বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
আবুল কাসেম হায়দার
দেশের বিকাশমান বস্ত্র খাত বর্তমানে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ফলে এক কঠিন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। বস্ত্র খাতের স্পিনিং খাত, ইউভিং খাত, ডাইং-ফিনিশিং খাতের ওপর তৈরি পোশাক শিল্পের অগ্রযাত্রা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে। বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্প ৮৬ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় অর্জন করছে। দেশের সম্পূর্ণ অর্থনীতি আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের চμের ওপর নির্ভরশীল। তৈরি পোশাকের উনড়বতি, বস্ত্র খাতের উনড়বতি। তৈরি পোশাকের অগ্রযাত্রা দেশের মূল অর্থনীতির অগ্রযাত্রা। এখন দেশের অর্থনীতি বিকল্প কোন খাতকে এগিয়ে নিতে পারেনি- অর্থনীতির কর্মকা-ের বিপদকালীন সাহায্য করার। আমাদের জনশক্তি রপ্তানি, চামড়া রপ্তানি, পাট রপ্তানি, কোনো খাতই এখনো তৈরি পোশাকের বিকল্প হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। তাই তৈরি পোশাক শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তৈরি পোশাক শিল্পকে বাঁচাতে হলে বস্ত্র খাতকে অবশ্যই কয়েক গুণ শক্তি দিয়ে বাঁচিয়ে রেখে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
ক্যাপটিভ জেনারেটরে ব্যবহৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বর্তমানের চেয়ে ১৩০ শতাংশ বৃদ্ধি করার প্রস্তাব জমা পড়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি)। এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরের উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে এক কেজি সুতা উৎপাদনে ১৭ টাকার মতো খরচ বাড়বে। বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাসের দাম আবার বাড়ানো হলে দেশের বস্ত্র খাত প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে। বিশেষ করে স্পিনিং বা সুতা তৈরির মিলগুলো অস্তিত্বের সংকটে পড়বে। কারণ, সুতা উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল তুলার দাম গত এক মাসে ১৫ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে আবার গ্যাসের দাম বাড়লে মিলগুলোর সুতা উৎপাদনের খরচ আরও বাড়বে। আর এমনটি হলে সুতা দাম বাড়বে। তখন কিন্তু দেশের বস্ত্রকলগুলো মুখ ফিরিয়ে নেবে। তখন ভারত থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় সুতা আমদানিতে উৎসাহিত হবেন বস্ত্রকলের মালিকরা। তাহলে দেশের ৪৩০টি স্পিনিং মিল ক্ষতির মুখে পড়বে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) জানায়, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি গত ২৯ মার্চ বিইআরসিতে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দিয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ক্যাপটিভ জেনারেটরে ব্যবহৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৮ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৯ টাকা ২৬ পয়সা এবং প্রতি ঘনমিটার ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাসের দাম ৬ টাকা ৭৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা ৯৫ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী ৮ আগস্ট বিইআরসিতে এ বিষয়ে গণশুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
বিটিএমএ তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলছে, গত বছরের আগস্টে ক্যাপটিভ জেনারেটরে ব্যবহৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ছিল ৪ টাকা ১৮ পয়সা। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে তা বাড়িয়ে ৮ টাকা ৩৬ পয়সা করা হয়। এখন তিতাসের প্রস্তাব কার্যকর করা হলে গত এক বছরের ব্যবধানে ক্যাপটিভে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ৪৬০ শতাংশ বেড়ে যাবে। তাতে প্রতি কেজি সুতা উৎপাদনে গ্যাসের খরচ ১৩ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা ৩৩ পয়সায় দাঁড়াবে। বর্তমানে মানভেদে প্রতি কেজি সুতার গড় বিμয় মূল্য ২ দশমিক ৮০ মার্কিন ডলার বা ২২৪ টাকা। অধিকাংশ বস্ত্রকলে ব্যবহৃত হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাসলাইন। নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে এক কেজি কাপড় উৎপাদনের খরচ ২২ টাকার মতো বেড়ে যাবে। দেশে আমদানি করা সুতা এবং দেশে উৎপাদিত সুতা প্রায় একই মূল্যের। বস্ত্রকলের মালিকরা দেশি স্পিনিং মিলের সুতা কেনেন, কারণ μয়াদেশ দেওয়ার দু-তিন দিনের মধ্যেই তা পেয়ে যান। সুতার উৎপাদন খরচ ও খুচরা মূল্য বাড়লে এই সুবিধা আর পাওয়া যাবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। ভারত থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় সুতা আমদানি করা যায়। তা ছাড়া বেনাপোল ও পেট্রাপোল সীমান্তে সম্প্রতি ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট সুবিধা হচ্ছে। তখন ভারত থেকে কম সময়েই সুতা আসবে দেশে। এ বিষয়ে বিটিএমএর সভাপতি ও স্কয়ার টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বলেন, ‘সরকার বলছে, গ্যাস শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি আমরাও বুঝতে পারছি। তবে ব্যবসায়ীরা চান, গ্যাসের দাম ধাপে ধাপে বাড়ানো হোক। এ ক্ষেত্রে ৫-১০ বছরের একটি পরিকল্পনা থাকলে ভালো। এক বছরের ব্যবধানে ক্যাপটিভে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ৪৬০ শতাংশ বৃদ্ধি করলে কোনো শিল্প কারখানাই টিকিয়ে রাখা যাবে না।’ তিনি আরও বলেন, সরকারই একসময় ব্যবসায়ীদের ক্যাপটিভ নিতে উৎসাহিত করেছে। এখন আবার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
ভারত তিন বছরের মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যাওয়ার একটি পরিকল্পনা নিয়েছে। সে জন্য চলতি মাসে দেশটির সরকার ছয় হাজার কোটি রুপির বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। তা ছাড়া ভারতে প্রচুর পরিমাণে তুলা উৎপাদিত হয়, তাদের বস্ত্র খাত শক্তিশালী। বাংলাদেশের তুলার চাহিদার বড় অংশই বর্তমানে ভারত থেকে আমদানি হয়ে আসে।
এসব তথ্য গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মতিন চৌধুরী বলেন, ‘গ্যাসের মূল্য বাড়ালে আমাদের স্পিনিং মিলের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে। এই সুযোগে ভারতের ব্যবসায়ীরা হয়তো এখন কম দামেই সুতা দেবে। তবে পাঁচ বছর পর তারা সুতার দাম বাড়িয়ে দিলে আমাদের বস্ত্র ও পোশাক দুটো গুরুত্বপূর্ণ খাতই ধ্বংস হয়ে যাবে।’ দেশের সর্বোচ্চ পণ্য রপ্তানি আয়ের উৎস পোশাকশিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য হলেও পশ্চাৎমুখী সংযোগশিল্পকে শক্তিশালী রাখা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিটিএমএর সভাপতি তপন চৌধুরী বলেন, ‘এটি সত্য যে, সরকার দীর্ঘদিন আমাদের ভর্তুকি মূল্যে গ্যাস দিয়েছে। এ জন্য প্রতিযোগী সক্ষমতা অর্জন করা গেছে। তবে বর্তমানে গ্যাসের দাম আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ীই আছে। তা ছাড়া ব্যবসার খরচ বৃদ্ধি, তুলার দাম বেড়ে যাওয়া, বিশ্ববাজারে পোশাকের মূল্য কমার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
এখন জরুরি করণীয় : বিটিএমএ নেতৃবৃন্দকে অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা প্রয়োজন। পুরো বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে বুঝাতে সক্ষম হলে তিনি অবশ্যই দেশের স্বার্থে এই মুহূর্তে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবকে গ্রহণ করবেন না। বিশেষ করে শিল্প খাতে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি অবশ্যই স্থগিত করবেন। বিজিএমইএ, বিটিএমএ ও এফবিসিসিআইসহ সকল বৃহৎ ব্যবসায়ী সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধভাবে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি না করার ব্যবস্থায় সμিয় ভূমিকা গ্রহণ করা প্রয়োজন। অবিলম্বে বিটিএমএকে সাংবাদিক সম্মেলন করে দেশবাসীর নিকট বিষয়টি পরিষ্কার করা প্রয়োজন। দেশের শিল্প রক্ষার স্বার্থে শিল্প খাতে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি যে কোনো উপায়ে বন্ধ করার চেষ্টা করতে হবে।
গ্যাসের প্রভাব ও শিল্প খাতের বিকাশ শীর্ষক একটা জাতীয়ভিত্তিক সেমিনার করা প্রয়োজন। ওই বিটিএমএ সেমিনারে সব বিশিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিত নিশ্চিত করতে হবে। গ্যাস সংμান্ত বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষকদের ওই সেমিনারে উপস্থিত করে বক্তব্য প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিনড়ব দৈনিক পত্রিকায় ও টিভি চ্যানেলগুলোতে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ক্ষতিকারক বিষয়সমূহ নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন বের করা জরুরি। ওই প্রতিবেদনসমূহ থেকে সরকার বিষয়টি সহজভাবে বুঝে নিতে পারবে এবং উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের বেশ সহজ হবে। আমাদেরকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় কাজ শুরু করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে গ্যাসের ব্যাপারে নিশ্চিত সময়সূচি ঘোষণা করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে ব্যাংকসমূহর সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ বস্ত্র খাতে। ব্যাংকের নিকট বস্ত্র খাতের ইউনিটসমূহ ঋণখেলাপি হয়ে পড়ার আশঙ্কা বিরাজমান। এ অবস্থায় আমাদের দেশের ব্যাংকসমূহকে বস্ত্র খাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি না করার চেষ্টা করতে হবে। এমনিতে দেশে কোনো বড় ধরনের বিনিয়োগ বিগত ৮ বছর করেনি। তারপর গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ফলে বস্ত্র খাত ঋণখেলাপির তালিকায় নাম উঠালে ব্যাংকসমূহ নতুন করে বিপদের মধ্যে পড়বে। তাই সময় থাকতে ব্যাংকের মালিক সমিতিকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বস্ত্র খাতে বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে প্রচুর। বিদেশি ঋণ দাতাগণও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করলে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। বস্ত্র খাত দুর্বল হয়ে পড়লে বিদেশি ঋণদাতাদের ঋণ ঠিকমতো সময়ে পরিশোধ করতে পারবে না। তাই বিদেশি দাতাগোষ্ঠীকে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। তাদের উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি সহজে গ্রহণ করার ইচ্ছা পোষণ করবেন। জাতীর বৃহত্তর স্বার্থ, দেশে অর্থনীতির গতিকে ঠিক রাখার স্বার্থে অবিলম্বে সরকারকে শিল্প খাতে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির উদ্যোগ প্রত্যাহার করা উচিত।
লেখক : সাবেক সহ-সভাপতি, এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।