মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার
আজ এই মহান পরিষদে আপনাদের সামনে দুটি কথা বলার সুযোগ পেয়ে নিজকে ভাগ্যবান মনে করছি।
মোহাম্মদ আবদুল গফুর : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন প্রথম দেখি তখনও তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠেননি। তিনি ১৯৪৮ সালে তখন পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা। থাকেন কলকাতায়। পড়েন ইসলামিয়া কলেজে। আমি তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। থাকি ফরিদপুরের স্টুডেন্টস হোমে। ফরিদপুরে এলে তিনি অন্তত একবার স্টুডেন্টস হোমে আসতেন।
তাঁকে তখন দেখলেও তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়নি। তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভাষা আন্দোলনকালে ঢাকায়। ভাষা আন্দোলন যে শুরু হয় ১৯৪৭ সালে পয়লা সেপ্টেম্বর তারিখে জন্ম নেয়া ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংস্থা তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে, সে কথা তিনি বলে গেছেন তাঁর নিজের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’। ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকার মাধ্যমে। এর কয়েক মাস পর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামের যে ছাত্র সংস্থা জন্মলাভ করে তার অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এ ছাত্র সংস্থা তমদ্দুন মজলিসের অন্যতম সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে যে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় তাতে অংশগ্রহণ করার দায়ে তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কাসেম, পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন, আর গ্রেফতার হন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ শুরু হওয়া এ আন্দোলন ১৫ মার্চ পর্যন্ত চলতে থাকে। এতে আতঙ্কিত হয়ে ১৫ মার্চ তারিখে পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ভাষা আন্দোলন প্রশ্নে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সকল দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। তাঁর ভয় ছিল, পাকিস্তানের নেতা কায়েদে আযম জিন্নাহর ১৯ মার্চ ঢাকায় আসার কথা। তিনি যদি ঢাকায় এসে এই অরাজক পরিস্থিতি দেখতে পান, তাহলে নাজিমুদ্দিন সম্পর্কে তাঁর ধারণা ভালো থাকার কথা নয়।
নাজিমুদ্দিন যে আন্তরিকতার সাথে এ চুক্তি স্বাক্ষর করেননি, তার প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঢাকায় এসে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সংকল্প ঘোষণার মধ্যে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে যারা অবহিত তারা সবাই জানেন রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত বায়ান্নর ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের ফলে এরপর পাকিস্তানের সমগ্র ইতিহাসই কিভাবে প্রভাবিত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মনস্তাত্তি¡ক ভিত্তিভ‚মি গড়ে ওঠে।
একুশের রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের পথ বেয়েই পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও স্বাধিকার চেতনা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে এবং উনিশ শ’ একাত্তরের ডিসেম্বরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অনিবার্য করে তোলে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের এ অভ্যুদয়ের পেছনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের ছিল ঐতিহাসিক ভ‚মিকা।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালের পুরো নয় মাস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জেলে বন্দী ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের জেলে আটক থাকলেও সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ তাঁর নামেই পরিচালিত হয়। তিনি তাঁর প্রিয় জন্মভ‚মিতে জীবন্ত ফিরে আসতে পারবেন, এ বিশ্বাস অনেকেরই ছিল না। এই ধারণার বশীভ‚ত হয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দানকারী মুজিবনগর সরকারকে ভারতের জমিনে পেয়ে তাকে দিয়ে এমন এক সাত দফা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করে, যার মধ্যে ছিল
(এক). মুক্তিযুদ্ধের চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্বাধীন থাকবে মুক্তিবাহিনী।
(দুই). স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনী অবস্থান করবে (কত দিনের জন্য তা নির্দিষ্ট থাকবে না)।
(তিন). বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না।
(চার). বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের সময় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
(পাঁচ). বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে একটি সংস্থা গঠন করা হবে।
(ছয়). মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি এসব সরকারি কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করা হবে। প্রয়োজনে ভারতীয় কর্মকর্তাদের দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করা হবে।
(সাত). ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অবাধ সীমান্ত বাণিজ্য চলবে।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে প্রথমেই লন্ডন যান। সেখানে গিয়ে মুজিবনগর সরকারের সাথে স্বাক্ষরিত ভারতের এই চুক্তির বিষয়ে অবহিত হন এবং এ বিষয়ে তাঁর ইতিকর্তব্যও স্থির করে ফেলেন।
লন্ডন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পথে নয়াদিল্লিতে স্বল্পকালীন যাত্রাবিরতিকালে তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রথম সুযোগেই প্রশ্ন করে বসেন, ম্যাডাম, আপনার সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে কবে ফিরিয়ে আনবেন?
ইন্দিরা গান্ধী জবাব দেন, আপনি যখন বলবেন, তখনই। এর ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনীর দ্রুত অপসারণের পথ সহজ হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যে প্রথম ঘোষণাটি দেন, সেটা ছিল, বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। এটা যে শুধু তাঁর ঘোষণা মাত্র ছিল না তার প্রমাণ তিনি দেন, কিছুদিন পর লাহোরে যে ইসলামিক সামিট হয় তাতে। ভারতের বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে তিনি ঐ সামিটে যোগ দেন। এখানে উল্লেখ্য যে, যে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য এতদিন ভারতীয় পত্রপত্রিকা তাঁর প্রশংসায় মুখর ছিল, লাহোর ইসলামিক সামিটে তিনি যেদিন যোগ দেন সেদিন ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।