দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
পাপের কুফল মানুষকে ভোগ করতে হবে। আখেরাতে যেমন ভোগ করতে হবে। তেমন দুনিয়াতে এর কুফল কিছুটা হলেও ভোগ করতে হবে। কথায় বলে ‘পাপে ছাড়ে না বাপেরে’। মহান আল্লাহ তো পবিত্র কুরআনে বলেই দিয়েছেন, ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে। এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।’ (সূরা যিলযযাল : ৭-৮) পাপের ক্ষতি ও অপকারিতার শেষ নেই। নিম্ন নির্দিষ্ট ১০টি পাপের ১০টি ক্ষতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. ফরজ নামাজ ছেড়ে দেওয়া।
ফরজ নামাজ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো রকমের ওজর ছাড়া ছেড়ে দিলে তার ওপর বিপদ-আপদ আসতে পারে। নবীজির ঘনিষ্ট সাহাবি আবু দারদা (রা.) বলেন, আমার বন্ধু রাসূল (সা.) আমাকে অসিয়ত করেছেন যে, আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করো না। তোমাকে (কেটে) টুকরো টুকরো করে ফেলা হলেও এবং তোমাকে জ্বালিয়ে ফেলা সত্তে¡ও। আর ইচ্ছাকৃতভাবে ফরজ নামাজ পরিহার করো না। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ফরজ নামাজ ছেড়ে দিলে তার ওপর থেকে (আল্লাহতায়ালার) দায়িত্ব উঠে যায়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ৪০৩৪)।
হাদিসটি দ্বারা বুঝা যাচ্ছে, ইচ্ছাকৃতভাবে জেনে-বুঝে ফরজ নামাজ ছেড়ে দিলে সে আল্লাহর দায়িত্ব ও নিরাপত্তা হতে বের হয়ে যায়। তাই এখন তার যে কোনো দুরবস্থা ঘটতে পারে।
২. ধন-সম্পদের জাকাত না দেওয়া।
ধন-সম্পদের জাকাত না দিলে বৃষ্টি হবে না। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার মহানবী (সা.) আমাদের কাছে আসলেন। অতঃপর বললেন, যারা নিজের ধন-সম্পদের জাকাত বন্ধ করে দিবে, তাদের জন্য আসমান থেকে বৃষ্টি বন্ধ রাখা হবে। এমনকি চতুষ্পদ জন্তু না থাকলে আদৌ বৃষ্টি হবে না।’ (হিলইয়াতুল আওলিয়া ৩/৩২০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ৪০১৯)।
৩. আল্লাহর অবাধ্য হওয়া।
আল্লাহর অবাধ্য হলে জালেক শাসক চেপে বসে। আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে কুদসিতে রয়েছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি সমস্ত সৃষ্টির উপাস্য, আমাকে ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। আমি রাজন্যবর্গের অধিপতি। সম্রাটদের সম্রাট। রাজাদের অন্তর আমার নিয়ন্ত্রাধীন। বান্দাগণ যখন আমার আনুগত্য করে, তখন তাদের রাজা-বাদশাহদের অন্তরকে রহমত ও করুণার সমন্বয়ে তাদের দিকে ঘুরিয়ে দেই। আর যখন বান্দারা আমার অবাধ্যতা অবলম্বন করে, তখন রাজা-বাদশাহদের অন্তরকে রাগ ও কঠোরতার দিকে ঝুঁকিয়ে দেই; যার ফলে তারা প্রজাদেরকে কঠিন শাস্থি আস্বাদন করায়।’ (আবু নোআইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া ৩/১৮০; মিশকাত, হাদিস ৩৭২১)। জালেম ও অত্যাচারী শাসক চাপানো হয় মানুষের অপকর্মের কারণে। হাঁ, শাসকবর্গ জুলুম অত্যাচর করলে তারা এর পরিণতি দুনিয়া-আখেরাতে ভোগ করবে।
৩. ব্যভিচার বেড়ে যাওয়া।
ব্যভিচারের কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যে জাতির মাঝে ব্যভিচার বিস্তার লাভ করে, তাদেরকে দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে পাকড়াও করা হয়।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস ১৭৮১২; মিশকাত, হাদিস ৩৫৮২)।
৪. ঘুষের সয়লাব।
ঘুষের কারণে ভীরুতা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আমর ইবনুল আস (রা.) হতে বর্ণিত, প্রিয়নবী (সা.) ইরশাদ করেন, যাদের মাঝে ঘুষ বিস্তার লাভ করে, তাদেরকে পাকড়াও করা হয় ভীতি ও আতঙ্কের মাধ্যমে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস ১৭৮২২; মিশকাত, হাদিস ৩৫৮২ )।
৫. অশ্লীলতার ছড়াছড়ি।
খোলাখুলি অশ্লীল কাজ হতে থাকলে সমাজে মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, একদিন রাসূল আকরাম (সা.) আমাদেরকে লক্ষ করে বললেন, হে মুহাজেরগণ! আল্লাহ না করুন, পাঁচটি বিষয়ে যখন তোমরা লিপ্ত হয়ে পড়বে। (তাহলে এ পাঁচটি বিষয়ের পরিণতিতে অব্যশই পাঁচটি বিষয় প্রকাশ পাবে) তন্মধ্যে একটি হলো, যখন কোনো জাতি সম্প্রদায়ের মাঝে খোলাখুলি অশ্লীল কাজ হতে শুরু করে, তখন অবশ্যই তাদের মাঝে প্লেগ এবং এমন সব রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়বে, যা তাদের বাপ-দাদাদের মধ্যে কারও হয়নি।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ৪০১৯)। জানি না আল্লাহ পাক আমাদের যত্রতত্র অশ্লীলতা আর বেহায়পনার কারণেই আমাদেরকে করোনার মতো ভয়ঙ্কর মহামারি দিয়েছেন কিনা। হাদিসের ভাষ্য তো তাই বলে।
৬. হারাম খাদ্য ও পোশাক-পরিচ্ছদ।
হারাম খাবার-দাবার ও পোশাক-পরিচ্ছদে ইবাদত-বন্দেগি কবুল হয় না। প্রসিদ্ধ সাহাবি আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহ পবিত্র। পবিত্রকেই তিনি গ্রহণ করেন এবং নিঃসন্দেহে আল্লাহ ঈমানদারদের সে আদেশই দিয়েছেন যা নবীগণকে দিয়েছেন। সুতরাং তিনি বলেছেন, ‘হে রাসূলগণ! পবিত্র বস্তু ভক্ষণ করো এবং সৎকর্ম সম্পাদন করো। আল্লাহতায়ালা আরও বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদের যা কিছু দান করেছি, তার মধ্য থেকে উত্ত বস্তু-সামগ্রী ভক্ষণ করো।’ অতঃপর মহানবী (সা.) এমন লোকদের কথা বলেছেন, যারা দীর্ঘ ভ্রমনে আসবে, যাদের মাথার চুল আলুথালু এবং দেহ ধূলিমলীন; যারা ওপরের দিকে হাত তুলে ইয়া রব, ইয়া রব বলে, অথচ তাদের খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, তাদের পোশাক হারাম এবং তাদের অস্তিত্ব হারাম দ্বারা পরিপুষ্ট, এবং এতদসত্তেও কেমন করে এদের দোয়া কবুল হহে পারে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস ১০১৫)।
৭. জুলুম অত্যাচার।
জুলুম অত্যাচার কিয়ামতের দিন অন্ধকার হয়ে উপস্থিত হবে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, হে মানুষ সকল! তোমরা জুলুম অত্যাচার থেকে বেঁচে থাকো। কেননা, জুলুম অত্যাচার কিয়ামতের দিন অন্ধকার হয়ে উপস্থিত হবে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৫৬৬২)।
৮. কৃপনতা।
কৃপনতা ধ্বংসের পাড়ে নেওয়ার মন্ত্র। আল্লাহর নবী (সা.) বলেছেন, তোমরা কৃপনতা থেকে বেঁচে থাকো। কারণ, কৃপনতা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে ধ্বংস করে ছেড়েছে; তাদেরকে অন্যায়ভাবে রক্তপাত ঘটাতে প্ররোচিত করেছে এবং হারাম সামগ্রীকে তারা (কার্যত) হালাল বানিয়ে নিয়েছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস ২৫৭৮; মিশকাত, হাদিস ১৮৬৫)।
৯. সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ পরিহার।
সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ দেওয়া পরিত্যাগ করলে আল্লাহর আজাব নেমে আসে। হুজাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত, হুজুর (সা.) ইরশাদ করেছেন, সে মহান সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ, অবশ্য অবশ্যই সৎকর্মের নির্দেশ দিতে থাকো এবং অসৎকর্ম থেকে বারণ করতে থাকো। অন্যথায় আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর নিজের (পক্ষ থেকে) আজাব পাঠিয়ে দিবেন। তখন আল্লাহর কাছে তোমরা দোয়া প্রার্থনা করবে, অথচ তা কবুল হবে না।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস, ২১৬৯)।
১০. সুদের সাথে জড়িত হওয়া।
সুদের দরূণ আল্লাহর আজাব গ্রাস করে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, যাদের মাঝে ব্যভিচার ও সুদ বিস্তার লাভ করলো, তারা নিজেদের উপর আল্লাহর আজাব নামিয়ে নিলো।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৩৮০৯; মুসনাদে আবু ইয়া’লা, হাদিস ৪৯৮১)।
তাই আসুন আমরা সব রকমের গোনাহ ছেড়ে দিয়ে আল্লাহমুখী হই। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে তো আরও বেশি আল্লাহমুখী হওয়া প্রয়োজন। যাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে করোনা মহামারিসহ সকল বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধার করেন।
লেখক : মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।