Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ড

শেখ হাসিনা | প্রকাশের সময় : ১৫ আগস্ট, ২০২০, ১২:০১ এএম

আল্লাহু আকবার ---
হাইয়া আলাস্ সালা
হাইয়া আলাল ফালা।
-নামাজের জন্য এসো
কল্যাণের জন্য এসো।
মসজিদ থেকে ফজরের আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। প্রতিটি মুসলমানকে আহবান জানানো হচ্ছে নামাজের জন্যে, সে আহবান উপেক্ষা করে ঘাতকের দল এগিয়ে এলো ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ড ঘটাবার জন্য। গর্জে উঠল ওদের হাতের অস্ত্র। ঘাতকের দল হত্যা করল বাঙালির মহান নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

এই নরপিশাচেরা হত্যা করল আমার মা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবকে, হত্যা করল আমার ভাই মুক্তিযোদ্ধা ও ছাত্রনেতা শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং তাদের নবপরিণীতা বধূদের। তাদের হাতের মেহেদীর রঙ বুকের তাজা রক্তে মিশে একাকার হয়ে গেল। খুনিরা হত্যা করল বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভ্রাতা শেখ আবু নাসেরকে, সামরিক বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার কর্নেল জামিলকে, যিনি বঙ্গবন্ধুকে নিরাপত্তা দানের জন্য ছুটে এসেছিলেন। হত্যা করল কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার ও কর্মকর্তাদের। আর সব শেষে হত্যা করল আমার ছোট্ট ভাই দশ বছরের শেখ রাসেলকে। বার বার রাসেল কাঁদছিল, মার কাছে যাব। তাকে বাবা ও ভাইদের লাশের পাশ কাটিয়ে মায়ের লাশের পাশে এনে হত্যা করল।

ঐ ঘৃণ্য খুনিরা যে এখানেই হত্যাকান্ড শেষ করেছে তা নয়। একই সাথে একই সময়ে হত্যা করেছে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনিকে। হত্যা করেছে কৃষকনেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে, তার তের বছরের কন্যা বেবীকে। রাসেলের খেলার সাথী, রব সেরনিয়াবাতের কনিষ্ঠ পুত্র দশ বছরের আরিফ, তার জ্যেষ্ঠ পুত্র আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর চার বছরের সন্তান সুকান্ত, ভ্রাতুস্পুত্র সাংবাদিক শহীদ সেরনিয়াবাতসহ আরো অনেককে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।

আবারও বাংলার মাটিতে রচিত হলো বেঈমানীর ইতিহাস। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে বেঈমানী করেছিল তারই সেনাপতি মীরজাফর, ক্ষমতার লোভে, নবাব হবার আশায়।

১৯৭৫ সালে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল বাংলাদেশে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল তারই মন্ত্রিপরিষদ-সদস্য খোন্দকার মোশতাক। যুগে যুগে এ ধরনের বেঈমান জন্ম নেয়, যাদের ক্ষমতালিপ্সা এক-একটা জাতিকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয়, ধ্বংস ডেকে আনে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করে বাংলার মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকেই খুনিরা হত্যা করেছে। হত্যা করেছে স্বাধীনতার মূল লক্ষ্যকে। বাঙালি জাতির চরম সর্বনাশ করেছে এরা।

এই হত্যাকান্ডের কোনো বিচার হয়নি। জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসে খুনিদের আইনের শাসনের হাত থেকে রেহাই দিয়ে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। আইনের শাসনকে আপন গতিতে চলতে না দেয়ার অশুভ ফল আজ দেশের প্রতিটি মানুষকে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগাচ্ছে।

এই খুনিদের বাংলার মানুষ ঘৃণা করে।
বঙ্গবন্ধুকে এরা কেন হত্যা করেছে?
কি অপরাধ ছিল তার?
স্বাধীনতা- বড় প্রিয় একটি শব্দ, যা মানুষের মনের আকাক্সক্ষা। পরাধীনতার নাগপাশে জর্জরিত থেকে কে মরতে চায়?
একদিন পাকিস্তান কায়েমের জন্য সকলে লড়েছিল। লড়েছিলেন বঙ্গবন্ধুও। কিন্তু পাকিস্তান জন্মলাভের পর বাঙালি কি পেল? না রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি। বাঙালির ভাগ্যে কিছুই জুটল না, জুটল শোষণ-বঞ্চনা, নির্যাতন এবং মায়ের মুখের ভাষাও পাকিস্তানি শাসকরা কেড়ে নিতে চাইল। বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালি তার মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষা করল। বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংস করে দেয়ার নানা ষড়যন্ত্র চলতে থাকল।

আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শোনালেন অমর বাণী- স্বাধীনতা। দেখালেন, মুক্তির পথ-
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
জয় বাংলা।

সেই তো তাঁর অপরাধ।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করল প্রতিটি বাঙালির হৃদয়। যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রু কে পরাজিত করে বাংলার দামাল ছেলেরা ছিনিয়ে আনল স্বাধীনতার লাল সূর্য।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ’৭১-এর দেশি-বিদেশি পরাজিত শক্তি পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করল। মুজিববিহীন বাংলাদেশের আজ কি অবস্থা! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারাজীবনের সাধনা ছিল শোষণহীন সমাজ গঠন। ধনী-দরিদ্রের কোনো ব্যবধান থাকবে না। প্রতিটি মানুষ জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন অন্নবস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কাজের সুযোগ পাবে।
সারা বিশ্বে বাঙালি জাতির স্বাধীন সত্তাকে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে তিনি চেয়েছিলেন। আর সেই লক্ষ্যে সারাজীবন ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করেছেন, আপোসহীন সংগ্রাম করে গেছেন, জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। ফাঁসির দড়িও তাকে তার লক্ষ্য থেকে একচুলও নড়াতে পারেনি। তার এই আপোসহীন সংগ্রামী ভূমিকা আমাদের জন্য আদর্শ।
কিন্তু আমরা কি দেখি, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ঘাতকরা ক্ষান্ত হয়নি- আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করার অপচেষ্টায় এরা লিপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মূল্যবোধ, আদর্শ-উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সম্পূর্ণভাবে বিসর্জন দেয়া হলো। যে পাকিস্তানি জান্তার শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশ স্বাধীন করে গণতন্ত্র কায়েম করা হয়েছিল সেই গণতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সামরিক জান্তার শাসন কায়েম করল হত্যাকারীরা। সাধারণ মানুষ তার মৌলিক অধিকার হারালো। ( ঈষৎ সংক্ষেপিত)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিষ্ঠুরতম-হত্যাকান্ড
আরও পড়ুন