দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
বর্তমান সময়ে মিডিয়ার গণজোয়ার চলছে। বলা চলে মিডিয়া এখন সোনালী সময় পার করছে। মিডিয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কারো অজানা নয়। যুগ যুগ ধরে সংবাদ প্রচার ও বার্তা পাঠানোর বিভিন্ন পদ্ধতি চলে আসছে। সংবাদ প্রচার করা বা সাংবাদিকের যেমন মর্যাদা রয়েছে তেমনি রয়েছে তার জন্য সতর্কবাণী। রাসূল সা: আমাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন। অসংখ্য হাদীসে এসেছে তিনি সাহাবিদের উপদেশ দিতে গিয়ে এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘আমি কী তোমাদেরকে এমন সংবাদ দিব না যার ওপর আমল করলে তোমরা জান্নাতে যেতে পারবে?’ যেহেতু প্রত্যেক নবী-রাসূল আল্লাহর দেয়া সংবাদ পৃথিবীর মানুষদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন সেহেতু তাঁরা মূলত ইসলামি সাংবাদিকতা তথা ইসলামের সংবাদ কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কোরআনে সাংবাদিকতার বর্ণনা: আল্লাহ তাআলা সূরা সাবাতে হুদহুদ পাখির সংবাদের কথা আলোচনা করেছেন। সংবাদ কেমন হওয়া চাই,সাংবাদিকের গুণাবলী কি কি? এ নিয়ে চমৎকার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন: তারপর হুদহুদ এসে বলল, ‘আমি যা অবগত হয়েছি আপনি তা অবগত নন, আমি সাবা থেকে আপনার জন্য নিশ্চিত খবর নিয়ে এসেছি’। ‘আমি এক নারীকে দেখতে পেলাম, সে তাদের ওপর রাজত্ব করছে। তাকে দেয়া হয়েছে সব কিছু। আর তার আছে এক বিশাল সিংহাসন’। ‘আমি তাকে ও তার কওমকে দেখতে পেলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। আর শয়তান তাদের কার্যাবলিকে তাদের জন্য সৌন্দর্যমন্ডিত করে দিয়েছে এবং তাদের সৎপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে, ফলে তারা হিদায়াত পায় না।’ যাতে তারা আল্লাহকে সিজদা না করে, যিনি আসমান ও জমিনের লুকায়িত বস্তুকে বের করেন। আর তোমরা যা গোপন করো এবং তোমরা যা প্রকাশ করো তিনি সবই জানেন। আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোনো ইলাহ নেই। তিনি মহা আরশের রব।’ (সূরা আন-নামাল : ২২-২৬)
আয়াতে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। ১. খবরটি নির্ভরযোগ্য ও সুনিশ্চিত কি না সে ব্যাপারে অবগত হতে হবে। ২.সংবাদ প্রমাণ নির্ভর হতে হবে। ৩.সমালোচনা সবার জন্য সমান। এমন নয় যে শুধু প্রজাদের জন্য সমালোচনা আলো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কোন সমালোচনা নেই। ৪.সমস্যা ও তার সমাধানের প্রতি ইঙ্গিত থাকতে হবে। দুর থেকে নয় বরং মাঠে ময়দানে গিয়ে সংবাদ আনতে হবে।
হাদীসে সংবাদের বর্ণনা:
রাসূল সা: হুদাইবিয়ার সন্ধির পর বিভিন্ন দেশের রাজা বাদশাদের কাছে পত্র প্রেরণ করেছেন ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য। ইতিহাসের পাতায় সেসব বিরল ঘটনাবলী আজো অক্ষুণ্ণভাব সংরক্ষিত রয়েছে। ‘আবদুল্লাহ ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত ঃ আল্লাহর রাসূল সা: কায়সারের নিকট চিঠি লিখেছিলেন এবং এতে বলেছিলেন, যদি তুমি মুখ ফিরিয়ে রাখ তাহলে প্রজাদের পাপের বোঝা তোমার উপরেই চাপানো হবে। (সহীহ বুখারী,হাদীস:২৯৩৬)
ভুল সংবাদ প্রচার থেকে বিরত থাকা:
মহান আল্লাহ তাআলা কোরআনে কারীমে বলেন হে মুমিনগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোন সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও।( সূরা আল-হুজরাত:৬)
আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বে আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য এই আদেশ দিয়েছেন। বর্তমানে আমরা যদি এই আয়াতের প্রতি লক্ষ করি তাহলে মনে হবে আমাদের আজকের প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে আল্লাহ এই আয়াত নাজিল করেছেন।
যা শুনে তাই মিডিয়াতে প্রচার করে বেড়ানো, কত ভয়াবহ অপরাধ তা এই হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয়। হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন লোকের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে (সত্যতা যাচাই না করে) তা-ই বলে বেড়ায়। (মুসলিম,হাদীস:৫)
যে কোন সংবাদ যাচাই না করে তা ছড়িয়ে দিতে নিষেধ করা হয়েছে। বর্তমান সময়ের গণমাধ্যমের মাঝে এ ব্যপারে একটা প্রবণতা রয়েছে যে কে কার আগে সংবাদ ছড়িয়ে দিবে। বলা যায় একধরণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে। যার ফলে সংবাদ শুদ্ধিকরণ তা ভালোভাবে যাচায় বাচাই করার সুযোগ হয়ে উঠে না। এর ফলে সংবাদিক তার নির্ভরযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে, তেমনি যার ব্যপারে সংবাদটি প্রচার করা হয়েছে তার জীবন এক অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয়। এটাই আল্লাহ তাআলা কঠোরভাবে বারণ করেছেন।
সংবাদ প্রচার করা একটি আমানত: আমানতকে কোন ধরণের কাট-ছাঁট না করে হুবহু প্রকাশ করাই একজন পেশাদার সাংবাদিকের নৈতিক দায়িত্ব। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন: আমানতের খেয়ানত ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! খেয়ানত করোনা আল্লাহর সঙ্গে ও রাসূলের সঙ্গে এবং খেয়ানত করো না নিজেদের পারস্পরিক আমানতে জেনে-শুনে। (সূরা আল আনফাল-২৭)
অল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সদা সত্য ও নির্ভেজাল কথার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। আল্লাহ বলেন : হে ইমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো।(সূরা আল আহজাব-৭০) তাই নিজস্ব চিন্তা কিংবা দল-মতের রংচং মাখিয়ে সংবাদকে আংশিক বা পুরোপুরি পরিবর্তন করে উপস্থাপন করা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম। আপনার একটু পরিবর্তনেই দাবানলের আগুন জলে উঠতে পারে গোটা পৃথিবীজুড়ে। তাই এ ব্যপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা অপরিহার্য। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অনর্থ সৃষ্টিকারীদেরকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা কাসাস: ৭৭)
সাংবাদিকের পুরষ্কার:
যারা অনেক পরিশ্রম করে দেশের স্বার্থে অমানতের সাথে দুর দুরান্ত থেকে সংবাদ আহরণ করে তাদের জন্য রয়েছে বিশাল পুরষ্কার। হযরত হুযায়ফা রা: এর ঘটনা থেকে এমনটিই ফুটে উঠে। ইবরাহীম তাইমী তার বাবা থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন আমরা হুযাইফাহ্ (রাঃ)-এর কাছে ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি বলে উঠল। “হায়, আমি যদি রাসূল সা: কে পেতাম, তবে তাঁর সাথে মিলে একত্রে যুদ্ধ করতাম এবং তাতে কোনরূপ পিছপা হতাম না।” হুযাইফাহ্ (রাঃ) বললেন, হয়তো তুমি তা করতে, কিন্তু আমি তো আহ্যাবের রাতে রাসূল সা: কে এর সঙ্গে ছিলাম (সে রাতে) প্রচন্ড বায়ু ও তীব্র শীত আমাদের কাবু করে ফেলেছিল। এমনি সময় রাসূল সা: ঘোষণা করলেন, “ওহে! এমন কেউ আছে কি যে আমাকে শত্রুর খবর এনে দেবে, আল্লাহ তা’আলা তাকে কিয়ামতের দিন আমার সঙ্গে (মর্যাদার আসনে) রাখবেন?” আমরা তখন চুপ করে রইলাম এবং আমাদের মধ্যে কেউ তাঁর সে আহবানে সাড়া দেয়নি। এভাবে তিনি তিনবার বললেন এবং সবাই চুফ রইল। তারপর তিনি বললেন, হে হুযাইফাহ! ওঠো এবং তুমি শত্রু দের খবরাদি আমাকে এনে দাও। রাসূল সা: যখন এবার আমার নাম ধরেই ডাক দিলেন, তাই উঠা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। এবার তিনি বললেন, “শত্রু পক্ষের খবর আমাকে এনে দাও, কিন্তু সাবধান, তাদের আমার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করো না। আমি ফিরে আসলাম এবং ফিরে আসার সময়ও উষ্ণতা অনুভব করলাম। প্রতিপক্ষের খবর তাঁকে প্রদান করলাম। আমার দায়িত্ব পালন করে অবসর হতেই আবার আমি শীতের তীব্রতা অনুভব করলাম। তখন রাসূল সা: তাঁর অতিরিক্ত একটি কম্বল দিয়ে আমাকে আবৃত করে দিলেন, যা তিনি সাধারণতঃ সলাত আদায়ের সময় গায়ে দিতেন। তারপর আমি ভোর পর্যন্ত একটানা নিদ্রায় বিভোর রইলাম। যখন ভোর হল তখন তিনি বললেন,“হে গভীর নিদ্রামগ্ন! এখন উঠে পড়ো (সহীহ মুসলিম, সংক্ষেপিত,হাদীস: ১৭৮৮)
হাদীসে রাসূল সা: সংবাদকর্মীকে কেয়ামতের দিন তার সাথে থাকার সুসংবাদ দিয়েছেন। তাই যে সাংবাদিক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ নিয়ে আসবে তার জন্যও থাকবে এই অমোঘ সুসংবাদ।
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক জামিয়া বাবুস সালাম, বিমানবন্দর ঢাকা-১২৩০
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।