মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার
আজ এই মহান পরিষদে আপনাদের সামনে দুটি কথা বলার সুযোগ পেয়ে নিজকে ভাগ্যবান মনে করছি।
আমার জীবনে সব চাইতে বড় সৌভাগ্য ও গর্বের বিষয় এই যে, আমি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অকুণ্ঠ স্নেহ এবং তাঁর সাহচর্যে থেকে তাঁর নির্দেশ মতো কাজ করার সুযোগ লাভ করেছিলাম। ক্ষমতালোভী একদল বর্বর ঘাতকের হাতে তিনি সপরিবারে নিহত হয়েছেন। কিন্তু আমার কাছে তিনি চিরদিনের জন্য জীবন্ত। শুধু আমার কাছে কেন, তিনি চিরন্তন মহিমায় অমর হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়, মানুষের মনের মণিকোঠায়। স্বদেশ ও স্বজাতির স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে তার অতুলনীয় নেতৃত্ব ও ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং জনগণের জন্য তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে বঙ্গবন্ধু চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। শুধু দেশের মানুষের কাছেই নয়, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশান্তরের মানুষের কাছেও তিনি স্মরণীয়, বরণীয়। পৃথিবীর যেখানেই যখন মানুষ স্বাধীনতার কথা বলবে, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করবে, মুক্তির জন্য লড়বে, সেখানেই উচ্চারিত হবে এই শতাব্দীর বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতীয়তাবাদী নেতা ও মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তুলনা শুধু তিনি নিজেই। এ দেশে যুগে যুগে অনেক নেতা এসেছেন, কিন্তু জনগণ কি চায়, জনগণের অন্তরের আকাক্সক্ষা কি তা বঙ্গবন্ধুর মতো এমন নির্ভুলভাবে অন্য কোনো নেতাই বুঝতে পারেননি। বাংলার জনগণের সঙ্গে ছিল বঙ্গবন্ধুর আত্মার সম্পর্ক। তাই তিনি অনায়াসে তাদের আশার অমোঘ বাণীকে বুঝতে, তা ভাষায় রূপ দিতে এবং তাদের আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহসে জাতীয়ভাবে সার্বিক ঐক্য একবারই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর সেটা হয়েছিল ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। আর এইভাবে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেই বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধু বাঙালির অন্তরে সযত্নে লালিত স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আমি ছিলাম বঙ্গবন্ধুর একজন সামান্য কর্মী। তার আদর্শের একজন ক্ষুদ্র সৈনিক। তাঁর মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ও বিশাল হৃদয়ের মানুষের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছিলাম, তার নীতিনির্দেশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছিলাম এটাই আমার জন্য গৌরব ও অহংকারের বিষয়। আমার একার পক্ষে বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতার মূল্যায়ন করতে যাওয়া ধৃষ্টতারই শামিল। তবু একজন সচেতন মানুষ হিসেবে যেটুকু দেখেছি, যা বুঝেছি এটুকু বলতে পারি বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির অবিসংবাদী নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন দেশ ও জাতির জন্য নিবেদিতপ্রাণ। মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে ফাঁসিকাষ্ঠে দাঁড়িয়ে দেশের মাটি ও মানুষের মুক্তির কথা বলার মতো সাহসী ও দেশপ্রেমিক নেতা এদেশে একজনই জন্ম নিয়েছিলেন। তার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার মতো নেতার জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন হয়তো চিরকাল অলীক স্বপ্নই থেকে যেতো।
বঙ্গবন্ধু জনগণের মধ্যে থেকে কাজ করতে করতে, জনগণের মধ্যে থেকে উঠে এসে জনগণের নেতা হয়েছিলেন। জনগণের সঙ্গে ছিল তার নাড়ির যোগ। তাই তার এবং জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা এবং চিন্তা- চেতনার মধ্যে ছিল- নিবিড়, ঐক্য ও মিল। এই কারণেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির বিবেকের কণ্ঠস্বর বাংলার মুকুটহীন সম্রাট।
জননেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সব চাইতে বড় গুণ ছিল তিনি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে সঠিক সময়ে নির্ভুল সিদ্ধান্তটি নিতে পারতেন এবং নির্ভয়ে নিতেন। ইতিহাসের দিকে তাকালেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মৃত্যু হয় ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর। ১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করেছে তার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। তিনি ছয়দফা দেন পাক-ভারত যুদ্ধের পর পর ১৯৬৬ সালে। এ নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু আমরা দেখেছি ছয় দফা এদেশে এমন গণজারণ সৃষ্টি করেছিল যে আউয়ুব সরকার বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্তব্ধ করার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা খাড়া করেছিল। কিন্তু ছয় দফার মূলকথা এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি সম্বলিত এগারো দফা আন্দোলনের পথ ধরে গণঅভ্যুত্থান ঘটে। বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করেন, অপরদিকে আইয়ুর-মোনায়েমের পতন ঘটে। এখানেও প্রমাণিত হয় যে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন ছিল সঠিক এবং সময়োপযোগী। আইয়ুবের পরে ক্ষমতায় আসেন ইয়াহিয়া খান।
তিনি ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের জন্য লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডার বা এলএফও তৈরি করেন। এই বিধি ছিল সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক। তথাপি এটাই মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। তবু নির্বাচনকে গণতন্ত্র ও বাংলার স্বাধিকারের প্রশ্নে গণভোট হিসাবে গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু এই নির্বাচনে অংশ নেন এবং জয়লাভ করেন। এই বিজয়, বাঙালি জাতির, এই নির্বাচনী রায়ের মধ্য দিয়ে এটাই প্রতিষ্ঠিত হয় যে, বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার নয়, গোটা পাকিস্তানেরই নেতা। পরবর্তীকালে এই নির্বাচনী রায়ই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নৈতিক, যৌক্তিক ও আইনগত বৈধতার ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। আর এভাবেই প্রমাণিত হয় যে, বঙ্গবন্ধুর এলএফও’র অধীনে নির্বাচনে যাওয়া অত্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ প্রদত্ত ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রচন্ড চাপ ছিল। ইয়াহিয়া খানও সেই সুযোগের জন্যই ওঁৎপেতে ছিলেন। সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সেদিনই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করতো ঐ রেসকোর্স থেকেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সে অবস্থা সৃষ্টির সুযোগ দেননি। জাতি যাতে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি গ্রহণের সময় পায় সে জন্য বঙ্গবন্ধু আলোচনার পথ উন্মুক্ত রাখেন। অপরদিকে দেশবাসীকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এটাও বঙ্গবন্ধুর সঠিক ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্বাসে অবিচল ও আপোসহীন। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও তা থেকে বিন্দুমাত্র নড়তেন না। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু ইসলামী সম্মেলনে যোগদানের জন্য লাহোর যান। তার সঙ্গে তখন আমিও লাহোরে গিয়েছিলাম। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে রাখা হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের মরু এলাকার এক নির্জন জেলে। বঙ্গবন্ধুই ছিলেন সেখানে একমাত্র রাজবন্দি। জেলের একটি সেলে তাকে আটকে রাখা হতো সারাক্ষণ। তখনকার সংশ্লিষ্ট ডিআইজি প্রিজন বঙ্গবন্ধুর লাহোর সফরকালে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য লাহোর এসেছিলেন। কৌতূহলী হয়ে তার সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। ডিআইজি আমাকে বললেন, ‘আপনারা গর্বিত জাতি। শেখ সাহেবকে নিয়ে গর্ব করতে পারেন। শুনেছেন নিশ্চয়ই, তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। তার জন্য জেলখানার অভ্যন্তরে কবরও খোঁড়া হয়েছিল। উপরওয়ালাদের নির্দেশে আমিই তার কাছে গিয়ে বলেছিলাম, আপনি যদি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রত্যাহার না করেন, পাকিস্তানকে মেনে না নেন, তাহলে আপনাকে ফাঁসি দিয়ে ঐ কবরে ঠাঁই দেয়া হবে। জবাবে শেখ সাহেব বলেছিলেন, ‘ফাঁসিকে ভয় করি না, কবরকেও না। তোমরা আমাকে কবর দিতে পার। কিন্তু আমি জানি, বাংরাদেশের মানুষ সংগ্রাম চালিয়ে যাবেই, আমার দেশ স্বাধীন হবেই। তবে একটা কথা। যদি ফাঁসিই দাও, কবর এখানে দিও না। আমার লাশ আমার বাংলার মাটিতে পাঠিয়ে দিও। বাংলার মাটিতে আমার জন্ম। আমি চাই, বাংলার মাটিতেই যেন আমাকে কবর দেয়া হয়।’
আজ এত বছর পরে বঙ্গবন্ধুর কথা লিখতে বসে ভাবছি, কি আশ্চর্য এই দেশ। যে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানীরাও হত্যা করেনি সেই বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের মাটিতেই জীবন দিতে হলো, তাকে হত্যা করল বাংলাদেশেরই একদল ক্ষমতালোভী কুচক্রী ঘাতক।
বিশ্বাসের মর্যাদা বঙ্গবন্ধু পাননি। তাঁর বিশ্বাসের অমর্যাদা করেই পঁচাত্তরে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্ব ইতিহাসে তিনি নিজের জায়গা করে নিয়েছেন, আর তার সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তারা মীরজাফর হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।