্যদর্শীদের ভাষ্যমতে, লিয়াকতের হাতে আগে থেকেই অস্ত্র ছিল। হঠাৎ অভিযান হলে তার হাতে অস্ত্র থাকবে কেন? পুলিশের ভাষ্য মতে মেজর সিনহাও নাকি অস্ত্র তাক করেছিল। তাহলে দুই মিনিটের ভিতরে লিয়াকত কি এমন করেছিল, কেন তার হাতে অস্ত্র ছিল? সে বিষয়েও তদন্ত করা হচ্ছে।

মূলত দেশজুড়ে আলোচিত পুলিশের গুলিতে নিহত সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার ঘটনাস্থল রেকি করেই সিনহা খুনের বিবরণ জানার চেষ্টা করে র‌্যাবের তদন্ত দল। হত্যাকাÐের ‘প্রকৃত রহস্য’ জানতে গতকাল রিমাÐে নেয়া ৩ আসামি ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, এসআই লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যান র‌্যাবের দলটি। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল তোফায়েল মোস্তাফা সরওয়ারের নেতৃত্বে র‌্যাবের দলটি টেকনাফ বাহারছড়া শামলাপুরে গিয়ে প্রকৃত চিত্র জানার চেষ্টা করেন।

টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দ দুলাল মেজর (অব.) সিনহা হত্যায় কে কতটুকু দায়ী তা নির্ণয়ে প্রধান অভিযুক্তদের ঘটনাস্থলে নিয়ে যায় মামলার তদন্ত সংস্থা র‌্যাব। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া আসামিদের বক্তব্যের সঙ্গে আলামতগুলো মিলিয়ে দেখা হয়। র‌্যাব কর্মকর্তা তোফায়েল বলেন, আসামিদের সঙ্গে কথা বলে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, সিনহা হত্যা এক থেকে দুই মিনিটে সংগঠিত হয়েছে। এ অল্প সময়ে এমন কি ঘটেছিল তা জানতে এ সময়ে গাড়ি চেক করা, পরিচয় জানতে চাওয়া, কোন অবস্থার প্রেক্ষিতে গুলিটা হয়েছিল তা বের করতে প্রতিটা সেকেন্ডকে বিশ্লেষণ করছি আমরা। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা আসামিদের দেখানো মতে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখেছেন। এক থেকে দুই মিনিটে ফায়ারিং পর্যন্ত চলে যাওয়ার ঘটনা কোন প্রেক্ষিতে হয়েছে তা বুঝতে চেকপোস্ট থেকে চেকিং পয়েন্ট, বেরিকেড থেকে গাড়ির দূরত্ব, প্রত্যক্ষদর্শীদের দূরত্ব সবকিছু পরিমাপ করেছেন। এর মাধ্যমে তদন্ত কর্মকর্তা তার কনসেপ্ট ডেভেলপ করবেন।

র‌্যাবের একটি সূত্র জানায়, ওসি প্রদীপ কুমার দাশ জিজ্ঞাসাবাদে সিনহা হত্যাকাÐের দায় চাপাতে চেয়েছেন লিয়াকতের ওপর। তবে ঘটনার আগে ও পরে লিয়াকতের সঙ্গে তার ফোনকলের অডিও রেকর্ড শোনানো হলে চুপসে যান প্রদীপ। পরে লিয়াকত ও প্রদীপকে সামনাসামনি এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন দুজনই ঘটনায় নিজেদের সংশ্নিষ্টতা নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ দেন তদন্ত কর্মকর্তার কাছে।

সিনহা হত্যা মামলার আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্ত বেপরোয়া ওসি প্রদীপ, লিয়াকত ও নন্দ দুলাল কে যখন সিনহা হত্যার ঘটনাস্থলে এনেছেন; খবর প্রচার হলে শত শত মানুষ ছুটে আসেন। এমনকি দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন আসামিদের নিয়ে র‌্যাব কি করেন সে দৃশ্য দেখার জন্য। এসময় বিক্ষুব্ধ স্থানীয় লোকজনকে বলাবলি করতে শোনা যায় সবকিছুর একটা শেষ আছে। গত ২ বছরে প্রদীপ টেকনাফে শত শত মানুষ খুন করেছে। অনেক নারী ধর্ষণ করেছে এবং চাঁদাবাজি ও লুটপাট করেছে, তার উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার। একদিন এমন দৃশ্য দেখার জন্য তারা অপেক্ষা করেছিলেন বলেও ভুক্তভোগীদের বলাবলি করতে শোনা যায়।

র‌্যাব সূত্র জানায়, সেদিন এমন কি ঘটনা ঘটেছিল, সিনহাকে এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যে গুলি করা হয়েছিল- এই প্রশ্নের উত্তর জানতে প্রধান তিন আসামিকে ঘটনাস্থলে নেয়া হয়। খুনের ঘটনাস্থল পৌঁছার পর র‌্যাবের তদন্ত দল প্রথমে ঘটনাস্থল এবং আশপাশ ঘুরে দেখেন। দুপুর ২টা পর্যন্ত র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্ণেল তোফায়েল মোস্তাফা সরওয়ার, র‌্যাবের আইন ও মিডিয়া উইং প্রধান লে. কর্ণেল আশিক বিল্লাহ এবং সিনহা হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র‌্যাব-১৫ এর সহকারী পরিচালক সিনিয়র পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম ঘটনাস্থল ও আশপাশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এসময় সেখানে স্থানীয় লোকজনের সাথেও কথা বলেন র‌্যাবের কর্মকর্তারা।

র‌্যাব তাদের পূর্ব সিদ্ধান্ত মতো তদন্তের অংশ হিসেবে কিভাবে সিনহাকে হত্যা করা হয়েছিল তার প্রকৃত চিত্র তুলে আনতে ঘটনার রেকি (লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ, আক্রমণপূর্ব পর্যবেক্ষণ, আক্রমণের কলাকৌশল) শুরু করেন। রেকিতে ওই ঘটনার সাথে মিল রেখে প্রথমে এসআই নন্দ দুলালকে গাড়ি থেকে তার ভূমিকার চিত্র ধারণ করা হয়। এরপর লিয়াকত আলী ও সর্বশেষ সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের রেকি নেয়া হয়। এসময় তাদেরকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়। রেকি পরিচালনা করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিনিয়র পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। রেকি শেষ করেই র‌্যাবের তদন্ত দল ঘটনাস্থলে ছেড়ে চলে আসেন।
বরখাস্ত হওয়া টেকনাফ মডেল থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বরখাস্ত হওয়া ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ও বরখাস্ত হওয়া এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতকে আদালতের নির্দেশ মতে গত ১৮ আগস্ট কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে রিমান্ডে নিয়ে যায় র‌্যাব। এই রেকিও রিমান্ডের জিজ্ঞাসাবাদের অংশ বলে জানিয়েছে র‌্যাব সূত্র।
উল্লেখ্য, গত ৩১ জুলাই খুন হওয়া মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান টেকনাফের বাহারছড়ায় পুলিশ চেকপয়েন্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এরপর ৫ আগস্ট তার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলী, নন্দ দুলাল রক্ষিত, সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়া সহ ৯ জনকে আসামি করে টেকনাফ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন।

পরে মামলা টেকনাফ থানায় নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজু হয়। এই মামলায় এজাহারভুক্ত ৯ আসামির মধ্যে ৭ জন গ্রেফতার হয়েছেন। এছাড়াও পরে আসামিভুক্ত বাহারছড়ার স্থানীয় ৩ জন ও এপিবিএন এর তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এই মামলায় এপর্যন্ত ১৩ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২ জন আসামি পুলিশ সদস্য এখনো পলাতক রয়েছে।
সিনহার গাড়ি : মেজর (অব.) সিনহার পিস্তল ও গাড়িসহ সিনহা হত্যাকাÐের ঘটনাস্থল থেকে জব্দকৃত জিনিসপত্রগুলো র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম এগুলো পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে গ্রহণ করেছেন বলে জানানো হয়। ওদিকে টেকনাফ থানার থেকে গায়েব হওয়া ১২ দিনের সিসিটিভি ফুটেজগুলো ফিরে পেতে আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছেন র‌্যাব। আদালত বিষয়টি শুনানির জন্য রেখেছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সূত্র।

শিপ্রার সামগ্রী : সিনহার সহযোগী শিপ্রা দেবনাথের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ও নগদ টাকাসহ জব্ধকরা ২৯ প্রকার সামগ্রী রামু থানা পুলিশ র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করেছে। ৩১ জুলাই হিমছড়ির নীলিমা রির্সোট থেকে রামু থানা পুলিশ শিপ্রা ও তার আরেক সহযোগীকে আটক করে এবং এই সামগ্রীগুলো জব্ধ করেছিল। বৃহস্পতিবার রাতে রামু থানা পুলিশ ওই সামগ্রীগুলো র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করেন।

 



 

Show all comments
  • M Anik Naim ২২ আগস্ট, ২০২০, ২:৫৯ এএম says : 0
    ফাসি চাই ফাসি দেওয়া হোক
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammad Shah Alam ২২ আগস্ট, ২০২০, ২:৫৯ এএম says : 0
    বাংলাদেশে পুলিশে শুধু প্রদীপ দাস একাই নয়, শত শত প্রদীপ দাস আছে। বিপদে পরলেই প্রকাশ পায়। হায়রে বাংলাদেশ !
    Total Reply(0) Reply
  • পথের সন্ধানে ২২ আগস্ট, ২০২০, ৩:০০ এএম says : 0
    সরকারের শিকড় অনেক গভীরে তেমনি এই হত্যাকাণ্ডের শিকড় অনেক গভীরে ‌। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ssf দায়িত্বে ছিলেন। পূর্ব পরিকল্পিত এই হত্যাকাণ্ড।যে কারণে চাকরি থেকে ফিনিশ দেওয়া হয়েছে সেই কারণেই দুনিয়া থেকে ফিনিশ করা হয়েছে। কিলিং মিশন শেষ করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিশ্চিত করা হয়েছে। গোয়েন্দাদের দ্বারা ফোনালাপের অংশ বিশেষ ফাঁস হওয়া শুধুমাত্র আইওয়াশ। এই হত্যাকাণ্ডের মোটিভেশন করার জন্য
    Total Reply(0) Reply
  • Manik Uddin ২২ আগস্ট, ২০২০, ৩:০২ এএম says : 0
    সদর রিমাইন্ড থেকে আসা মনে হচ্ছে না। শরীর-স্বাস্থ্য তো খুবই ভালো মনে হচ্ছে।হলে বিপদ বারে আর রং বেশি হলে শত্রু বারে।
    Total Reply(0) Reply
  • Mithu Roy ২২ আগস্ট, ২০২০, ৩:০৩ এএম says : 0
    ভাই রে এতো তদন্ত না করে সাক্ষী প্রমাণ সবই যখন দূশ্যমান তাহলে এদের কে ফায়ার করা হোক।তাহলে জাতি কলংক মুক্ত হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Sayed Khorsad Alam ২২ আগস্ট, ২০২০, ৩:০৩ এএম says : 0
    রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া আসামিদের আগে কখনো ক্লিন শেইভে দেখা যাইনি,ওসি প্রদীপ,লিয়াকত,এদেরকে মামার বাড়ীর দাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলো মনে হয়।
    Total Reply(0) Reply
  • MD Thither HK ২২ আগস্ট, ২০২০, ৩:০৪ এএম says : 0
    মাননীয় RAB প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি ওই নরপশু তিন জন কে, যে খানে মেজর সাহেব কে মেরেছে ঠিক ওই নরপশু কুকুর দেরকে ওই খানে ক্রস ফায়ার দেওয়া হোক। ওই নরপশু অনেক মায়ের কোল খালি করেছে তাদের আত্মা শান্তি পাবে
    Total Reply(0) Reply
  • Kamrul ২২ আগস্ট, ২০২০, ৮:৩৮ এএম says : 0
    যে 164 জনকে ক্রস ফায়ার করেছে,তার জন্য 165তম জন (মেজর সিনহা)কে শেষ করতে তো 2 মিনিটের চেয়েও কম সময় লাগার কথা।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মেজর সিনহা হত্যা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ